শুনুন ও বুঝুন

ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখছিলাম। ভিডিওতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক যুবক তাঁর বাবার সঙ্গে ট্রেনে যাচ্ছিল। যুবক তাঁর বাবাকে বললেন, “বাবা, দেখ, দেখ! বাইরের দৃশ্য কত সুন্দর! কী সুন্দর গাছপালা আর সবুজের সমারোহ! দেখ, দেখ! চার পাশের গাছপালা দৌড়াচ্ছে। আকাশে মেঘ দ্রুত গতিতে ওপাশ দিয়ে আসছে!” এক কথায় কোনো ছোট্ট বাচ্চা তার জীবনের প্রথমবার ট্রেন ভ্রমণ করলে যা বলতে পারে ঠিক সে রকম কথা। তাঁর বাচ্চামিতে বিরক্ত হয়ে একজন সহযাত্রী তাঁর বাবাকে বলেই বসলেন, “এই যে শুনুন, আপনার ছেলেকে ভালো একজন ডাক্তার দেখান।” উত্তরে তাঁর বাবা বললেন, “সে হাসপাতালেই ছিল। আজই হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়ে বাসায় যাচ্ছি।” উত্তরে সহযাত্রী বললেন, “আরও কিছুদিন থাকা উচিত ছিল। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে ছেলেকে সুস্থ করেন।” তখন তাঁর বাবা বললেন, “আমার ছেলে জন্মের পর থেকেই দেখতে পায় না। এই কয়দিন আগে তাঁর চোখের অপারেশন হয় এবং এখনই সে জীবনে প্রথমবারের মতো সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। তাই হয়তো একটু আনন্দে এসব কথা বলছে। আপনাদেরকে বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।”
লিংকড্‌ইনে আরেকটা ভিডিও দেখছিলাম। ভিডিওতে একজন চাকরির আবেদনকারী মৌখিক পরীক্ষায় আসতে ৩০মিনিট দেরি করেছিল। অনুরোধ করে মৌখিক পরীক্ষা দিতে পারলেও সে চাকরিটা পায়নি। যদিও সে মৌখিক পরীক্ষায় সবার চেয়ে ভালো করছিল, ভাইভা বোর্ড তাঁর বিলম্ব করার বিষয়টাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখায় সে চাকরিটা পায়নি। আসলে সে মাত্র এক ঘণ্টার রাস্তায় ৩ঘণ্টা সময় হাতে নিয়ে বের হয়েছিল। রাস্তায় একজন ভদ্রলোক অ্যাক্সিডেন্ট করেছে দেখে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করতে যায়। সেখানে পুলিশের বিভিন্ন ফরম পূরণ করতে আর তথ্য দিতে অনেক সময় চলে যায় তাঁর। তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গেলেও ৩০মিনিট দেরি করে সে।
এ রকম অনেক ভিডিও, গল্প বা নাটক দেখি আমরা প্রতিনিয়ত। একবারও কি প্রশ্ন করি আমরা কী শিখলাম? প্রথম ভিডিওতে সহযাত্রী কিছু না বোঝার আগেই বিরক্ত হয়ে একটা মন্তব্য করে বসলেন। কে লজ্জিত হলো? পরের ভিডিওতে প্রশ্নকর্তারা জানতেও চাইলেন না আবেদনকারীর বিলম্বের কারণ কী। তাঁরা কী প্রকৃত ভালো আবেদনকারীকে নিয়োগ দিতে পারছেন? তাই, আমার মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কি শুনতে ও বুঝতে মোটেই আগ্রহী নই?
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাতে ২০১৮সালের ২৩শে নভেম্বর আমি লিখেছিলাম “২মাস ২০দিনের একটা জরিপে আমি দেখি প্রায় ৮৪ভাগ মানুষ শুনতে নয়, বলতে আগ্রহী। প্রায় ১৫ভাগ মানুষ শুনতে চায় শুধু তাঁরা বলার সময়/সুযোগের অপেক্ষায়। বাকি ১ভাগ মানুষ শুনতে চায়।”
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন আলোচনা বা যুক্তি-তর্কের সময় খেয়াল করে দেখছেন কি আমরা অন্যের কথা শুনতে চাই কম? বরং বলতে ভালোবাসি বেশি এবং ব্যস্ত হয়ে যাই অন্যের যুক্তি খণ্ডনে? আপনি জানেন কি আপনি না শুনে কী হারাচ্ছেন? উইলিয়াম আর্তার ওয়ার্ড বলেন, “আমাদের নেতৃত্ব দিতে হলে, আগে অবশ্যই আমাদের সেবা করতে হবে। আমাদের সেবা করতে হলে আমাদের অবশ্যই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সেই প্রস্তুতি নিতে হলে আগে অবশ্যই আমাদের শিখতে হবে। আর সেই শিক্ষা পেতে হলে আমাদের অবশ্যই শুনতে হবে। আর সর্বশেষ কথা, আমাদের শুনতে হলে আমাদের নীরব থাকতে হবে।” তাহলে কী দাঁড়াল? আমাদের নেতৃত্ব দিতে হলে আমাদের নীরব থেকে শুনতে হবে। আমরা কি তা করি? না কথা বলে নেতৃত্ব দিতে চাই?
