স্বপ্নের নগরে স্বপ্নেই বাঁচে মানুষ

নিউইয়র্ক নগরের মতো স্বপ্নের শহরে এসে সবারই একটা ধাক্কা লাগে। যেন শীতার্ত হাওয়ার তীব্র কোনো ছোবল, যা কয়েক শ হাত পেছনে ফেলে দেয়। সেই পড়ে যাওয়া থেকে উঠে দাঁড়ানোর নামই ডারউইনের ভাষায় টিকে থাকা। অনেকে এসে ফেরত যায়, সেই থাকে যে ফিটেস্ট। উনি বলে গেছেন, টিকে থাকার নামই, ‘survival of the fittest’। যার সব আছে, পরিবার–পরিজন আছে সেও হিমশিম খায়। সব থাকার পরও কি যেন নেই। একটা গাছ যেমন মাটিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে বপন করলে, মাথা সোজা করে দাঁড়াতে সময় লাগে, একজন মানুষেরও লাগে। স্বপ্নের পাখায় ভর করে সব প্রতিকূলতা জয় করে এই মানুষ।
যেসব ছেলেমেয়ে মা–বাবার অতি আদরে যত্নে বড় হয়ে ওঠে, অনেক সময় তাদের মাথায় অতি রোগেশোকেও হাত বুলিয়ে দেওয়ার কেউ থাকে না। আদর যত্ন তো অনেক দূর। দীর্ঘদিন যে রেস্তোরাঁয় কাজ করে তার খাবার ছাড়া অন্য খাবার জুটে ভাগ্যক্রমে। অনেকের বা জুটে না কিছুই। যেমন আপা লন্ডন থেকে একদিন বললেন, ব্রাজিলিয়ান এক ছাত্রী পার্কে বসে কাঁদছে, খাওয়া–দাওয়া করেনি, পয়সা নেই। কাজ তো করা যায় না। উনি বাসায় এনে মাছ–ভাত খাওয়ালেন। তিনি যেহেতু ঝাল বেশি খান, তাই তরকারি সে রকমই ছিল। মেয়েটি খিদেয় খেয়ে ফেলেছে, কিন্তু চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আনন্দাশ্রু, ঝাল খেয়ে চোখের পানি মিলে একাকার। আপা ফল বের করে দিলেন, চিনি দিলেন। সে আঙুর আর পানি মিশিয়ে চিনি দিয়ে পেস্ট করে খেলো। একবার ভেবে দেখুন, আপনার কোনো প্রিয়জনকে কল্পনা করে!
একদিন বাসে বসে শুনলাম, এক ছেলে বন্ধুকে ফোন করে বলছে, ‘আম্মু বলে দিয়েছে, কীভাবে ডিম ভুনা করতে হয়? আমি রান্না করে রেখে এসেছি, তুই খেয়ে নিস, ডালও আছে।’ হেসে হেসে বলা এই যে কথাটা খুব সামান্য। কিন্তু এ বাক্যের শ্রবণবোধ শুধু আমার কানেই পৌঁছেনি, একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে দিয়েছে। আমি সামনে থেকেও ছেলেটাকে ঘুরে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। বাচ্চা একটা ছেলে হয়তো জীবনের স্বপ্ন নিয়ে পড়তে এসেছে। সবারই স্বপ্নের দেশে স্বপ্নগুলো কখনো দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়, কখনো স্বপ্নের মতো সুন্দর হতে হতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কেউ চলে যায় হয়তো দূর যাত্রার যাত্রী হয়ে সড়ক দুর্ঘটনায়, কেউ চলে যায় রোগশোকে ভোগে। পত্রিকা খুলে বা খবরের চ্যানেলগুলোতে বিশ্বের কোনো না কোনো দেশের খবর ভেসে আসে কানে, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র.... । স্বপ্ন পূর্ণ হতে হতে হঠাৎ ঘুম ভাঙার মতো হারিয়ে যায়।
