বাবার ডায়েরির পাতা থেকে

[বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কত যে না বলা গল্প ছড়িয়ে আছে তার কী কোন শেষ আছে? সর্বস্তরের সব পেশার বাঙালিরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের জড়িয়ে ছিলেন। ইয়াকুব শরীফও এর ব্যতিক্রম নন। ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালে ইয়াকুব শরীফ ছিলেন তৎকালীন রাঙামাটি জেলার প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট। বাংলার মানুষ যখন দেশকে রক্ষার জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তখন রাঙামাটি জেলার জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমামের নেতৃত্বে ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াকুব আলী, সদর মহকুমা প্রশাসক আবদুল আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদসহ আরও অনেকেই মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। আজকের লেখাটি মুক্তিযোদ্ধা ইয়াকুব শরীফের ডাইরির পাতা থেকে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার পাঠকদের জন্য তুলে এনেছেন তাঁর ছেলে শফিক শরীফ। চাকরিসূত্রে শফিক শরীফ বর্তমানে নিউইয়র্কে থাকেন। সন্দেহ নেই, ডায়েরির পাতায় লিখিত এই ঘটনার মাধ্যমে একাত্তর সালে রাঙামাটি জেলার পরিস্থিতি বোঝা যাবে।]

গল্প-১৪
তখন দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রকম খারাপের দিকে যাচ্ছিল। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরপরই ক্ষমতাসীন পশ্চিমা শাসকদের আসল চেহারা প্রকাশ হতে থাকে। সামরিক, কূটনৈতিক ও বিভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পশ্চিমারা উঠেপড়ে লেগে যায়। এ কারণে ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমতে শুরু করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান পশ্চিমাদের এই প্রহসনের নাটক খুব বেশি দিন পূর্ব বাংলার মানুষদের দেখতে হয়নি। শুরু হয় যুদ্ধ। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য এক মরণপণ যুদ্ধ। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী জনগণ পশ্চিমা শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হয়। লক্ষ শহীদের বিনিময়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মানচিত্রের দক্ষিণ-পশ্চিমের শান্ত সুনিবিড় জেলা সদর রাঙামাটি, আর থানা কাপ্তাই। বিভিন্ন কারণে এই জেলাটি ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রথমত, রাঙামাটি সীমান্তবর্তী জেলা এবং কাপ্তাইয়ে বাঁধ থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সারা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং এ দুটো অঞ্চল দখলে রাখা চাই। তা ছাড়া কাপ্তাই অঞ্চলে ছিল ভারতের বিহার অঞ্চল থেকে আগত অনেক বিহারিদের আবাসস্থল। এই বিহারিরা সরাসরি পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে বাঙালি হত্যায় নেমে পড়েছিল। অবশ্য এর ফলে বাঙালিরাও তার প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ফলে এলাকাটিতে নিত্যই বাঙালির সঙ্গে বিহারিদের দাঙ্গা হতো। সে সময় জেলা সদর রাঙামাটিকে রক্ষা করতে সেই অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা প্রশাসনের হাতে রাখতে চেষ্টা করে এবং মুক্তিকামী শোষিত বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সমর্থন জানায়। তাৎক্ষণিকভাবে রাঙামাটি অঞ্চলের উচ্চ প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। তৎকালীন সময়ে রাঙামাটি জেলার জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সৈয়দ আবদুস সামাদ, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াকুব শরীফ, সদর মহকুমা প্রশাসক (এসডিও) আবদুল আলী সরাসরি স্বাধীনতার পক্ষে অংশগ্রহণ করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে নতুন বিপ্লবী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধকে ত্বরান্বিত করতে সদর মহকুমা হাকিম আবদুল আলী রাঙামাটি সদর ও ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াকুব শরীফকে কাপ্তাই অঞ্চলের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। এ সময় এর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক এইচ টি ইমাম ও অতিরিক্ত প্রশাসক সামাদ। একপর্যায়ে কাপ্তাই অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে বিক্ষুব্ধ বাঙালির হাতে অনেক বিহারি মারা যায়। প্রত্যুত্তরে বিহারিরা অনেক বাঙালিকে হত্যা করে। বাঙালি ও বিহারিদের এই দাঙ্গা-হাঙ্গামার একপর্যায়ে বিহারিরা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াকুব শরীফের হাত থেকে বন্দুকের নলের মুখে অস্ত্রাগারের চাবি ছিনিয়ে নেয় এবং অস্ত্রাগার লুট করে। সে সময় পরিস্থিতি এমন অশান্ত হয় যে, ওই অঞ্চলে বাঙালি ও বিহারিদের মধ্যে বিবদমান দাঙ্গাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়।
