একাত্তরের নয় মাস ও আমার স্মৃতি

[যুদ্ধ মানেই বিভীষিকা, যুদ্ধ মানেই মানবতার পতন। যুদ্ধ কখনোই কোনো দেশের জন্য কাম্য হতে পারে না। যখন একটি দেশে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন সে দেশের স্বাভাবিক নাগরিক জীবন লন্ডভন্ড ভণ্ড হয়ে যায়। মানুষের স্বপ্ন নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তখন শুধু একটাই আর্তি, বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে বাঁচার সেই আর্তি নিয়ে সাধারণ মানুষ তখন খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে চায়। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সৈয়দা সালমা আহমেদ ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী। তাঁর স্বামী সৈয়দ একরাম উদ্দীন আহমেদ ছিলেন সরকারি চাকুরে। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ২৫ মার্চ সেই কালরাত্রি থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধের পুরো নয় মাস আপনার কেমন কেটেছিল? কেমন ছিল সেই বিভীষিকাময় জীবন? সেই অভিজ্ঞতার কথা বলছেন সৈয়দা সালমা আহমেদ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।]

১৯৭১ সাল। আমরা তখন থাকি মালিবাগের ভাড়া একটি বাসায়। ঢাকার অবস্থা তখন থমথমে। সবার কপালে তখন চিন্তার ছাপ। কি জানি কী হয়! বিশেষ করে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই দেশে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সবার চোখে মুখে আতঙ্ক! আমার স্বামী তখন সরকারি চাকুরে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে তিনিও খুব একটা কথা বলতেন না। শুধু বলতেন, অবস্থা ভালো নয়। আমাদের সনি ব্র্যান্ডের লাল রঙের একটা ছোট্ট রেডিও ছিল। সেটির নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবর শুনতেন আর আমাকে বলতেন, সাবধানে থাকতে হবে। কিন্তু জীবন আর স্বাভাবিক থাকল না। ২৫ মার্চ রাত ১১টা বা সাড়ে ১১টার দিকে আমরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। শুয়ে শুয়ে আমরা দেশের কথাই আলাপ করছিলাম। যদি কিছু একটা হয়ে যায়, তখন কী হবে! আমি আমার স্বামীকে বললাম, মার্চ মাস শেষ প্রায়। যদি সম্ভব হয় অফিসের বেতনটা উঠিয়ে রাখ। কখন যে কী হয়ে যায়, বলাতো যায় না। কঠিন এই সময়ে হাতে টাকা থাকা খুব জরুরি। ঠিক এমন সময় বাড়ির বাইরে গগন বিদারী শব্দ। কিসের শব্দ! বুঝতে পারছিলাম, গোলাগুলির বিকট শব্দ। আমাদের বাসা রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি থেকে কাছেই। বুঝতে পারছিলাম রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়িতেই গোলাগুলি হচ্ছে। উনি শুধু ফিসফিস করে বললেন, ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’। আমাদের রাতে তখন আর ঘুম নেই। কোলের সন্তানকে বুকে আগলে অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে শুরু করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা পরদিনই ঢাকার বাইরে আমার স্বামীর গ্রামের বাড়ি চলে যাব।
পরদিন ঢাকায় এক অন্যরকম ভোর হল। চারপাশ থেকে মৃত্যুর খবর আসছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র মারা গেছে। দেশ তখন থমথমে। মনে হল, আমার এই প্রিয় শহরটির ওপর দিয়ে গত রাতে কত অত্যাচারই না হয়ে গেল! আমরা ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে ঢাকার বাইরে যাওয়ার আগে স্বামীকে মনে করিয়ে দিলাম, ‘অফিস থেকে বেতনটা ওঠাতে ভুলবে না’। আমাদের চোখে তখন শুধু ভয়। যুদ্ধ যদি লেগে যায়, কী হবে? সকাল বেলায় আমার স্বামী কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন। উদ্দেশ্য অন্তত মাসের বেতনটা যদি ওঠাতে পারেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তিনি খুব চিন্তাযুক্ত হয়ে নতমুখে ঘরে ফিরলেন। না, কোনোভাবেই অফিসে যেতে পারলেন না। আবুজর গিফারী কলেজ পর্যন্ত গিয়ে আর যেতে পারলেন না। আবার ঘরে ফিরলেন। কারফিউ জারি হয়েছে, তাই আর অফিসে যাওয়া যাবে না। এবার আমাদের সত্যিকার অর্থেই দুশ্চিন্তা শুরু হল।