কারও স্বপ্ন বিলীন হয়ে যায় স্বামী–স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটিতে, শেষ পর্যন্ত তালাকের সিলে খাম বন্ধ হলেও বাচ্চারা শেয়ার কাস্টডিতে থাকে। দেখা যায়, কিছু তিক্ততা গিয়ে পড়ে ওদের গায়ে। ফুটবলের মতো এ বার থেকে ও বারে ওরা গোল দেয় ঠিকই, তবু মিইয়ে থাকে জীবনভর। নিজেদেরও পিছু ছাড়ে না দেয়াল। এ জন্য স্বার্থ ত্যাগ করে একেবারে নিজের মতো একান্তভাবে বড় করে তোলায়ই মঙ্গল। কিন্তু স্বপ্ন এসে এখানেও বাঁধা দেয়, ডলার ছাড়া যে স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার নয়। কারও ভালোবাসার সংসার কাউকে এমনি ছেড়ে যেতে হয়, কারণ আরেকপক্ষের হয়তো ভালোবাসাই নেই। কোথাও ভালোবাসা আছে, কিন্তু নিয়তি নির্মমভাবে ভারী করে তোলে বাতাস।
এক নিউইয়র্কবাসী তার একটা নোট খাতায় লিখে রেখেছেন, আট ঘণ্টা করে প্রতিদিন, সপ্তাহে মোট কত ঘণ্টা কাজ করলেন? সেই সঙ্গে ডলারের হিসাব। প্রতিদিন ব্যাংকে স্বল্প সঞ্চয়ের হিসাবও। সাল ২০১৪-১৫। এশীয় বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতীয় স্টোরে ঘণ্টার হিসাবটা নিয়ে মালিকেরা হেরফের করেন, যা আমি আগে একবার লিখেছি। হয়তো সে জন্য এ নোট। হিসাবটা করে দেখলাম, কর্ম ঘণ্টার তুলনায় পয়সা অনেক কম। স্বপ্নের শহরে তিনি ভালোবাসা বপন করেছিলেন। ঘরের কোনায় রাখা ফুলদানির মতো স্মৃতির অ্যালবাম, নূতন তৈজসপত্র পড়ে আছে ঘরে, ভাঁজহীন বিছানার চাদর, হাঁড়ি পাতিল বর্তন, নূতন জীবনের ছোঁয়ায় ঝলসে ওঠার আগেই মুছে গেছে সে বাগানের মালি। রঙিন শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে পারফিউমের সুবাস, শুধু নেই মানুষটা। তারপরও এ শহর প্রতিদিন স্বপ্ন দেখায়।
ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে কিছু সম্পর্ক থাকে বন্ধুত্বের, কিছু মমত্বের। তার ওপর এই হিসেবি মেয়েটির সঙ্গে আমার হলো কষ্ট ভাগ করার সম্পর্ক। তার শেষ দিনগুলোতে আমি বিভিন্ন সময় চলে যেতাম অতীতে চেন্নাইয়ে কাটানো দিনগুলোতে। নিজেকে দিয়ে তাকে অনুভব করতাম। সে শুধু আমার বোনের মেয়ে নয়, অন্য কিছু।
বিষয়টা সামনে আনার মূল কারণ গড়পড়তা সব মানুষের জীবনের হিসাব এ রকম। যে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে দেশ গড়ে উঠছে, একটা পরিবার পোষা হচ্ছে, কেউ আনন্দ কিনছে, কেউ বিলাসিতা করছে, না পেলে মন মতো কেউ হয়তো আঘাত করছে। অথচ কেউ জানে না, নকশি কাঁথায় গাঁয়ের বধূর দুঃখের চেয়ে বেশি দুঃখের ছোঁয়া এই প্রতিটি সেকেন্ডে। অনেকেই বলে, বাড়ির মানুষ টাকা পাঠানোর আগ পর্যন্ত হয়তো ফোন দেয়, তারপর ভুলে যায়। এ রকম দুঃখবোধ নিয়ে প্রবাসীদের জীবন।
