প্রথমে চাই মানুষ হওয়ার শিক্ষা

নিজ সন্তানদের কীভাবে ভালো ব্যবহার শেখাবেন, মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলবেন সেটা নিয়ে সবাই চিন্তা করেন। এসব বিষয়ে অনেক সময়ে অনেকেই জানেন না কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়। তাঁরা নিজ অভিজ্ঞতা থেকে শেখেন। আবার অনেকেই আশপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করে শেখেন। সেই জিজ্ঞাসা থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আবার কতটুকু সঠিক বা অঠিক তা না জেনেই হয়তো প্রয়োগ করেন আপনার প্রাণপ্রিয় সন্তানের সঙ্গে। বিষয়টাকে সহজ করে দিতে আপনাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস (পরামর্শ) তুলে ধরলাম। যার প্রতিটি টিপস নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শিশু বিষয়ক গবেষণা থেকে বা শিশু বিশেষজ্ঞদের থেকে।
১. কারও সঙ্গে দেখা হলে আপনার সন্তানকে তাঁর নাম বলতে দিন। এতে সে মিশুক হতে শিখবে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে।
২. যখন একটু বড় হবে তখন তাঁদের খাইয়ে না দিয়ে, কাপড় পরিয়ে না দিয়ে তাদেরকে নিজের কাজ করতে শেখান। এতে সে আত্মনির্ভরশীল হবে।
৩. শিশুদের আদেশ না দিয়ে তাঁর মতামত জানতে চান। উদাহরণ: ‘আমরা আগামীকাল খেলা দেখতে যাব, আমাদের সঙ্গে যেতে হবে’ - না বলে বলুন ‘আগামীকাল বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের খেলা দেখতে তোমার সাথের অনেক বাবুরা যাচ্ছে। সেখানে তাঁরা নাচবে, খেলবে, বেলুন ওড়াবে ও অনেক মজা করবে। তুমি যেতে চাও?’ এতে তারা যে শুধু আগ্রহী হবে তা নয়, কথা মানা তার অভ্যাসে পরিণত হবে।
৪. যেসব প্রশ্নে আপনার সন্তানরা লজ্জা পেতে পারে বা নিজেকে দোষী মনে করতে পারে, সেসব প্রশ্ন না করে অন্যভাবে পরামর্শ দিন। উদাহরণ: ‘তোমাকে ১ সপ্তাহের জন্য ১০০টাকা দিয়েছিলাম। এটা কী করেছ?’ এই প্রশ্ন না করে তাকে পরামর্শ দিন যে ‘আমি যদি তোমাকে প্রতি সপ্তাহে ১০০ টাকা দিই, তুমি প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় ১০টাকা দিয়ে চকলেট খেলে ১ সপ্তাহে তুমি ৩০টাকা জমা করতে পারবে; আর ১মাসে ১২০ টাকা’! এভাবে তুমি ১২০টাকা জমা করলে আমি তোমাকে আরও ১২০টাকা দিয়ে মোট ২৪০ টাকার একটা সুন্দর শার্ট (বা তাঁর কোনো প্রিয় জিনিস) উপহার দেব।’ এভাবে আপনার সন্তানরা যে শুধু উৎসাহিত হবে তা নয়, তারা জিনিসের সদ্ব্যবহার শিখবে, ছোট থেকেই সঞ্চয়ী হবে এবং জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছা শিখবে।
৫. কোনো কিছু বলার সময় তার কারণ বলার চেষ্টা করবেন। যেমন: ‘খেলনা গুছিয়ে রাখ’ না বলে বলুন ‘খেলনা ওইখানে রাখ যাতে পরের বার তুমি তাড়াতাড়ি খুঁজে পাও।’ ‘এখনই ঘুমাও’ না বলে বলুন ‘তুমি যদি এখন ঘুমাও তবে কাল তোমাকে সেখানে নিয়ে যাব’। একপর্যায়ে এটা তাঁর অভ্যাসে পরিণত হবে।
৬. নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে আদেশ বা পরামর্শ দেওয়ার আগে নিজে নিয়ম কানুন মানুন। উদাহরণ: ‘কাপড় গুছিয়ে আলনাতে রাখবে’ কথাটা বলার আগে চিন্তা করুন আপনি সব সময় তা করেন কী না। যদি না করেন, আগে নিজে করুন, অভ্যাস গড়ে তুলুন, পরে নিয়মকানুন মানতে শেখান। নতুবা, এটা কাজ করবে না।
৭. সমানভাবে নিষেধ করার আগে চিন্তা করুন তা আপনার বেলায়ও প্রযোজ্য। ‘কখনো সিগারেট খাবে না’ কথাটা বলার আগে নিজে সিগারেট খাওয়া ছাড়ুন। নতুবা, আপনার কথা শুনবে না।
৮. সিদ্ধান্ত নিতে শেখান। যেমন: কোনো অনুষ্ঠানে বা স্কুলে যাওয়ার সময় উপযুক্ত জামা আপনি নির্বাচন করে না দিয়ে কোন জামা পরে তাঁর যাওয়া উচিত তা জিজ্ঞাসা করুন। সঠিক জামা নির্বাচন করতে সহায়তা করুন।