কথা শোনার অভ্যাস গঠন করলে আপনি নেতৃত্ব দিতে পারেন বা না-ই পারেন, কিছুদিন পর আপনি সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবেন খুবই সহজে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটা প্রায় ৫০জন মানুষের সঙ্গে প্রয়োগ করে দেখেছি, কাজ করে মন্ত্রের মতো! কানাডীয় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অধ্যাপক জরডান বি. পিটারসন বলেন, “আপনি যাঁর সঙ্গে কথা বলছেন, ধরে নেবেন তিনি আপনার চেয়ে জানেন অনেক বেশি।” তাই তিনি তাঁর ‘টুয়েলভ রুলস ফর লাইফ’ (12 Rules for Life) বইয়ে মনোযোগ দিয়ে শোনাকে ১টি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হিসেবে বলেছেন এবং একটা অধ্যায় লিখেছেন শুধুমাত্র এই মনোযোগ দিয়ে শোনা নিয়ে।
২০১৭ সালে আমাদের কোম্পানিতে ৮মিলিয়ন ডলারের একটা প্রকল্প প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। প্রকল্পের স্পনসররা ডিজাইন টিমের সঙ্গে মোটেই একমত হতে পারেনি। অথচ ডিজাইন টিম বারবার তাঁদের ডিজাইন প্রদর্শন করে দেখিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে কীভাবে তাঁদের ডিজাইন সঠিক। প্রজেক্টে একপর্যায়ে ফান্ডিং বন্ধ হয়ে গেলে ম্যানেজার জেফ ব্রুয়েট স্পনসরদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বৈঠকে বসেন। প্রায় ২ঘণ্টার এক সভার পর সবকিছু অলৌকিকভাবে ঠিকঠাক হয়ে যায়। সেদিন আগ্রহ থামাতে না পেরে অফিস পরে আমি জেফের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তিনি এমন কী করলেন যে সব ঠিক হয়ে গেল! কিছুক্ষণ কিছু না বলে চুপ থাকার পর জেফ বললেন, ‘সত্যি বলতে কী? আমি আসলে কিছুই করিনি।’ আমি আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাহলে সব ঠিক হয়ে গেল কীভাবে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি স্পনসরদের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছি মাত্র।’ আমি বললাম, ‘ডিজাইন কি পরিবর্তন করতে হবে?’ তিনি বললেন, ‘না’। আবারও বোকার মতো জানতে চাইলাম তাহলে এমন কী সমস্যা হয়েছিল যে প্রকল্পই বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল? উত্তরে তিনি বললেন, ‘ডিজাইন টিম ভালো শ্রোতা ছিল না। তারা শুধু যা সঠিক তা-ই বলে যাচ্ছিল। আমি বৈঠকে গিয়ে সেই শ্রোতা হয়েছি মাত্র।’
কাজেই, কিছু জানতে বা বুঝতে মনোযোগ দিয়ে শুনুন। শুনলে কিছু অর্জন করত পারেন বা না-ই পারেন কিছু হারাবেন না। নেতৃত্ব না দিতে পারলেও মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবেন না। পারিবারিক/দাম্পত্য কলহে কথা না বলে শুধু শুনুন ও বোঝার চেষ্টা করে দেখুন কী হয়। কিছু হোক বা নাই হোক, কলহ থাকবে না। আপনার দৃষ্টিতে অবাধ্য সন্তানটিকে আদেশ-উপদেশ না দিয়ে একটি বার ওর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। মাত্র এক মাসে সে-ই হবে আপনার দেখা সবচেয়ে মাতৃভক্ত/পিতৃভক্ত সন্তান। বলা নয়, শোনা ও বোঝাই হোক আপনার সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ সফল জীবনের গোপন রহস্য।