ঢাকার পরিস্থিতি দেখে খুব একটা সুবিধার মনে হলো না। মনে হলো, ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। আমার স্বামীও তাই বললেন। তিনি বললেন, ঢাকায় থাকা আর নিরাপদ নয়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে চল। ২৭ মার্চ কারফিউ কিছুক্ষণের জন্য তুলে নেওয়া হলো। ঢাকার মানুষ তখন যে যেভাবে পারছে, শহর ছাড়ছে। রাস্তায় মানুষের মিছিল। সবাই নিজ নিজ গ্রামের ঠিকানায় যাচ্ছেন। আমরাও সেই দলে যোগ দিলাম। মনে আছে, আমরা প্রায় ৯ মাইল পায়ে হেঁটে একটা নদীর পারে এসে থামলাম। সম্ভবত নদীটির নাম ছিল শীতলক্ষ্যা। সেই নদীর পারে মানুষের ঢল। আমার কোলে আমার কন্যা শিশু আর ওর বাবার কোলে ছেলে। দুজনকেই একটু পরপর দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। ঢাকা থেকে আসার সময় কয়েকটা দুধের কৌটা কিনে রেখেছিলাম।
এদিকে মনে ভয়। যদি গুঁড়া দুধ শেষ হয়ে যায়, তখন বাচ্চা দুটোকে খাওয়াব কী? যাই হোক, আমরা সবাই মিলে শীতলক্ষ্যা নদীতে একটা লঞ্চ ভাড়া করলাম। লঞ্চটি আমাদের ঘোড়াশাল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে রাজি হল। ঘোড়াশাল থেকে কাছেই চরসিন্ধুর নামের একটি গ্রামে আমার স্বামীর বড় বোন থাকেন। তাঁর বাড়িতে আমরা এক রাতের জন্য আশ্রয় নিলাম। উদ্দেশ্য সেখানে রাতে থেকে আবার আমরা স্বামীর গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়াতে যাব। পরদিন খুব ভোরে আমরা একটি নৌকা ভাড়া করলাম। চরসিন্ধুর থেকে কাপাসিয়া। তারপর কাপাসিয়া থেকে তরগাঁও গ্রাম। নৌকা ভাসল শীতলক্ষ্যার বুকে। শুধু আমাদের নৌকা না। শীতলক্ষ্যার বুকে তখন অগণিত নৌকা। সব নৌকাই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাল তুলেছে। সন্ধ্যার দিকে আমরা কাপাসিয়া হয়ে তরগাঁও গ্রামের বাড়ি পৌঁছলাম।
তত দিনে এপ্রিল মাস শুরু হয়ে গেছে। তরগাঁওয়ের বাড়িটা জেলা শহর থেকে অনেক ভেতরে। সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের এত তাড়াতাড়ি প্রবেশের কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু ভুল আমাদের ভাঙল। কাপাসিয়ায় তখন সেনা আসতে শুরু করেছে। তরগাঁও গ্রামে আসতে আর কতক্ষণ? আমার ভাশুর সৈয়দ এহসান উদ্দীন আহমেদ ছিলেন কাপাসিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এলাকায় তার বেশ নাম ডাক। তিনি বাড়ির মেয়েদের বাঁচার একটি পথ আবিষ্কার করলেন। তিনি বড় আকারের একটি বজরা নৌকা জোগাড় করলেন। সেই নৌকা তরগাঁও গ্রাম থেকে দূরে একটি জনবিরল বিলে নিয়ে গেলেন। সেখানেই আমরা ১৫–২০ জন মানুষ এক মাসের মতো চাল ডাল আর অন্যান্য খাবার নিয়ে চলে গেলাম। শুরু হল আমাদের নৌকা জীবন। নৌকায় রান্না হতো। সেখানেই খাওয়া–দাওয়া, ঘুম। কিছুদিন পরই জানা গেল, তরগাঁও পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা চলে এসেছে। তারা তরগাঁও বাজার পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার ভাশুর এবার প্রমাদ গুনলেন। তাঁর ধারণা, এখানেও হয়তো পাকিস্তানি সেনারা চলে আসবে।
