বাবা-মা সচেতন হন

ইদানীং দেখা যায় ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি প্রতিশোধপরায়ণ। তাদের চাওয়ার একটু এদিক-সেদিক হলেই আত্মহত্যা করে বসে, কিংবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত এমন ঘটনা ঘটায় যার জন্য বাবা-মা প্রস্তুত থাকে না। আর বিদেশ হলে তো জরুরি নম্বরে ফোন করে পুলিশ ডেকে নিয়ে আসে ছেলেমেয়েরা (বয়স ১৮ নিচে হলে)। অনেক ঘটনা আবার পত্রিকায় আসে, অনেক ঘটনা আসে না, চাপা পড়ে যায়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা কেন এমন করে?
দেখা যায়, বাবা-মা ব্যস্ত থাকে তাদের ব্যবসা নিয়ে, জব নিয়ে, সামাজিক কর্মকাণ্ড নিয়ে। ফলে ছেলেমেয়েরা একা হয়ে যায়। অনেকে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায়। বন্ধু ভালো হলে সমস্যা নেই কিন্তু খারাপ হলেই বিপদের পথে পা বাড়ায়। অনেক ছেলেমেয়ে আবার রাত জেগে অনলাইনে পড়ে থাকে। ফলে লেখাপড়ায় ভাটা পড়ে। রেজাল্ট খারাপ হয়। বাবা-মা তখন সন্তানকেই দোষারোপ করতে থাকেন কেন তোমার রেজাল্ট খারাপ হলো, পাশের বাসার ওকে দেখ কী ভালো রেজাল্ট করেছে! কিন্তু তারা যে সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেননি তা এড়িয়ে যান। অনেক ছেলেমেয়ে নেশায় জড়িয়ে যায়, আর বাবা-মা জানতে পারেন অনেক পরে। অবাক হন কবে থেকে এমন হলো ? সবচেয়ে ভয়ংকর যেটা সেটা হলো অনেক ছেলেমেয়ে রাত জেগে ভিডিও চ্যাট করে প্রেম প্রেম খেলা খেলে। কিন্তু কিছুদিন পর বনিবনা না হলেই ছেলেটা সেই ভিডিও নেটে ছেড়ে দেয়। নেটে আসার পর যখন জানাজানি হয় তখন বাবা-মা অবাক হয়ে যান, হায় হায় করেন কখন এমন করল!! মাথায় আপনার আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়।
আবার নামাজ পড়া, ভদ্র অমায়িক ছেলেটার এক সময় পরিচয় মেলে সে জঙ্গি, মেয়েটা জঙ্গির খাতায় নাম লেখায়। অথচ বাবা-মা হিসেবে আপনি কিছুই জানেন না। জানেন সর্বনাশ হওয়ার পর।
কিন্তু এমন হচ্ছে কেন? কী কারণে? ছেলেটা কি একদিনেই এমন হয়ে গেল? তা কী করে হয়! বাবা-মা, পারিপার্শ্বিকতা কী দায়ী নয়? অবশ্যই দায়ী। বাবা-মা ব্যস্ত।
এত ব্যস্ততার ভিড়ে বাবা-মা হয়তো দেখছে ছেলেমেয়ে লেখাপড়া ঠিকভাবে করছে কিনা, তাদের কাছে রেজাল্টই আসল। জিপিএ ফাইভ পেল কিনা। বিদেশে হলে ভালো স্কুল হলেই বাবা মা গর্বিত।
ছেলে মেধাবী, আধুনিক বন্ধু-বান্ধবী আছে এতেই খুশি । সোসাইটিতে মাথা উঁচু করে চলে। ছেলেমেয়ে যা চায় তাই দেয়, বিশেষ করে টাকা। ভাবে, থাকনা ভালো রেজাল্ট করেছে, একটু আনন্দ ফুর্তি করুক। বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে ঘুরে বেড়াক। বাবা-মায়ের ছেলেমেয়ের মনের খবর নেওয়ার সময় নেই। তার চেয়ে তারা হিসাব করতে বসে যায় কী করলে আরও দুটো টাকা আয় করা যাবে। কী করলে তাদের সন্তান আরও অনেক ভালো রেজাল্ট করবে। অনেক সময় ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপে পড়ে মানসিকভাবে অসুস্থতায় ভুগতে থাকে নীরবে।
আচ্ছা, আপনি কি কখনো ছেলের হাত ধরে বলেছেন বাবা চল আজ সারা দিন তোর সঙ্গে থাকব। সবাই মিলে চল লং ড্রাইভে যাই। চল আমরা একটা ফুলের বাগান করি ছোট ব্যালকনিতে। একটা পাখি পোষ মানাই, তোর জন্মদিনে পাখিটাকে মুক্ত করে দেব আকাশে। চল আমরা আজ একসঙ্গে রান্না করি, তোর মাকে আজ ছুটি দিই। তোর রুমটা গুছিয়ে দিই। চল ক্রিকেট খেলা দেখি একসঙ্গে বসে। চল ছুটির দিনে সবাই মিলে তোর দাদা-দাদিকে দেখে আসি। (যদি বেঁচে থাকে, আজকাল তো আর একসঙ্গে কেউ থাকে না)। কিংবা তোর চাচা বা ফুফুর, খালাদের বাসায় যাই। চল একসঙ্গে নামাজে যাই। আমি নিশ্চিত ওপরের এই লেখাগুলো দেখে আপনি হাসছেন আর ভাবছেন এগুলো কী বলছি!