কেউ কেউ বছরের পর বছর ঘর করেন শুধু সমাজের কথা ভেবে। ‘সবাই দেখে ফ্রেমে তোলা ছবি, হৃদয়ে থাকে অন্য কারও বিবি’। তাঁরা নিজের জন্য বাঁচেন না, বাঁচেন অন্য কারও জন্য। প্রতিদিন বিষাক্ত মন নিয়ে সংসার ধর্ম পালন করে যান। ছেলেমেয়েরা দেখে দেখে বড় হয় এক সময় মনের মধ্যে দুঃখ গোপন রেখে চলা শিখে যায়। পুরোনো প্রেমিকসহ মুখ ঢাকা পড়ে। রাতের আঁধারে জোনাকি পোকার মতো দেখে নববধূর মুখ। মা–বোনরা নিশ্চয় খারাপ মেয়ে দেখবে না। নিজের চোখে না দেখলেও ভিডিও কলে ভেসে ওঠে নববধূর লাজুক হাসি। অনেক সময় অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় ভালোবাসা পরাজিত হয়। কোথাও ভালোবাসা মরে যায়, কোথাও বা জমে ওঠে নূতন খেলা। কারও দুঃখ কারও হাসি—এ নিয়ে বয়ে যায় স্বপ্নের এই শহরে স্বপ্নের বন্যা।
একজন মানুষ এখানে মানসিকভাবে রীতিমতো আহত থাকে। তারপরও কাজ করে যায় প্রিয়জনের জন্য, স্বপ্নের জন্য। সেই স্বপ্ন কতটা পূর্ণ হলো, প্রিয়জন সেই পয়সা কীভাবে খরচ করল—কথাগুলো সবার জন্য প্রযোজ্য সবারই অল্পবিস্তর আত্মীয়স্বজন প্রিয়জন আছেন। অনেকে বাবা বা স্বামীর টাকায় গয়না কিনছেন, ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটা লেহাঙ্গা না থাকলে পার্টিতে মান থাকছে না। কিন্তু তিনি কি ভেবেছেন, কখনো এই ২০ হাজার তার বাবা বা স্বামী কতটা কষ্টে, কতটা ঘণ্টার শ্রমে উপার্জন করেছেন? যে স্বামী বা প্রেমিক পুরুষ ভালোবাসা দেখাতে দেখাতে পাগল বানিয়ে ফেলছেন, তিনিই একটা লেটেস্ট মডেলের আইফোনের জন্য স্ত্রী বা প্রেমিকাকে খোঁচা দিয়েই চলেছেন। একটা আইফোন এক হাজার ডলার, যা হয়তো সে তিন সপ্তাহে আয় করছে। কিংবা তার হয়তো কাজটাই চলে গেছে, কিন্তু রাগে–দুঃখে–অভিমানে বলতেই পারছেন না, তিনি কত অসহায়!
তারপরও এমন বৈরী হাওয়ায় মানুষ টিকে থাকে স্বপ্নের জন্য। একটা কিছু তো হবে, সেটা আত্মবিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাসটা কিন্তু অনেক কিছু। এ রকম অজানা অনেক ভঙ্গুর হৃদয়ের সমারোহ এই শহর। মানুষ স্বপ্ন বীজ বুনে যায় প্রতিদিন, কিছু না থাক, তবু কারও বোঝা না হয়ে অনেকে বেঁচে আছে এ শহরে। তাই বিমানবন্দরগুলোতে ঘটে প্রতিদিনের অতিথি সংবর্ধনা, সে সব অতিথির চোখে থাকে নতুন স্বপ্ন। মানুষ স্বপ্নেই বাঁচে, তবে এ স্বপ্ন কোনো ক্লপ জগতের নয়, শ্রমের।