স্যালুট বাজান...

অস্থির মন। প্রথমে ভেবেছিলাম, আগুন নিয়ে লিখি। ফেসবুকে চলচ্চিত্র নির্মাতা রওশন আরা নিপার একটি পোস্টের দুটি লাইন আমাকে নাড়া দেয়। বনানীর আগুন নেভাতে আসা দমকলের ছিদ্র পাইপ পলিথিনের ব্যাগে মুড়িয়ে চেপে ধরা নাইমের ছবির নিচে লেখা শেষ দুটি লাইন—
‘এই শিশুটিই বাংলাদেশ
স্যালুট বাজান...।’
শিশুটির মুখের অভিব্যক্তি ছিল অপূর্ব, এমনটি আগে কখনো দেখিনি। তার চাহনি দেখে মনে হলো, এ যুদ্ধ তার একার। নিপার ‘বাজান’ ডাক শুনে ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। শ্রদ্ধা–ভালোবাসায় আমিও লিখলাম ‘স্যালুট ’।
এ পর্যন্তই। আগুন নিয়ে আর লেখা হলো না। প্রধান কারণ, চিকিৎসকের দেওয়া দেড় ডজন ওষুধের মধ্যে দু–তিনটি আছে ঘুম পাড়িয়ে রাখে। চেষ্টা করেও চোখ মেলে রাখতে পারি না।
ঘুম থেকে উঠে আরেকটি মর্মস্পর্শী খবর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল, সেই সঙ্গে ক্ষোভও জন্ম নিল।
‘সিলেটে আর যাব না’—পুলিশের হেনস্তার শিকার এক ভদ্র নারীর করুণ আর্তনাদ। তিনি তার স্বামীসহ গিয়েছিলেন হযরত শাহজালাল (র.)–এর মাজার জেয়ারতে। তাঁর ছেলে এইচএসসিতে পড়ে। সেখানে পুলিশ এই দম্পতিকে অপমান করে। দুজনকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ করে। স্বামীর কাছে জানতে চায়, তাঁর স্ত্রীকে কত টাকা ভাড়ায় এনেছেন। এই নারীর জিজ্ঞাসা, আমার ছেলে এইচএসসিতে পড়ে, এখনো কি আমাকে কাবিননামা সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হবে?
পুলিশের হেনস্তার এই খবর সামাজিক যোগাোযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। খবরে বলা হয়েছে, মাজারে দায়িত্বরত পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শককে (এএসআই) ক্লোজড করা হয়েছে।
হযরত শাহজালাল (র.)–এর মাজার জেয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ সেখানে যান। যান বিদেশ থেকেও। এ ছাড়া সিলেটের আছে পর্যটনের বাড়তি আকর্ষণ। হাওর-বাঁওর, পাহাড়-টিলা, সবুজ বন আর চা বাগান বেষ্টিত এই অঞ্চলে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটে। জাফলং, তামাবিল, রাতারগুল, মাধবকুন্ডে প্রতিদিনই থাকে মানুষের ভিড়। অনেকে যান পরিবার নিয়ে, কেউবা বন্ধু-বান্ধব আবার কেউবা দম্পতি।
যারা যান তাদের সবাইকে কি বিয়ের কাবিননামা সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে? এটা কি ধরনের পুলিশি আচরণ? স্বাধীন দেশের মানুষের মুক্ত চলাফেরায় কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে না। এটা এক শ্রেণির অতি উৎসাহী পুলিশের বাড়াবাড়ি, যা গ্রহণযোগ্য নয়। অবশ্য, এর মধ্যে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত এক পুলিশ পরিদর্শকের পোস্ট চোখে পড়ল। নামটি মনে রাখতে পারিনি। তিনি সিলেটে দায়িত্ব পালনকালে প্রতিনিয়ত এই অতি উৎসাহীদের মোকাবিলা করেছেন। এ নিয়ে তার মতপার্থক্য ও জবাবদিহির কাহিনিও বর্ণনা করেছেন। তার সঙ্গীরা পুলিশের চাকরি না করে তাঁকে রাজনীতি করার পরামর্শ দিতেন—এ কথাও তার পোস্টে উল্লেখ করেছেন।
ভালো লাগল, এ ধরনের বিবেকবান পুলিশ কর্মকর্তা এই বাহিনীতে আছেন জেনে।
এসব খবরের মাঝে ফেসবুকে চোখে পড়ল সাহিত্য সভার অনেক ছবি। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এই সভার লাইভও দেখলাম। অনেকেই পোস্ট করেছেন। নিউইয়র্কে সাহিত্য চর্চা এখন বেশ বেগবান। ভাবলাম, এ নিয়ে আমার ভাবনার দুলাইন লিখি। কিছুক্ষণের মধ্যে তা লিখে পোস্টও করে দিলাম। সেটা ছিল এই—