অথচ আপনারই আপনার ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হওয়ার কথা। একজন বাবা-মা সবচেয়ে কাছের মানুষ, ভালোবাসার মানুষ, যে সন্তানের জন্য তারা জীবন দিতে পারে। অথচ এই কাজগুলো করতে পারেন না সময়ের অভাবে; যা এক প্রকার দায়িত্বহীনতা বলা যায়। ছেলেমেয়ে কোনো অভিযোগ নিয়ে এলে দেখা যায় ব্যস্ততার অজুহাতে আপনি শুনতে চান না । বাবা দোষ দেয় মায়ের,আর মা দোষে বাবাকে। শিক্ষক, প্রতিবেশী তারা তো অনেক পরে আসে। ছোট বেলা থেকেই আপনি যদি আপনার সন্তানের মনের মধ্যে ভালোবাসার, স্নেহের বীজ বপন করে দেন, আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী চলতে শিখিয়ে দেন, বড় হয়ে সে যেখানেই থাকুক না কেন অন্তত অমানুষ হবে না, খুনি হবে না। আত্মহত্যা করবে না ।
অনেক বাবা-মা আবার ছেলেমেয়েদের কথা শোনায়। দেখ, অমুকের ছেলেটা, মেয়েটা কি ভালো স্টুডেন্ট, কি ভদ্র! আর তুই? কড়া শাসনের শেকলে আটকে ফেলে ছেলেমেয়েকে। আর তখনি ছেলেমেয়ে সে শেকল ভেঙে বের হয়ে আসতে চায় যে প্রকারেই হোক, তখন ছেলেমেয়ে খুন করতেও দ্বিধা করে না। তাদের মাঝে কোনো অপরাধ বোধ কাজ করে না, চিন্তা থাকে একটাই শাসনের বেড়াজাল থেকে বের হওয়া। বন্ধু-বান্ধব থেকে ধার করে বুদ্ধি নেয়, বাবার পকেট চুরি করে। জীবন কোনো দিকে গেল ভালো না মন্দ সেটা ভাবে না।
অথচ এই ছেলে মেয়েটাই হতে পারত একজন সমাজসেবী, হতে পারত বিজ্ঞানী, হতে পারত বড় ক্রিকেটার। আমরাই আমাদের সন্তানদের প্রতিভা নষ্ট করে ফেলি। নষ্ট হওয়ার পর বলি কীভাবে সে এ রকম হলো, আশ্চর্য হই। ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করে বাবা-মা অবাক হয়? কিন্তু একদিনের কষ্টে তো আত্মহত্যা করে না। দীর্ঘদিনের কষ্টগুলো জমা হতে হতে হতাশায় তার একসময় মনে হয় বেঁচে থেকে কি লাভ, তখনি তো আত্মহত্যা করে।
বাবা-মা জানে না কেন এমন হয়। মূল কথা হলো, তারা খোঁজ নিয়ে দেখে না, কারণ তাদের সময় নেই, অবহেলা করে, জানলেও ভাবে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে যখন মৃত্যু হয় সারা দেশবাসী জানে তখন আর সন্তানের লাশও নিয়ে কাঁদে, হায় হায় করে ।
সত্যি কি বাবা-মায়ের মনে কষ্ট হয় না? হয়। সামাজিকতার ভয়ে তারা কষ্টটা আড়াল করে।
আপনার সন্তান কী করে জানুন, তার মন বোঝার চেষ্টা করুন। তাকে সময় দিন। আপনি টাকার পিছে ছুটলে তো হবে না, আপনি যদি একজন ঘুষখোর হন, দুর্নীতিবাজ হন তাহলে আপনার সন্তান কীভাবে মানুষ হবে? বাবা মায়েরা আপনারা আগে নিজেদের দিকে তাকান সন্তানের কথা চিন্তা করে অন্তত। আপনি যদি শুদ্ধ মানুষ হন, আপনি যদি সন্তানের মনের মধ্যে ভালোবাসার বীজ বপন করে দেন, আপনার সন্তান যদি জেনে যায় আপনি তার জন্য অনেক করেন, তার প্রতি আপনার সহমর্মিতা আছে, বিত্তের চেয়ে সে বেশি মূল্যবান আপনার কাছে, তাহলে সে সন্তান কিছুতেই আপনাকে অবহেলা করবে না। আর না হয় একটা সময় এসে দেখবেন পত্রিকার পাতায় আপনার সন্তানের নাম। সে খুনি, সে জঙ্গি, সে রেপিস্ট, সে আত্মহত্যা করেছে হতাশায়।
তখন আপনার অঢেল অর্থবিত্ত, সামাজিক মর্যাদা, গৌরব সব ধুলোয় মিশে যাবে। সন্তানের অধঃপতন দেখে সেদিন শুধু আপনার নিশ্বাসে একটা কথাই প্রতিধ্বনিত হবে এ আমি কী করলাম! কেন তাকে মানুষ করলাম না। তখন অন্যদিকে বাতাস বইবে, আপনার আর করার কিছুই থাকবে না। তাই সময় থাকতে সন্তানের খোঁজ রাখুন, তাকে সময় দিন, আপনারাই হতে পারেন ছেলেমেয়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।