এপ্রিলের শেষের দিকে আমরা আবার তরগাঁও নিজ বাড়িতে আসি। বলা রাখা ভালো, তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমাদের পরিচিত ছেলেপেলেরা তখন দল বেঁধে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। আমাদের গ্রামের বাড়ি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি আশ্রয়স্থল। আমার ভাশুর সৈয়দ এহসান উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে বাড়িতে আশ্রয় দিতেন। আমরা গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্নাবান্নার কাজে লেগে যেতাম। এপ্রিলের শেষের দিকে আমরা আবার ঢাকায় চলে আসি। ঢাকার শান্তিবাগে আমরা বাসা ভাড়া নেই। ভাবলাম, ঢাকায় থাকলে হয়তো কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ঢাকায় তখন আমাদের কিছু বন্ধুও থাকতেন। কিন্তু ঢাকায় এসে আমরা নিরাপদবোধ করলাম না। জুনের দিকে এবার আমরা আমার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ চলে যাই। ভাবলাম কিশোরগঞ্জ মহকুমা শহর। হয়তো সেখানে আমরা নিরাপদে থাকতে পারবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা গেল আরও বেশি বিপদ। কিশোরগঞ্জ শহরে তখন সেনাবাহিনী আর পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকার আর আলবদর বাহিনী। স্বাভাবিকভাবেই সেখানেও আমরা নিরাপদ বোধ করলাম না।
আগস্ট মাস। আমরা আবার ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিই। বিকেল তিনটায় কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রিন অ্যারো ট্রেন ঢাকা যায়। আমরা সেই ট্রেনটাই ধরব। আমরা ঢাকায় যাব, আর আমার বড় ভাই চলে যাবেন অন্য এক ঠিকানায়। একদিন আমরা সবাই ট্রেনে উঠতে গিয়ে দেখি ভয়ানক এক অবস্থা। প্রতিটি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এর মধ্যে দেখতে পেলাম একটি ট্রেনের কামরা থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত ঝরছে। বুঝতে পারছিলাম, পাকিস্তানি সেনারা হয়তো কোনো অপারেশন থেকে ফিরছে। সবার চেহারা রক্তাক্ত। আর চোখে যেন আগুনের হলকা। আমার স্বামী যেহেতু সরকারি চাকুরে ছিলেন, তাই তাঁদের ভাষায় ‘ডান্ডি কার্ড’ দেখানোর পর

বাকি অংশ ১১ পৃষ্ঠায়
১০ পৃষ্ঠার পর

ট্রেনের একটি কামরায় উঠতে আমাদের কোনো সমস্যা হল না। আমরা অনেক কষ্টে একটি কামরায় উঠলাম। কামরায় ঢুকেই আমাদের গা ছমছম করে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম, আমার দিকে পাকিস্তানি সেনারা কেমন জানি বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমরা গোপন পরামর্শ করে ঠিক করলাম, সামনের স্টেশনেই আমরা নেমে যাব। এই ট্রেনে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। এতো ট্রেন নয়, যেন বাঘের খাঁচা। ট্রেনটা ঘোড়াশাল স্টেশনে থামার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঝট করে নেমে গেলাম। নেমে গেলাম মানে আমরা প্রাণে বেঁচে গেলাম। বেশ মনে আছে, নামতে নামতেই ট্রেনটা আবার ছেড়ে দিল। তখন পেছন থেকে দেখি একঝাঁক পাকিস্তানি সেনা আমাদের দিকে হিংস্র ইগলের মতো তাকিয়ে আছে।
ঘোড়াশালে নেমে আমার ভাই আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তাঁর গন্তব্যে। আমরা এবার শীতলক্ষ্যা নদীতে একটি নৌকা ভাড়া করলাম। উদ্দেশ্য ঘোড়াশাল থেকে কাপাসিয়া তারপর আবার সেই তরগাঁও। এবার যাত্রাপথ ছিল ভয়ের। মাঝে মাঝেই নদীতে লাশ ভেসে উঠছে। কত মানুষের লাশ! তখন আগস্ট মাস। তরগাঁও তত দিনে খুব সুবিধাজনক জায়গা ছিল না। আমার ভাশুর যেহেতু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তাই তিনি স্কুলের একটি কক্ষে মানুষের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওই সময় হঠাৎ করেই আমার স্বামীর