পিতা-পুত্রের সম্পর্ক হওয়া চাই এমন

শায়েরের বাবা ছিলেন একজন তুখোড় রাজনীতিবিদ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে উননব্বইয়ের স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন পর্যন্ত কখনো তিনি ঠায় বসে থাকেননি। প্রচণ্ড রকমের স্বাধীনচেতা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার দায়িত্ববোধ আজীবন জাগ্রত ছিল তাঁর সত্তায়। এক অসাধারণ নির্মোহ জীবনধারা ছিল তাঁর প্রাণশক্তি।
নিজের জীবনের অপ্রাপ্তি, আর দুঃখগুলোকে পুঁজি করে কারও কাছ থেকে সহানুভূতি পাওয়াটা একটা ব্যর্থতা। ব্যক্তি জীবনের অপ্রাপ্তি ও শূন্যতা তিনি কোনো দিন কাউকে বুঝতে দেননি। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো পদলোভ কখনো তাঁর ব্যক্তিত্বকে মলিন করতে পারেনি। শায়েরের বাবা বিশ্বাস করতেন পদাধিকার বলে আসীন হওয়া মানে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা গ্রহণ করা। স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণশক্তি পদাধিকারী বাধ্যবাধকতা থেকে সহস্র গুনে উত্তম ও কার্যকরী।
নিজ হৃদয়ের নির্মল আলো দিয়ে অগণিত জনকে ভালোবাসা যায়। নিজেকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারলে অগণিত হৃদয়ের বেদনাময় অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করা যায়। আর এমন মর্মস্পর্শী আবেদন ও মানবিক বোধ দিয়ে মানব হৃদয়ের সীমাহীন ভয় ও অন্ধ সংস্কারকে লাঘব করা যায়।
ভাষা আন্দোলনে রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা কোনো মিছিল-সমাবেশে নিজের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতন-নিপীড়নের গল্প উপস্থাপন করে কাউকে কখনো ভীত করেননি তিনি। তিনি নিজেও কখনো প্রতিশোধপরায়ণ আচরণ করেননি। সব সময় সবাইকে আশার বাণী শুনিয়েছেন। নিজেদের অর্জিত সফলতার গল্প দিয়ে নেতা-কর্মীদের মনে জুগিয়েছেন অনুপ্রেরণা। স্বাধিকার, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার নেশায় কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হয়ে চষে বেড়িয়েছেন লোকালয়। দিনবদলের স্বপ্ন দেখিয়েছেন মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে। গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। স্বাধীনতা পরবর্তী পুনর্বাসন ও দেশ পুনর্গঠনের কাজের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে পিছু পা হননি কখনো। ক্ষমতার লোভ ও পদ দখলের নেশা কখনোই তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে পারেনি।
রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর শায়েরের বাবা বেশির ভাগ সময় তাঁর পরিবারের সঙ্গেই কাটাতেন। তখনকার সময়ের প্রায় প্রতি দিনের নৈশভোজ শেষ হতো রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়
বিতর্কের মধ্য দিয়ে। প্রায় সব ধর্মপ্রচারকের জীবনাদর্শ, চীন-রাশিয়া-আমেরিকা থেকে শুরু করে ভারতবর্ষীয় রাজনৈতিক ইতিহাস, মোঘল কিংবা নবাবি যেকোনো আমলের সমাজ
ব্যবস্থা এবং সামাজিক শ্রেণিভেদ, এমনকি বিজ্ঞান কিংবা অর্থনীতি প্রায় সব বিষয়ে অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন তিনি।