কাপ্তাই এলাকায় সংঘটিত এই বিহারি-বাঙালির দাঙ্গা ধীরে ধীরে নিকটবর্তী শিল্পাঞ্চল চন্দ্রঘোনাতেও ছড়িয়ে পড়ে। কাপ্তাই থেকে মাইল দশেক দূরে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে চন্দ্রঘোনা এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম কাগজের কলে প্রচুর অবাঙালি শ্রমিক ও কর্মকর্তা কর্মরত ছিলেন। বলতে গেলে সে সময় চন্দ্রঘোনা কাগজের কল ছিল অবাঙালিদের দখলে। ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের পতন হলে তৎকালীন ইপিআর জোয়ান ও ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি জোয়ানরা চন্দ্রঘোনার কাছাকাছি এসে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধে প্রস্তুত হলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী কাপ্তাইয়ের দিকে ছুটে আসে এবং নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করতে থাকে। সে সময় কাপ্তাই চন্দ্রঘোনা অঞ্চলে বেশ কয়েকটি গণহত্যা সংঘটিত হয়। উপায়ন্তর না দেখে সংঘটিত মুক্তিবাহিনী পিছু হটে শহর ত্যাগ করে। আইন-শৃঙ্খলায় নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াকুব আলী কাপ্তাই ত্যাগ করে জেলা সদর রাঙামাটিতে ফিরে আসেন। পাকিস্তানি বাহিনী কাপ্তাই চন্দ্রঘোনায় ঢুকে পড়ে এবং একে একে সব স্থাপনা দখল করে গণহারে বাঙালি হত্যা শুরু করে। একই সময় অন্য আরেকটি পথে পাকিস্তানি বাহিনী রাঙামাটি শহরে ঢোকার মুখে বেতবুনিয়া উপগ্রহ স্টেশনের কাছে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখীন হয়। বেশ কয়েকবার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পর বিমান ও হেলিকপ্টারের সহায়তায় রাঙামাটি শহরে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মুহূর্তের মধ্যেই রাঙামাটি জনশূন্য হয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসকসহ স্বাধীনতার পক্ষের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই শহর ছেড়ে পাহাড়ি গ্রামে আশ্রয় নেন। জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত প্রশাসক সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যান।
এ সময় দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা মহকুমা হাকিম আবদুল আলী। তিনি যখন ভারত থেকে স্পিডবোটে চড়ে তাঁর বাড়িতে ফিরছিলেন, ঠিক তখনই তাঁর সামনে পাকিস্তানি বাহিনী এসে তাঁকে ঘিরে ধরে। পাকিস্তানি বাহিনী আবদুল আলীকে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং অমানুষিক অত্যাচার করে। বর্বর পাকিস্তানিরা তাঁর মুখ থেকে সেখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানার জন্য তাঁর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন শুরু করে। পশ্চিমের এই হায়েনারা প্রথমে তাঁর কান কেটে নেয়। তারপর জিভ ও ঠোঁট কেটে লাথি মেরে তাঁর সব দাঁত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দুদিন তাঁর লাশ পাকিস্তানি ক্যাম্পে রেখে দিলে লাশে পচন ধরে। পরে পাকিস্তানি সেনারা লাশটি বস্তাবন্দী করে কাপ্তাই হ্রদে ফেলে আসে। পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর সদস্যেরা এ খবর পেয়ে হ্রদ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে গোপনে রাঙামাটি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দাফন করে। আলীর দাফনের এ খবরটি এক সুইপারের কাছ থেকে জানা যায়। এই নির্মম ঘটনাটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এক চাকমা গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট শরীফ। পরিস্থিতি আঁচ করে সেখানে তিনি নিজেকে ও তাঁর পরিবারকে নিরাপদ নয় ভেবে পরিবারসহ কলকাতা যান এবং কলকাতার থিয়েটার রোডে অবস্থিত বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকারের যোগদান করেন। কলকাতা থেকে শুরু হয় ম্যাজিস্ট্রেট শরীফের দ্বিতীয় যুদ্ধ।
২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল আলীকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।