আল মাহমুদ ধ্বনির জাদুকর

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শুক্রবার রাতে, তিনি শেষ ট্রেন ধরে চলে গেছেন এমন এক স্টেশনে যেখান থেকে সশরীরে আর ফিরে আসবেন না। কিন্তু তাঁর কবিতা, তাঁর গদ্যসাহিত্য বারবারই বাঙালি পাঠকের কাছে ফিরে ফিরে আসবে। কারণ আল মাহমুদকে বাদ দিয়ে যে বাংলা সাহিত্য অসম্পূর্ণ, অপূর্ণাঙ্গ।

মাঝে মাঝে প্রবাসের অখণ্ড অবসরে যখন ভালো কিছু খুঁজি পড়ার জন্য, সবকিছু আড়াল করে আমার দৃষ্টির সামনে একটি শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখ উদ্ভাসিত হয়, যার রচনা শুধু পাঠ নয়, অধ্যয়ন করব বলে আমি প্রতিজ্ঞ, তিনি কবি আল মাহমুদ। ২০০৮ সালের কথা। এপ্রিলে মাসখানেকের ছুটিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখন তিনি আমার হাতে তুলে দেন একটি বেশ স্বাস্থ্যবতী গ্রন্থ, যার প্রচ্ছদে লেখা ‘শ্রেষ্ঠ আল মাহমুদ’।

সেই সময়টাতে আমি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষাভাষী তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে উদ্দীপ্ত ও ক্ষিপ্ত কবি-লেখকদের সঙ্গে সওয়াল-জওয়াবে লিপ্ত হতাম। সাম্প্রতিক কাব্যভাবনা নিয়ে তখনকার প্রখ্যাত তরুণ কবি-লেখকদের ভাবনা-চিন্তাপ্রসূত মতামতের সঙ্গে আমার বাহাস হতো। এর সবকিছুই সম্ভব হতো ইন্টারনেট ও ই-মেইলের কল্যাণে। আমি দূরত্বটা মাপার চেষ্টা করতাম। আল মাহমুদ থেকে আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, দূরত্বটা কতখানি, তা নির্ণয় করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। কিন্তু কঠিন হচ্ছে গ্রহণ-বর্জনের হিসেব মেলানো। আমি অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না, সাহিত্যে গ্রহণ-বর্জনের তেমন একটা অবকাশ রয়েছে। প্রবহমান সময়ের সিঁড়িপথ নির্মিত হয় গৃহীত-বর্জিত সবকিছু দিয়েই।

