অনলাইন সম্পর্কের জাল এবং প্রকৃত সম্পর্কের হাল

সামাজিক সম্পর্ক চর্চার বিষয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা সেই সম্পর্কগুলোর সংজ্ঞা এখন ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে চর্চার ধরন ও অগ্রাধিকার। আজকাল আমরা ভার্চুয়াল সম্পর্ক আর প্রকৃত সম্পর্কের মধ্যে আর পার্থক্য করতে পারি না। আমরা অনলাইন সম্পর্কের অচেনা মানুষের সুখ-দুঃখ স্ক্রিনে ভাগাভাগি করে নিই, অথচ অনেক রক্তের সম্পর্কের মানুষ নীরব অশ্রুপাত করে যাদের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছায় না। তাঁরা ইন্টারনেটে সংযুক্ত নন- তার মানে তাঁরা যোগাযোগ-অযোগ্য! অত্যধিক প্রযুক্তি নির্ভরতা আমাদের বোধকে অন্য মাত্রার অসারতা দিয়েছে। আমাদের সম্পর্ক যোগাযোগ এখন তালিকা ধরে ধরে হয়। যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের সম্পর্কের যে তালিকা তাতে অন্তর্ভুক্ত থাকা সম্পর্ক রক্ষার পূর্বশর্ত। অনলাইনে কারও দুঃখ দেখে কেঁদে বুক ভাসানোর ইমোজি দিই, অথচ নিকটাত্মীয়দের সুখ, দুঃখ, সংকট, সংগ্রাম, এমনকি জন্ম, মৃত্যুও যেন আর আগের মতো আমাদের স্পর্শ করে না।
আগে আমরা সম্পর্কের গভীরতার ভিত্তিতে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। কখনো নৌকায়, বাসে বা ট্রেনে চড়ে, আবার কখনো মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে আত্মীয়দের বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। এখন নিয়ম উল্টো। যোগাযোগ মাধ্যমে, ফেসবুকে সংযুক্ত থাকার ওপর নির্ভর করে তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে কী থাকবে না- সম্পর্কের নাম যা-ই হোক। তিন ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে অসুস্থ আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার চেয়ে ঘরে বসে তিন ঘণ্টা অনলাইন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডাবাজি করে সময় কাটাই। এখন প্রযুক্তি ও এলগরিদম আপনার অজান্তে আপনাকে প্ররোচিত করে ঠিক করে দিচ্ছে আপনি কার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, কে যোগাযোগের যোগ্য।
প্রযুক্তি আবেগের ধার ধারে না, উচিত-অনুচিত বোঝে না, সে বোঝে তার মনিবের ব্যবসায়িক মুনাফা। প্রযুক্তির ক্রীড়নক হয়ে পনেরো হাজার মাইল দূরের ফেসবুক ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমরা ২৪ ঘণ্টা সংযুক্ত থাকি, তার সঙ্গে দিনে পাঁচবার আলাপ-মতবিনিময় হয়। অথচ হয়তো পনেরো মাইল দূরে বসবাসরত কোনো এক ঘনিষ্ঠ বৃদ্ধ আত্মীয়ের সঙ্গে পাঁচ বছর যাবৎ যোগাযোগ রাখি না। কারণ তিনি আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে নেই। এভাবেই সম্পর্কের গ্লোবালাইজেশন হয়েছে, অথচ লোকাল সম্পর্কগুলো হুমকির মুখে পড়ছে।
কয়েক দশক আগেও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ট্র্যাডিশনাল দায়-দায়িত্ববোধ, ত্যাগ, সম্পর্কের আদান-প্রদান, সহযোগিতার জায়গাগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত মজবুত। এর দ্বারা সম্পর্কগুলো সজীব থাকত। কিন্তু এখন সম্পর্ক চর্চার ক্ষেত্রে ‘দায়-দায়িত্ববোধ’ আর মোটেও মুখ্য বিবেচ্য নয়। আমরা এখন আগে দেখি কোন সম্পর্কটি সহজ, ঝামেলামুক্ত, সুবিধাজনক ও আনন্দদায়ী। অতীতেও আমাদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথা নাগরিক জীবনে ব্যস্ততা, জটিলতা এবং নগর জীবনের জ্যাম, ঝুঁকি, সংকট, নানাবিধ অভাব-অভিযোগ সবই ছিল। কিন্তু এখন প্রযুক্তি আমাদের আঙুল সমান দূরত্বে এসে যাওয়ায় কিংবা আমরাই প্রযুক্তির দাসে পরিণত হওয়ায় বাস্তব সম্পর্কগুলো থেকে দূরে সরে গিয়ে আমরা ভার্চুয়াল সম্পর্কের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছি।
