প্রবাসে মাতৃভাষার ঋণ

ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি এখন। শীতের ধূসরতায় রংতুলির আঁচড় বুলিয়ে প্রকৃতি এখনো হেসে ওঠেনি আমার শহরে। মনজুড়ে এখনো ধূসর স্থবিরতা। চারপাশের বৃক্ষরাজি এখনো আভরণহীন। সব হারিয়ে ফেলা গাছগুলো দিনভর মন খারাপের গল্প বলে যায়। পাতাহীন গাছ, বিবর্ণ ঘাস, আর নিঃসঙ্গ প্রকৃতি খুব একঘেয়ে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন অবিরত বেহাগ গেয়ে যায় আকাশ। তবে এই দীর্ণ প্রকৃতিও সবুজে ভরে যাবে। হরেক রঙের আঁচড়ে বিবর্ণ প্রসঙ্গ হয়ে উঠবে বর্ণিল, শীর্ণ প্রকৃতিতে প্রাণের বাড়বাড়ন্ত আসবে নিয়ম মেনেই। অপেক্ষা শুধু আর কিছুদিনের।
আমার শহরে বসন্ত এখনো সুদূর। এই শহরের বুকে যখন উত্তপ্ত লু হাওয়া বয়ে যায়, তখন মন খুঁজে ফেরে একটি তালপাতার পাখা বা শ্রাবণের বৃষ্টি-নূপুর। ব্যস্ত এ শহরে ছুটে চলা অবিশ্রান্ত আমি অবিরাম খুঁজে চলি করতোয়া পাড়ের একটি ছায়াময় বিকেল। আবার বরফকুচির নিঃশব্দ পতনে যখন মন ধূসর ক্যানভাসে রূপ নেয়, তখন আমি খুঁজে বেড়াই একটি নকশি সুজনী। আমার বা আমাদের এই খুঁজে যাওয়া চলে আমৃত্যু।
ফেব্রুয়ারি মাসটা আমাদের বাঙালিদের কাছে সব সময় অন্যরকম। ভাষার মাস, বইয়ের মাস, ভালোবাসার মাস এই ফেব্রুয়ারি। ভাষা নিয়ে আমাদের আবেগ সব সময় অন্যরকম। অনেক দাম দিয়ে কেনা এই বাংলা ভাষা আমাদের। তাই প্রতিটি বাঙালির কাছে এই মাসটা অন্যভাবে ধরা দেয়। নিউইয়র্ক প্রবাসী বাঙালিদের অনুভূতিও কিন্তু ব্যতিক্রম নয়।
দেশ ছেড়ে প্রায় দুই হাজার মাইল অতিক্রম করে আমরা যখন চলে আসি আটলান্টিকের এপারে, তখন আমরা পরবাসী, আমরা অভিবাসী। ভিন্ন দেশ, ভিন্ন পরিবেশের পরতে পরতে তখন আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বিচিত্র রকমের লড়াই। নিজের দেশের সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে নিজেদের শিকড় স্থাপনের লড়াইটা যে খুব চ্যালেঞ্জিং, তা সহজেই অনুমেয়। নতুন ভাষা, নতুন ধরনের কাজের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার সাথে সাথেই আমাদের শুরু হয়ে যায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
অন্য সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা আমাদের সন্তানদের নিজেদের শিকড়ের সন্ধান দেওয়ার যে প্রতিদিনের লড়াই, তা তুলনারহিত। ওরা চেনে না নিজের দেশের মাটির গন্ধ, ওরা ছুঁয়ে দেখেনি শ্রাবণের বৃষ্টি, দেখেনি করতোয়ার জলে রোদের খেলা। তবুও নিজের দেশ ও সংস্কৃতি ওদের মনে প্রোথিত করতে আমাদের চেষ্টার অন্ত থাকে না। ম্যাকচিকেন বা পিৎজায় ওদের মন বাঁধা জেনেও খাবার টেবিলে ওদের সামনে নিয়ম করে পাঁচ ফোড়নের সবজি, মাছের ঝোল, মসলাযুক্ত মাংস হাজির করে দেশীয় খাবারের স্বাদে অভ্যস্ত করার যেমন চেষ্টা থাকে, তেমনি থাকে বাংলা বলানোর আন্তরিক প্রচেষ্টা। ওদের এ দেশীয় উচ্চারণের বাংলাকে আমরা আদর করলেও, তা শুধরে দিতে থাকি সদা তৎপর। হাত ধরে ধরে স্বরবর্ণ আর ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারা আমাদের কাছে যেন বাংলা ভাষার ঋণশোধের শামিল। সেই ঋণ নিভৃতে শোধ করে চলেছে কেউ কেউ। আমরা অনেকেই জানি নিউইয়র্কে বেশ কিছু বাংলা শেখার ছোট ছোট স্কুল আছে। তবে নিউইয়র্কের একটি পাবলিক এলিমেন্টারি স্কুলে যে বিনা মূল্যে বাঙালি বাচ্চাদের বাংলা শেখানো হয়, তা খুব কম প্রবাসীই জানেন।
নিউইয়র্কের কুইন্সে পিএস ৯৫ ইস্টউড স্কুলটির প্যারেন্টস কো-অর্ডিনেটর একজন বাঙালি। মিস শাফি নামে পরিচিত এই বাঙালির ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুলটিতে সপ্তাহে একদিন নিয়মিত স্কুল সময়ের পর অতিরিক্ত দু ঘণ্টা বাঙালি বাচ্চাদের শেখানো হয় বাংলা ভাষা। শুদ্ধভাবে বাংলা বর্ণমালা শেখানোর পাশাপাশি শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণের ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয় সমভাবে। প্রতিটি বাঙালি শিশুর মধ্যে বাংলার বীজকে এমনভাবে প্রোথিত করার চেষ্টা করা হয় সেখানে, যাতে তারা শুদ্ধভাবে বাংলা পড়তে ও লিখতে পারে। বাংলাকে ভালোবাসতে পারে। শুধু বাংলা ভাষা শেখানোই নয়, বাঙালির গৌরবের ইতিহাস সম্পর্কেও এখানকার বাচ্চাদের একটি সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। এসব প্রচেষ্টার একটাই উদ্দেশ্য, আর তা হলো বাংলাদেশ থেকে প্রায় দু হাজার মেইল দূরে বেড়ে ওঠা এ প্রজন্ম যেন নিজের শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারে। এখানে বাচ্চাদের বাংলা শিক্ষক হিসেবে রয়েছেন মিস তনিমা। তাঁর সহযোগী হিসেবে রয়েছি আমি ও সুমি।
মহান একুশের ইতিহাস বাঙালি মননে অনুরণন করে সব সময়, সব জায়গাতেই। এ জন্যই মায়ের ভাষাকে যথাযথ সম্মান, তার নিয়মিত চর্চাকে নিউইয়র্ক প্রবাসী প্রায় সব বাঙালি ব্রত হিসেবে নিয়ে থাকে। প্রবাসে থেকেও নিজের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি অদম্য এই টান খুব সহজেই বাঙালিকে পৃথক করে অন্য যেকোনো জাতি থেকে। আর যখন মিস শাফির মতো কেউ যখন আটলান্টিকের এপারে বাংলা ভাষাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্রত নেন, তখন অবধারিতভাবে আমরা ও আমাদের ভাষাই নতুন করে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।