বাংলা সাহিত্যের চারপাশে উটপাখির ডিমের মতো যে কঠিন ও বিশাল বলয় নির্মাণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ত্রিশের কবিরা তা ভেঙেছিলেন মাত্র। সুখপাঠ্য আধুনিক সাহিত্য রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাকে ম্যাচিউরিটি দেবার জন্য আমরা সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে, এ কথা অনস্বীকার্য। আর বাংলা কবিতাকে রবীন্দ্র-বলয়ের ঘূর্ণাবর্ত থেকে টেনে বের করে এনে একটি উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য আমরা অবশ্যই কৃতজ্ঞ ত্রিশের মেধাবী পুরুষ বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও জীবনানন্দ দাশের কাছে। কিন্তু সেই খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা নগ্ন সুন্দরীকে আবরণ ও আভরণে সাজিয়েছেন পঞ্চাশের কবিরাই। কবি আল মাহমুদ তাঁদেরই এক উজ্জ্বল প্রতিনিধি। এরই ধারাবাহিকতা চলছিল আশির দশক অবধি, নব্বইয়ের কবিদের কাছে যা একঘেয়ে এবং পানশে ঠেকে। ফলে নব্বইয়ের টগবগে তরুণেরা তখন বাংলা কবিতার খোল-নলচে পালটে ফেলতে চাইত। ত্রিশের দশক থেকে আশির দশক অবধি বিস্তৃত বাংলা কবিতার চারপাশে তারা দেখতে পাচ্ছিল আরও একটি উটপাখির ডিম। সেই ডিমে তা দিয়ে ডিম ফাটিয়ে নব্বইয়ের কবিরা উটপাখির বাচ্চাকে বের করে এনে মরুভূমিতে দৌড় শেখাতে শুরু করে। তারা সেই উটপাখির গায়ে অলৌকিক পালক লাগিয়ে তাকে ওড়াতে চাইছিল মহাশূন্যে। তখন পশ্চিমবঙ্গের এক তরুণ কবি সব্যসাচী স্যান্যাল, আমারই একটি কবিতার ওপর আলোচনা করতে গিয়ে রবার্ট ফ্রস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, কোনো কিছু না বুঝেই যা ভালো লাগে, তা-ই কবিতা। অর্থাৎ কবিতায় বোঝাবুঝির কিছু নেই। আমি তাঁর বক্তব্যের সাথে একটুও দ্বিমত পোষণ না করে বলেছিলাম, বোঝার পরে যা আরও একবার ভালো লাগে, সেটাই কালোত্তীর্ণ কবিতা। পাঠক তা দীর্ঘদিন মনে রাখেন। কবি আল মাহমুদ সেই কালোত্তীর্ণ কবিতার সৌধ রচনাকারীদেরই একজন। তিনি প্রমাণ করেছেন কবিতা হচ্ছে চমক ও বুদ্ধিবৃত্তি—এ দুয়েরই সমন্বয়। যে কবিতায় বক্তব্য, দর্শন, রহস্য সবই আছে কিন্তু সুখপাঠ্য নয়, সে কবিতার আবেদন যেমন সীমিত, তেমনি যে কবিতা সুখপাঠ্য কিন্তু লক্ষহীন, সে কবিতা দীর্ঘদিন কেউ মনে রাখে না। আল মাহমুদ নিজেও বলেছেন, ‘আমি সুন্দর কিছু দেখলে এটাকে সুন্দর বলে স্বীকার করি। কিন্তু আমি এর ভেতরটাও দেখতে চাই।.নৈঃশব্দ্যেরওরও একটা শব্দ আছে, একটা বিষয় আছে।’ এরপর তিনি আরও গূঢ় রহস্যের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, ‘এখন সেখানে পৌঁছতে চাই যেখানে আর কোনো শব্দ নেই।’ [আমি, আমার সময় এবং আমার কবিতা: কবির সৃজন বেদনা, পৃষ্ঠা ৪২]।
দীর্ঘ সত্তর বছর ধরে নিরলসভাবে কাব্যচর্চাকালে কবি আল মাহমুদকে আমরা কখনোই একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা আঙ্গিকে স্থির থাকতে দেখিনি। একই গুণ বর্তেছিল কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যেও। এই অস্থিরতা সৃজনশীলতার তীব্র তাড়নারই বহিঃপ্রকাশ। অনেকেই কবির এই অস্থিরতাকে স্খলন বললেও কবি আল মাহমুদ তা কবিসুলভ স্বাভাবিকতায় বারবারই হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। কবি আল মাহমুদকে খুব কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এমনও সময় গেছে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাই আমরা একসঙ্গে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছি। একদিন আমিও তাঁর মুখোমুখি বসে এই ‘স্খলন’ প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম। তিনি বেশ কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর বললেন, ‘আমি কখনোই অবিশ্বাসী ছিলাম না’। কিন্তু কবির ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’ কিংবা ‘সোনালী কাবিন’ পড়ে আমরা তাঁর মধ্যে কিছুটা দ্বিধা, সংশয় দেখতে পাই বৈকি। পরিণত বয়সে এসে সেই দ্বিধার কুয়াশা কেটে যাওয়াটাও খুবই স্বাভাবিক।
‘আমাকে দুঃখের চেয়ে নতুন কোনো দাহ কেউ
দিতে পারে নি।
আমাকে শোকের চেয়ে সত্য কেউ
বোঝাতে পারলো না। আর
কষ্টের চেয়ে কঠোর স্পর্শ কোনোদিন
ছোঁবে না আমাকে।
হে মোহান্ত, তেমন কোনো শব্দ জানো কি
যার উচ্চারণকে মন্ত্র বলা যায়?
হে মোয়াজ্জিন, তোমার আহ্বানকে
কী করে আজান বলো, যা এতো নির্দিষ্ট
আর হে নাস্তিক
তোমার উচ্চকণ্ঠ উল্লাসকে কোন শর্তে আনন্দ বলো
যা এতো দ্বিধান্বিত
তাই আমি নাস্তিক নই
বিশ্বাসী নই’
(পিপাসার মুখ, কবিতাসমগ্র, পৃ. ৩৮)
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঘড়িতে পেন্ডুলাম হয়ে দুলতে দুলতে তিনি কিন্তু দৃঢ়তার সাথে একটি ঘণ্টাই বাজিয়ে জগৎবাসীকে শুনিয়েছেন, একটি ঘোষণাই বারবার দিয়েছেন, ‘আমি সেই ধ্বনির জাদুকর’। অর্থাৎ তিনি কবি। সেই যে রাবারের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে গোলাপ ফুল আঁকা টিনের বাক্স বগলে নিয়ে ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে এসে নেমেছিলেন ‘বাওনবাইড়া’র গেঁয়ো কবি আল মাহমুদ ১৯৫৫ সালে, যিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন আমি কবি হতেই ঢাকায় এসেছি, গত সাড়ে ছয় দশক ধরে সমস্ত সংশয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কোন্দল, সমস্ত বিতর্ক ছাপিয়ে আমরা একজন পূর্ণাঙ্গ কবিকেই আবিষ্কার করেছি তাঁর সমস্ত কর্মের মধ্য দিয়ে। তাঁর জীবনাচার একজন কবির জীবনাচার, তাঁর গদ্য একজন কবির গদ্য, তাঁর ভ্রমণ একজন কবিরই ভ্রমণ। ‘পিপাসার মুখ’ কবিতাটি রচনার অল্প কিছুকালের মধ্যেই এই দোদুল্যমানতা কেটে গিয়ে অদৃষ্টে আত্মসমর্পণ করলেও তা তাঁর কবিসত্তাকে এতটুকুও ম্লান করতে পারেনি। একেশ্বরবাদ ক্রমশ তাঁর কবিতার আত্মায় স্থান করে নিলেও কবিতা তখনো ঋজু এবং তা শুধু কবিতাই, অন্য কিছু নয়।