অচিনপাখী

নীলার মনটা আজ খুব ভালো। নীলার ছেলে খুব ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল স্কলারশিপসহ ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। আজ ফুরফুরে মেজাজে আছে নীলা। রান্না খাওয়ার পালা নাই। সবাই চলে গেল বাইরে। সবাই ব্যস্ত।
শুধু নীলার অবসর। নীলা একটা সিডি ছাড়ল কবিতা আবৃত্তির। আর হু হু করে মন ছুটে গেল জীবনানন্দের রূপসী বাংলায়। বরিশালের কীর্তনখোলা নদী। একদিন হিজল তমালের ছায়ায় নিবিড় নিটোল নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসেছিল নীলা। পাশে ছিল যে যুবক সে যুবকের হাতে ছিল বাঁশের বাঁশি। চারদিকে বেতের ঘন গহিন ঝোঁপ। টুপটাপ ঝরছিল পাতা আর ফল। পায়ের আলতা ধুয়ে গিয়েছিল নদীর জলে। বেতস লতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠছিল তনু মন। বাঁশির সুরে কী এক আকুলী বিকুলী। জগৎ সংসার ভুলে দুজন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। নিঝুম দুপুরে ঘুঘুর ডাকটা কান্নার মতো শুনাচ্ছিলো। ঘুঘু কী তার সঙ্গীকে হারিয়ে ফেলেছে। শাপলা শালুক ছড়িয়ে আছে বিলের আরেকদিকে। ঢেউয়ে দুলছে নৌকা।
কলেজে পড়তে গিয়ে প্রথম পরিচয় হয়েছিল যার সঙ্গে তার নাম রবি। হ্যাঁ রবীন্দ্রনাথ সরকার। মা–বাবা মনে হয় চেয়ে ছিলেন সে মস্ত কবি হোক। কবির শিরোপা আর নোবেল জয়ীর শিরোপা দুটোই তার মাথায় যুক্ত হোক। নীলার সঙ্গে পরিচয় হলো। কবিতা লেখাও শুরু হলো। কলেজের করিডর প্রথম কাব্য। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করল স্বরচিত কবিতা।
নীলা অপরূপ সুন্দরী। লাক্স সুন্দরী না হলেও শহর কাঁপানো সুন্দরী সে। কবির কবিতা বুক কাঁপায় না এত কঠিন সে হতে পারে না। নীলার বুকের গভীরে স্থান করে নেয় রবি। নীলা কলেজ পালিয়ে কখনো নদীতে নৌকাবিহারে যায়। বাঁশি বাজিয়ে উথালপাতাল করে দেয় নীলার হৃদয় । নীলকণ্ঠ পাখি আর ডাহুকের সঙ্গে পদ্মবিল আর পানকৌড়ির ঝিল ঘুরে বেড়ায় দুজনে।
ভালোবাসা সেতো এক সুরভিত রুমাল। ধর্ম বর্ণ কোনো বাঁধা মানে না। নীলার বাবা শফিকুর রহমানের পাথর হৃদয়। হাকিম নড়ে তবু হুকুম নড়ে না। দুনিয়া উল্টে গেলেও নীলা
কোনো দিনও রবির হবে না।
সেদিনও খুব গরম পড়েছিল। দুপুরবেলায় ডাকপিয়ন চিঠি দিয়ে গেল। রবি চিঠি লিখেছে প্রায় পনেরো পৃষ্ঠা। পাতায় পাতায় নীলার রূপের গুণগান। কবিতায় নীলার কপোলের তিল। নীলার দিঘল কেশ। নীলার আলতা পরা পা। নীলার চিবুক। নীলার উষ্ণতা। নীলা এক দামি পাথর। যার আগাগোড়া রাশিফলের মৌন চেতনায় বিরাজ করে। যাকে অনামিকায় ধারণ করা যায় কৌলীন্য বজায় রেখে। কিন্তু আটপৌরে ভাবে যেখানে সেখানে ফেলে রাখা যায় না। নীলাকে ভালোবাসা যায়। কিন্তু ভালোবেসে আপণ করা যায় না। নীলা নীলা নীলা। এত ভালোবাসা দিলে কিন্তু ধর্মের এই সীমারেখা কেন টেনে দিলে বলো?
আচমকাই বুকের ভেতর দাবানল দাউ দাউ করে ওঠে। রবির মায়ের আহাজারি আজও কানে ভেসে আসে। সেই মধ্য দুপুরে সারা পাড়া যখন অলস বসে আছে। ঝিম ধরা
সময়। বাতাসে নরম সুপারির ফুল আর নীমফুলের ঘ্রাণ।
-খোকা ভাত খেতে আয় বলতে গিয়ে মা দেখেন নীল বর্ণ ধারণ করেছে ছেলে তার। নেতিয়ে পড়া শরীর। মুখ বেয়ে ঝরছে ফেনা।
সেই অলস দুপুরে পুরা পাড়ার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল একটি আর্ত চিৎকারে। নীলার আলতা পরা পায়ের একটি নূপুর ছিটকে পড়েছিল রাস্তায়। আজও বিবশ হয়ে যায় নীলা। শুধু বুকের ভেতর তির তির করে কাঁপে একটি অচিনপাখী।