অনেকের মতে এটিই আমাদের ডিজিটাল হওয়ার প্রমাণ, আধুনিক হওয়ার প্রমাণ। আমরা নাকি উন্নত হচ্ছি। আমরা নাকি আরও অনেক উন্নত হব। উন্নত হতে হতে প্রযুক্তিতে উন্নত দেশের সমকক্ষ হব। যেমন: জাপান। অথচ সেখানে এখন কান্না শিক্ষার জন্য কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ অনেকের মস্তিষ্ক মানবীয় আবেগ-অনুভূতিগুলোর বোধগুলো ভুলে গেছে। ব্যস্ততা ও জীবনচর্চার বাস্তবতা মেনে তাদের সামাজিক সম্পর্কের ধরনে যে পরিবর্তন এসেছে তাতে মানবীয় আবেগ অনুভূতি চর্চারই প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে মানুষের জীবনদর্শন ও ফোকাসে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ব্যস্ত মানুষ প্রেম-ভালোবাসার জন্য সঙ্গী খুঁজে নিচ্ছে সিলিকনের পুতুলে। এ শিল্প এখন অনেক দেশের জিডিপির সমান।
আগে সেবা কিংবা সহযোগিতার জন্য আমরা প্রতিবেশীকে ডাকতাম। বন্যার্তদের সাহায্য করতাম। যেখানে সেখান রক্তদান কর্মসূচি এলেই রক্ত দিতে শুয়ে পড়তাম। এমন হয়েছে আমি সকালে আধপেটা খেয়ে পিজি হাসপাতালে গিয়ে ক্যানসার রোগীকে রক্ত দিয়ে এসেছি- অথচ বিকেলে আমার সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। মানুষ ফেসবুকে ছবি পোস্ট না করেই সানন্দে সহযোগিতার হাত বাড়াতো। এখন ছবির অনেক দাম। ফেসবুকে শ’ দেড়েক লাইক বেশি পাওয়ার আশায় বিয়ে-সাদীতে নাকি লাখ দেড়েক টাকার আড়ম্বর বেশি হয়। শুনেছি কেউ কেউ কবর খোঁড়া বা লাশ নামাতে আসে কেবল তার ছবি ফেসবুকে আপলোড করতে, দুঃখী-দুঃখী ইমোজিসহ স্ট্যাটাস দেওয়ার লোভে। এখন সবকিছুই প্রদর্শনমূলক, প্রদর্শননির্ভর।
মন্দের চেয়ে প্রযুক্তির ভালোর ভাগই বেশি। মানুষ এখন অনেক বেশি অবগত, অবহিত। অনেক তথ্য ও জ্ঞান আমাদের হাতের নাগালে চলে এসেছে। তবে এখন অবাধ মতপ্রকাশ ও ডিজিটাল গুজবের যুগ। ইন্টারনেটের কল্যাণে সত্য আর গুজব সমান জায়গা পায়, এক দরে বিক্রি হয়। যদিও পাল্লা দিয়ে গুজবও বাড়ছে, যে কেউ চাইলে তা যাচাইও করে নিতে পারেন। এ কারণেই, অনেকে যদিও বলেন সংবাদপত্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে- কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমি মনে করি সত্যনিষ্ঠতা ও নির্ভরযোগ্যতার স্বার্থে মানুষ সংবাদপত্রগুলোকে টিকিয়ে রাখবে। পত্রিকার মূল আয় ছিল বিজ্ঞাপন। বড় করপোরেটগুলো এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে ইমেইল, ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে আরও আগে মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারছে। সে ক্ষেত্রে পত্রিকার আয়ের উৎসগুলো শুধু বদলে যাবে। তবে সেটি ভিন্ন আলোচনা।
এলাকার মুরুব্বি, মাতব্বর, গ্রাম পঞ্চায়েতের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে তার জায়গায় এসেছে রাষ্ট্রীয় আচার-বিচার ব্যবস্থা, পুলিশ। কিন্তু এখন এক ভিন্ন ধারার সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। থানা কেস নেবে কি নেবে না সেটা নির্ধারিত হওয়ার আগেই ফেসবুকে মামলা দায়ের হয়ে যায়- অভিযোগ পৌঁছে যায় জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে। হাজারো মানুষ সেখানে বিচারে বসে যায়, পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দেয়, গালি-গালাজ-খিস্তি করে রায় দেয়। এতে রাগ প্রশমিত হয়। আমাদের ভেতর নিজেকে সচেতন প্রমাণের যে সুড়সুড়ি তাতে আরাম হয়। এই ভার্চুয়াল আদালতের শক্তি অনস্বীকার্য। এর চাপে দেশে দেশে সরকার পতন ঘটেছে, এর প্রভাবে রাষ্ট্রীয় আদালতেরও রায় পরিবর্তন হয়েছে- যার নজির আমরা দেখেছি। যার এত শক্তি তার প্রভাবে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তো পরিবর্তন হবেই।