৯. যখনই সে কিছু পারবে না, তাকে বারবার চেষ্টা করতে শেখান। আজ বারবার চেষ্টা করে না পারলেও আগামীকাল আবার চেষ্টা করান। এতে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
১০. কোনো কৌশলের কাজ নিজে করে না দিয়ে আপনার সন্তানকে প্রশ্ন করুন। উদাহরণ: ‘এই বাক্সটা কীভাবে খোলা যাবে?’ - এতে যে তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি বাড়বে তা নয়, সে প্রতিযোগী হতে শিখবে।
১১. অপেক্ষা করতে শেখান। উদাহরণ: আপনার সন্তান যদি এখনই খেতে চায়, খাবার প্রস্তুত থাকলেও তাকে বলুন, এই কাজটা করার পর খাবে। অন্তত ১০মিনিট পরে খাবার দিন। এতে যে শুধু অপেক্ষা করা শিখবে তা নয়, কোনো কিছু পেতে হলে যে আগে কিছু অর্জন করতে হয় তাতেও অভ্যস্ত হবে।
১২. তাঁর কষ্টের অনুভূতি তুলে ধরার চেষ্টা করুন এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রশংসা করুন। উদাহরণ: ‘আমি জানি তুমি কত শীত সহ্য করে গোসল করেছ। কিন্তু গোসল করার পর তোমাকে খুবই ফ্রেশ লাগছে। আজ সবার চেয়ে তোমাকে খুবই সুন্দর দেখাবে।’ এতে সে কঠিন কাজগুলো সহজে করতে পারবে।
১৩. অনুভূতি শেখান। কোনো গরিব মানুষকে ৫টাকা দান করে সঙ্গে সঙ্গেই আপনার সন্তানকে জিজ্ঞাসা করুন এটা দিয়ে সে কী করবে। এটা না পেলে তাঁর কী হতো। বুঝতে শেখান কত কষ্টে মানুষের দিন যাচ্ছে। এতে যে সে শুধুই অনুভূতি শিখবে তা নয়, হতাশা ও বিষণ্নতায় এটা তাঁকে খুবই সাহায্য করবে।
১৪. ‘ক্ষমা করবেন’, ‘ধন্যবাদ’ - এ ধরনের সাধারণ সৌজন্যবোধ অভ্যাসে পরিণত করান। তবে মনে রাখবেন, আপনাকেও তা করতে হবে।
১৫. অনেকেই মনে করেন আমি আমার সন্তানদের দিয়ে এটা করাব না, সেটা করাব না। অবসর সময়ে আপনার সন্তানকে আপনার কাজে (যেমন: কাপড় ধোয়া) নিয়োজিত করুন। এতে ‘সবাই মিলে যে পরিবারে একসঙ্গে কাজ করতে হয়’ তা শিখবে।
১৬. আপনার সন্তান যতই খারাপ ব্যবহার/আচরণ করুক না কেন, তাঁর এমন কিছু করবেন না যাতে আপনি আপনার সন্তানকে খারাপ পান। মনে রাখবেন, আপনার সন্তানকে আপনি খারাপ পেলে এই পৃথিবীতে কেউ তাঁকে ভালোভাবে দেখতে পারবে না। - জর্ডান বি. পিটারসন
১৭. সমস্যা তৈরি হবে ভেবে তাঁর বিজয়ী হওয়া শেখার পথ বন্ধ করবেন না। উদাহরণ: মার কাছে না-বলা কথাগুলো (https://www.prothomalo.com/ northamerica/article/1561929/মার-কাছে-না-বলা-কথাগুলো)।
১৮. নিজের ব্যস্ততা কমাতে পারলে যতটুকু সম্ভব আপনার সন্তানকে যথেষ্ট সময় দিন। নতুবা মা-বাবা ও সন্তানের উপযুক্ত বন্ধন তৈরি হবে না।
১৯. সাময়িক ঘ্যানঘ্যান থেকে মুক্তি পেতে আপনার সন্তানের জন্য খারাপ এমন কিছু করবেন না। যেমন: মোবাইল ফোন হাতে দেওয়া।
২০. যখনই সম্ভব প্রশংসা করুন। এটি আপনার সন্তানের সদ্ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে ভালো টিপস।
২১. যখনই কোনো খারাপ আচরণের জন্য শাস্তি দিতে হবে প্রথমে প্রশংসা করুন। তারপর বুঝিয়ে বলুন এটা তাঁর শাস্তি নয়, এটা তার খারাপ কাজটার শাস্তি। নিশ্চিত করুন, সে বুঝেছে যে সে খুবই ভালো, কিন্তু সে যে কাজটা করেছে সেটা খারাপ। তখন শাস্তি দিন। শাস্তি দেওয়ার পরপরই আদর করুন বা কোথাও নিয়ে ঘুরে এসে/কিছু কিনে দিয়ে তাকে ইজি (সহজ) করার চেষ্টা করুন। এতে তাঁর খারাপ আচরণের সম্ভাবনা অনেক কমবে। এটা সময় সাপেক্ষ। ধৈর্য ধরে এ পদ্ধতির পুনরাবৃত্তি করুন।
২২. আপনার সন্তানের প্রতিটি কাজকে গুরুত্ব দিন এবং তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন
২৩. ছোট-বড়, ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে সবার সঙ্গে খেলতে শেখান।
২৪. নিজে সবাইকে সম্মান করুন এবং আপনার সন্তানকে সম্মান করতে শেখান।
২৫. ভালো রেজাল্ট/জিপিএ বা ভালো চাকরি নয়, ভালো মানুষ হতে উৎসাহিত করুন।