খাবার টেবিলের বিতর্কে শায়ের বরাবরই তার বাবার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বাবার রাজনৈতিক আদর্শ ও জাগতিক জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করার প্রাণপণ চেষ্টা করত। শায়েরের এই বিপক্ষ অবস্থান ও বিতর্ক তার বাবা খুবই উপভোগ করতেন। বাবার সেই জ্ঞানগর্ভ যুক্তি উপস্থাপন ও প্রতি দিনের নিয়মিত বিজয় কখনো শায়েরকে ঈর্ষান্বিত করেনি। বরং প্রতিদিনের বিতর্ক থেকে পাওয়া শিক্ষার জন্য বাবার প্রতি বিশেষ এক কৃতজ্ঞতাবোধ নিয়েই সে ঘুমাতে যেত। এটি পিতা-পুত্রের সম্পর্ককে প্রতিনিয়ত ঘনিষ্ঠতর ও দায়িত্বশীল করেছে।
অবশ্য পিতা-পুত্রের সম্পর্কের এই ঘনিষ্ঠতার কৃতিত্ব মূলত শায়েরের বাবারই। কারণ শায়েরের বাবা তাঁর ছেলের যৌক্তিক বিরুদ্ধ অবস্থান কিংবা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জকে কখনোই বেয়াদবি বলে তিরস্কার করেননি। বরং বাস্তবিক জ্ঞানের যৌক্তিক ও সাবলীল উপস্থাপনের মাধ্যমেই বোঝানোর নিরন্তর চেষ্টা করতেন সব সময়।
শায়ের ও তার সহোদরেরা তাদের বাবার পরিচয় একজন সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে দিতে কখনোই কুণ্ঠাবোধ করে না। উপরন্তু অনেক গর্ব নিয়েই বলে, ‘আমাদের বাবা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। আমরা একজন রাজনীতিবিদের সন্তান।’ কারণ বর্তমান আমলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে শায়েরের বাবার নীতি ও আদর্শগত পার্থক্য বিস্তর।
শায়েরের বাবা ওপারে নিশ্চয়ই এখন অনেক ভালো আছেন। ওপারে ভালো থাকার কাজগুলো তিনি ইহকালে খুব দায়িত্বের সঙ্গেই করে গিয়েছেন।
ভিন্নধর্মী একটা স্মৃতির কথা বলে আজকের লেখাটার ইতি টানছি।
প্রসঙ্গটা ছিল একজন যুদ্ধাপরাধীকে নিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে
এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধী, মুসলিম লীগ নেতা ও শায়েরের বাবার সর্বকালীন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মারা গেলেন। অন্য সবার মতো শায়েরের বাবাও সেদিন সুরমা আতর লাগিয়ে জানাজার নামাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এই প্রস্তুতি দেখে শায়েরের চকিত প্রশ্ন তার বাবার কাছে, ‘বাবা, আপনি আজকে যার জানাজায় যাচ্ছেন, উনি তো যুদ্ধাপরাধী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। বরাবরই আপনাদের রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধিতা ও নৈতিক দ্বন্দ্ব লেগেই ছিল। আপনি কেন উনার জানাজায় যাচ্ছেন?’
শায়েরের বাবার সাবলীল উত্তরটা ছিল, ‘অবশ্যই ওনার সঙ্গে পার্থিব জীবনের নৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ আমার ছিল। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি কোনদিনই তাঁর ব্যক্তি জীবনের কোনো অমঙ্গল কামনা করিনি। আর মৃত মানুষের দোষত্রুটি ভুলে গিয়ে আল্লাহপাকের কাছে তাঁর মাগফিরাত কামনা করাটাও একটা মহৎ মানবিক গুণ। আমিও সেই মানবিক গুণটাকে আয়ত্তের চেষ্টা করছি। বিরোধিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো আজীবনই করেছি। এবার শেষ বিদায়ের সময় তাঁর পরপারের মঙ্গলের জন্য দোয়া করে আসি। দোয়া কবুলের মালিক আল্লাহ তালা। আল্লাহপাক যেন তাঁর ও আমাদের সবার ইহকালের সব ভুল ক্ষমা করে দেন...।’
পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা যদি এ রকমের হয়, তাহলে মনে হয় সামাজিক অবক্ষয় ও মানবিক মূল্যবোধের অভাবটা দূর করতে আর খুব বেশি কিছু আমাদের দরকার হবে না। ভালো থাকুক আমাদের সমাজ, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, ধর্মীয় আচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রতিটি পারিবারিক সম্পর্ক। আরও বেশি নিবিড় হোক প্রতিটি পিতা-পুত্র সম্পর্ক; উন্নত হোক মানবিক বোধ।