ঠিকানায় একটি চিঠি আসে। সরকারি চাকুরেদের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দিতে হবে। আমরা আবার ঢাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকায় আমরা বাসা নিলাম মগবাজার পিয়ারা বাগে। কিন্তু ঢাকার অবস্থা তখন ছিল ভয়ানক খারাপ। সেখানে থাকা কোনোভাবেই নিরাপদ নয়। তখনই আমার স্বামী মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার চোখে তখন সরষে ফুল। তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিলে আমি একা একা সবকিছু সামলাব কীভাবে? আমি বাধা দিলাম। আমি দুই বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব? যদিও স্বামীকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে বাধা দিয়ে আমার বিবেকের কাছেও অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছিলাম। তারপরও তাকে নিয়ে মনে একটা ভয় সারাক্ষণ কাজ করতে লাগল। আমরা আবার তরগাঁও গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম।
ডিসেম্বর মাস। প্রতিটি দিন–রাত আমাদের নিত্যসঙ্গী ছিল সেই ছোট সনি ব্র্যান্ডের ট্রানজিস্টর। সেই রেডিওটি সন্ধ্যা সাতটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্বামী ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ খুলে বসতেন। খুব গোপনে একজন দুজন করে গ্রামের লোকজন জড়ো হতেন ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ আর কলকাতা থেকে আকাশবাণী শোনার জন্য। আমরা তখন অপেক্ষায় থাকি। যদি কোনো ভালো সংবাদ পাই। একদিন হঠাৎ সেই দিনটি এল। আমরা খবর পেলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সম্ভবত আমার ভাশুরই খবরটা দিয়েছিলেন! আর যুদ্ধ নেই। আমরা যুদ্ধে জিতে গেছি। আমরা স্বাধীন হয়েছি! সবাই চিৎকার করে কান্না করছি। আমার স্বামী, ভাশুর আর বাড়ির সবাই বড় উঠানে এসে যে যার মতো করে কান্না করছে। আর বলছে জয় বাংলা। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কেউ কেউ মাটিতে মাথা লাগিয়ে কাঁদতে লাগলেন। এ যে আনন্দের কান্না! তখনই মনে হয়েছিল, দেশ আর মা এই দুটো শব্দের ব্যঞ্জনা একই। মনে হয়েছিল আমার প্রিয় দেশটার ওপর দিয়ে এই পাকিস্তানি বর্বরগুলো কত ভয়াবহ অত্যাচারই না করেছে! ইচ্ছে হচ্ছিল, যদি পারতাম দেশটাকে বুকে নিয়ে একটু আদর করে দিতে! কত জন্মের পুণ্যের ফসল যে আমি বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম!
১৭ ডিসেম্বর। খুব ভোরে আমাদের এলাকার একদল মুক্তিযোদ্ধা বাড়িতে এলেন। আমার ভাশুর আর স্বামী তখন বাড়ির বাইরে উঠোনে আরও অনেক মানুষ নিয়ে চেয়ারে বসে কথা বলছিলেন। তখন দেশ স্বাধীন। লুকিয়ে থাকার কোনো তাড়া নেই। হঠাৎ দেখতে পেলাম, কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা দুজন পাকিস্তানি নিয়ে আমাদের বাড়ির উঠানে এলেন। তাদের হাত ছিল দড়ি দিয়ে বাঁধা। গায়ে গেঞ্জি আর পরনে ট্রাউজার। মুখ রক্তাক্ত। জানা গেল, তাদের একজন বেলুচ, অন্যজন পাঞ্জাবি। দুই পাকিস্তানি সেনাদের দেখে আমরা ঘৃণায় তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। এদের মুখ দেখাও পাপ। আহত দুই পাক সেনারা তখন জোরে জোরে বলছে ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’। তাদের করুণ পরিণতি দেখে আমরা খুব আনন্দিত হয়েছিলাম। এই হায়েনাগুলো বাংলার মানুষের সঙ্গে যা করেছে, তাতে তাদের প্রতি কোনো রকম করুণা আসার কথা নয়। অনেকেই ঘৃণায় আর আক্রোশে তাদের দিকে থুতু নিক্ষেপ করছিল। আমিও পাক সেনাদের দেখে এক দলা থুতু নিক্ষেপ করে বলেছিলাম ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’।