আগে বয়স, সম্পর্ক ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রয়োগ হতো। গুরুজনের প্রতি প্রদর্শিত হতো এক ধরনের আদব, শিষ্টাচার। সমবয়সী বা ছোটদের জন্য ছিল ভিন্ন বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, ভাষা। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে সবাই এক জায়গায় বসে আড্ডা দেয়, সব আলাপ সবাই শেয়ার করে, কোনো দেয়াল নেই। সব বয়স, সব সম্পর্ক এখন এক সমতলে এসে গেছে। ইন্টারনেটের যোগাযোগ মাধ্যমের চোখে আপনার বন্ধু-তালিকার সবাই দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ও ওজনে সমান। এখন আমরাও সেভাবেই দেখতে শিখে গেছি।
প্রযুক্তি, যন্ত্র ইত্যাদি অবশ্যই উপকারী। আমাদের জীবন এখন অনেক স্বাচ্ছন্দ্যময়। তবে হালের গরু যতক্ষণ জোয়ালের সঙ্গে বাঁধা থাকে ততক্ষণই সুফল পাওয়া যায়। কৃষক তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলে হিতে-বিপরীত হতে বাধ্য। এ কারণেই, প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে কি-না, আমাদের চিন্তার স্বাধীনতাকে নির্ভরশীলতা দ্বারা ধীরে ধীরে বাধাগ্রস্ত ও খর্ব করছে কী-না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। ফেসবুকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে সহযোগিতা করার অভিযোগ উঠেছিল। একে নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠেছিল। এটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। কিন্তু তা যদি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনার প্রবাহকে সত্যি ক্রমশ দখল করে নেয় তবে ভবিষ্যতে ঘোর সংকট অবশ্যম্ভাবী। সেটি খতিয়ে দেখার, বা তাকে ঠেকাতে যে বিপুল ঐকমত্য প্রয়োজন, দক্ষ নেতৃত্ব প্রয়োজন তা এখনো নেই- তা হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
এখন মানুষে মানুষে দূরত্ব ঘুচে গেছে। পৃথিবীর এক প্রান্তের ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রান্তের কাউকে তাৎক্ষণিক স্পর্শ করছে। এটি প্রযুক্তির বিশাল অবদান। কিন্তু এই ভার্চুয়াল নৈকট্যের পাশাপাশি প্রকৃত দূরত্ব বেড়েছে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের সাহায্যে আমরা মানবীয় সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠি। কিন্তু যন্ত্রের আবেগ থাকে না, যন্ত্রকে অন্যে পরিচালিত করে, সে বাইনারি অন-অফ সিস্টেমে চলে। আমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যন্ত্রের সেই বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে কি-না, আমরা একেকজন একেকটি যন্ত্রের মতো আচরণ করছি কি-না সেটিও দেখার সময় এসেছে। সমাজে এখন অস্থিরতা বেড়েছে, অপ্রচলিত নানাবিধ অপরাধ দেখা যাচ্ছে। শহরে যেমন বাড়ছে যানজট, আদালতে বাড়ছে মামলা জট। এ জন্য অচিরেই আরও আদালত ভবন, আরও জেলখানা নির্মাণ করতে হবে। (মামলা জট কমানোকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে- আইনমন্ত্রী, সূত্র: মানবজমিন, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। অথচ, আমরা যদি সচেতন হয়ে প্রচলিত ঐতিহ্যবাহী সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি সক্রিয় করি, সামাজিক সম্পর্কগুলোকে ফিরিয়ে আনি, চর্চা করি তাহলে সামাজিক উত্তেজনা প্রশমিত হবে, অস্থিরতা কমবে, বিরোধ মীমাংসিত হবে, শান্তি বাড়বে, সরকারি ব্যয়ও কমবে।