পশ্চিমবঙ্গে হিংসা চড়াচ্ছে গেরুয়াবাহিনী

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও জাতীয় সংহতির প্রশ্নে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান সারা ভারতের মধ্যে বরাবরই অনন্য। বাংলার মানুষের কাছে এটি নিঃসন্দেহে গৌরবের এবং অহংকারেরও বটে। অভিজ্ঞতার নিরিখে দেশ-বিদেশের মানুষ উপলব্ধি করেছেন বাংলার বুকে ধর্মীয় মৌলবাদ তথা সাম্প্রদায়িক শক্তির শেকড় যেমন দুর্বল, তেমনি প্রভাবও ক্ষীণ। এখানে উগ্র জাতীয়তাবাদের নামে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনোভাব অনেক বেশি শক্তিশালী। আবেগের দমকা হাওয়া সব ওলটপালট করার চেষ্টা করলেও বৃহত্তর মানুষের বোধ ও চেতনা তার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম।
বিগত কয়েক দশক সময়ে জাতীয় কোনো সংকটকে ঘিরে যখন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে হিংসা, বিদ্বেষ ও হাঙ্গামার ঘটনায় সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব প্রকট আকার নেয়, তখন বাংলা তথা পশ্চিমবঙ্গ তাকে উপেক্ষা করে শান্তি, সম্প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধন অটুট রাখতে পেরেছে। এটিই পশ্চিম বাংলার ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, গণতন্ত্রপ্রিয় ও শান্তিকামী মানুষের অনন্যতা। কিন্তু সেই অনন্যতা, সেই গৌরব আজ পশ্চিমবঙ্গে ফিকে হয়ে গেছে। পুলওয়ামার ঘটনার পর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী গেরুয়াবাহিনী বাংলার সর্বত্র হামলা, হুমকি ও ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে সন্ত্রাসের আবহাওয়া তৈরি করছে এবং মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে—এমন খবর পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে।
আরএসএস তথা সংঘ বাহিনীর বিভিন্ন শাখা উগ্র দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুলে যে যুদ্ধজিগির ছড়াচ্ছে, তার শিকার আজকের পশ্চিমবঙ্গ। কাশ্মীরিদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, তার থেকে আজ মুক্ত নয় পশ্চিমবঙ্গ। পত্রপত্রিকায় দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী গেরুয়াবাহিনী রীতিমতো পেশাদার দুষ্কৃতকারীদের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালাচ্ছে। সামাজিক গণমাধ্যম বা অন্যত্র যারা যুদ্ধোন্মাদনার বিরোধিতা করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে মত দিচ্ছেন, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। যারা মোদি সরকারের বিরোধিতা করছে, ৪৯ জওয়ানের মৃত্যুর জন্য সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মুখর হওয়ার পাশাপাশি যারা সরকারি উদাসীনতা ও নিরাপত্তার ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তাদেরও সরাসরি দেশদ্রোহী বলা হচ্ছে। ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে এমন পোস্টিং দেখা যাচ্ছে, গেরুয়া লেঠেলরা খুঁজে খুঁজে তাদের বাড়িতে হাজির হয়ে আক্রমণ করছে। বাড়ি আক্রমণ হচ্ছে, মারধর করা হচ্ছে, ভয় দেখানো হচ্ছে। কোথাও ধর্ষণ বা খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে এমন শতাধিক ঘটনা ঘটেছে যা অতীতে কোনো দিন পশ্চিমবঙ্গে কল্পনাও করা যায়নি। আজ নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায় ও বিনা বাধায় শান্ত সমাজকে দ্বিধান্বিত ও আতঙ্কগ্রস্ত করা হচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এসবের বিরুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নির্বিকার। যখন দরকার কড়া হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা, তখন পুলিশ নিষ্ক্রিয় থেকে পরোক্ষে গেরুয়া সন্ত্রাসীদেরই মদদ দিচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার নিন্দা করেছেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার পুলিশ প্রশাসন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তাই গেরুয়াবাহিনীর সাহস ও আগ্রাসী মনোভাব বাড়ছে। কাজ করে যাচ্ছে।
এ ধরনের সংকটের সময় প্রশাসনিক কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি জরুরি হয়ে পড়ে শান্তিকামী মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। রাজনৈতিক মোকাবিলার পথে গণমিছিল, গণসমাবেশ, এলাকায় শান্তিবাহিনী গঠন করে সতর্ক নজরদারি ইত্যাদি বাদ দিয়ে শান্তি সম্প্রীতি-ঐক্য রক্ষা করা যায় না। রাজনৈতিক দলের বাইরেও নাগরিক সমাজ, বিশিষ্টজনদের একটা ভূমিকা থাকে। সেই জায়গাটাও অচল করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকারের ভূমিকা পরোক্ষে গেরুয়া হিংস্রতাকেই প্রশ্রয় দিয়ে বাড়িয়ে তোলার ব্যবস্থা হচ্ছে।
অতীতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, তারও আগে ইন্দিরা গান্ধী ও রাজিব গান্ধীকে হত্যার পর, গুজরাট দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন সরকার দাঙ্গাবাজ ও হামলাকারীদের কঠোর হাতে দমন করেছে। পাশাপাশি সরকারি সহায়তায় সাধারণ মানুষকেও রাস্তায় নেমে গণপ্রতিবাদ ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেখা গেছে। আজ আর পশ্চিমবঙ্গে সেই সরকার নেই, সেই বাংলাও নেই। আজকের বাংলাকে হিংসা-বিদ্বেষ গ্রাস করছে। বিভেদ-বিভাজনের আগুনে খান খান হচ্ছে বাংলার ঐক্যবদ্ধ সমাজ। বাংলার সমাজে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। শান্তি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। সরকার নির্বিকারভাবে তাতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছে। পলওয়ামারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদী সরকার দেশে চরম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তালে ভোট যুদ্ধ পার করতে চাচ্ছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপি বহরে সন্ত্রাসবাদী হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, এখন থেকে দুদেশের মধ্যে আলোচনার দরজা বন্ধ। পুলওয়ামায় সিআরপি জওয়ান হত্যার জন্য বড় রকমের মূল্য দিতে হবে পাকিস্তানকে। ভারতের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ভোটের প্রচারে ঝটিকা সফরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধংদেহি’ মনোভাব জাহির করে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন মোদি। দেশজুড়ে বিজেপি নেতারা এবং মোদি যুদ্ধের জিগির তুলে মানুষকে খেপানোর চেষ্টা করছেন। মানুষের মধ্যে তথাকথিত আবেগ, দেশপ্রেম জাগানোর পরিবেশ তৈরি করে দেশবাসীর মধ্যেই বিভেদের আগুন জ্বালাতে নানাভাবে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছেন বিজেপি নেতারা। বিভিন্ন রাজ্যে অধ্যয়নরত বা কর্মরত কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে মানুষকে তাতিয়ে এক সর্বনাশা পরিবেশ তৈরি করতে চাচ্ছেন তারা।
স্বয়ং মোদিসহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার দায়িত্বশীল মন্ত্রীরাও উস্কানিমূলক প্রচারে ইন্ধন দিচ্ছেন। তাঁরা হুংকার দিয়ে বলছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার পর্ব শেষ। এবার জবাব দেওয়ার পালা। মোদি প্রকাশ্যে বলে দিয়েছেন, পাকিস্তানকে উপযুক্ত জবাব দিতে সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানকে সমঝে দিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, সেটা সেনাবাহিনীই ঠিক করবে। মোদিসহ সংঘ পরিবার তথা বিজেপি পাকিস্তানকে নিশানা করে যুদ্ধের জিগির তুলতে পিছিয়ে নেই। কিন্তু সাধারণ নাগরিক, সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী রাজনৈতিক দল মোদিবাহিনীর জিগিরের বিরুদ্ধে নিন্দা, সমালোচনার ঝড় তোলায় জনমত কিন্তু সরকার ও শাসকদলের সর্বনাশা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। কথায় বলে যতটা গর্জায়, ততটা বর্ষায় না। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যদি যুদ্ধ লাগানো হয়, তার পরিণতি কী হতে পারে—এ ঘটনা দেশকে কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে, মোদি গংরা কি সেটি ভেবে দেখেছেন?
তবে আশার কথা, হঠাৎ কিছুটা পরিবর্তনের সুর দেখা যাচ্ছে। মোদিসহ সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপের জন্য কিছুদিন ধরে যে গলা ফাটিয়ে আসছিলেন, হঠাৎ তা কেমন যেন মিইয়ে গেল! সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মোদির বৈঠকের পর যে যৌথ বিবৃতি প্রচারিত হয়েছে, সেখানেই দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের জিগিরের পথ থেকে মোদি উল্টো দিকে হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। যৌথ বিবৃতি সুর নরম করে পাকিস্তানের সঙ্গে ফের আলোচনার বার্তাই দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, দুদেশের মধ্যে আলোচনা শুরু করার মতো পরিবেশ তৈরিতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই সচেষ্ট হবে। এ ব্যাপারে দুদেশই একমত হয়েছে।
আলোচনার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে ভারত-পাকিস্তান দুপক্ষই দায়বদ্ধ। তবে এ কথা ঠিক, যুদ্ধ জিগিরের পথ থেকে সুর নরম হলেও দুদেশই কিন্তু চট কর এই মুহূর্তে আলোচনার পথে যাবে না। এর জন্য অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হতে দুদেশেরই সময় প্রয়োজন। এখন দেখার বিষয়, নতুন করে আলোচনা শুরু করতে ভারত ও পাকিস্তানের শাসকদের শুভবুদ্ধির উদয় হয় কিনা? তাদের মতিগতির পরিবর্তন হলে এই উপমহাদেশে উত্তেজনা প্রশমণে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে। সে পথে ভারত-পাকিস্তান পদক্ষেপ নিলে আখেরে তাদেরই লাভ। লাভ দুদেশের মানুষেরও। কিন্তু শেষ অবধি কি দুদেশ মুখোমুখি বসবে?