‘সাহিত্য সভা—
‘সাহিত্য সমষ্টির সৃষ্টি নয়। একটি কবিতা এক শ জনের নয়, একজনের চিন্তা ও কল্পনার ফসল। একইভাবে গল্প বা প্রবন্ধ। সাহিত্য সভায় হাজিরা দিয়ে লেখক মর্যাদা লাভ বা ভেজাল–নির্ভেজাল হওয়ার কোনো গ্যারান্টি নেই।’
বিভিন্ন পেশার মানুষের নিজস্ব সংগঠন বা ক্লাব আছে। কবি-লেখকদেরও একটা কিছু থাকতে হবে। ভালো হয় যদি এটা ‘আড্ডা’ হয়। তথাকথিত ক্লাব-সংগঠন নয়। আড্ডায় লেখকেরা আসবেন, ভাবের-মতের বিনিময় করবেন, একে অন্যকে জানবেন, জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করবেন। ভালো হবে, অভিজ্ঞ কেউ সমকালীন সাহিত্য নিয়ে অথবা ভালো কোনো সমালোচক লেখকদের সদ্য প্রকাশিত লেখা নিয়ে আলোচনা করলে। খেয়াল রাখতে হবে, আড্ডা যেন ‘কী হনুরে’ মার্কা লোকদের দাপট থেকে রক্ষা পায়। আড্ডা হবে নির্মল, অনানুষ্ঠানিক।
মূল কথা, আপনি আপনার চিন্তাকে আরও শাণিত, আরও ধারালো করুন, আপনার ভাবনা বা কল্পনা শক্তিকে আরও প্রসারিত করুন, আপনার সৃষ্টি হোক কালজয়ী, পাঠকপ্রিয়তো বটেই।
আগে লেখা, পরে সংগঠন।
আবারও বলছি,‘সাহিত্য সমষ্টির সৃষ্টি নয়। আপনার নিজের।’
পোস্টটি পড়ে প্রথম আলোর ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন পরামর্শ দিলেন, এ বিষয় নিয়েই এই সংখ্যায় আমি লিখতে পারি। ভালো পরামর্শ। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলাম, বাড়তি আর কী বলার আছে।
এর আগে একটু স্মৃতিচারণ করি।
তিন দশক আগে যখন আমরা নিউইয়র্ক থেকে পত্রিকা বের করি, তখন ছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন লেখক। নিউইয়র্কের বাইরে লস অ্যাঞ্জেলেস, ওয়াশিংটন ডিসি, ডালাস, নিউজার্সিসহ বিভিন্ন শহর ও অঙ্গরাজ্য থেকে কয়েকজন নিয়মিত লিখতেন। তবুও ৭০% ভাগ লেখা আমরা নিতাম ঢাকার পত্রপত্রিকা থেকে।
আর এখন? ঠিক তার উল্টো। এখন পত্রিকার অধিকাংশ পাতাজুড়েই থাকে আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের লেখা। প্রথম আলো এ ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে। দেখে ও জেনে আমার ভালো লাগছে, বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান লেখক-লেখিকা নিয়মিত প্রথম আলোয় লিখে থাকেন। এর মধ্যে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী আছেন। আমেরিকার কমিউনিটি, রাজনীতি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইমিগ্রেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ফ্যাশন, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যসহ নানা বিষয়ে তারা লিখে যাচ্ছেন। বর্তমান এই পরিবেশ তিন দশক আগে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। অবশ্য একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, এ সময়ের মধ্যে অভিবাসীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ।
নব্বই দশকের শুরুতে নিউইয়র্কে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ জার্নালিস্ট অ্যান্ড রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বিজেডব্লিউ)। দৃশ্যত এটিই ছিল লেখক-সাংবাদিকদের প্রথম কোনো ফোরাম। সম্ভবত সংগঠনটি এখনো আছে। তবে সাংবাদিকতা ও সাহিত্য চর্চার চেয়ে অন্যান্য নানাবিধ বিষয়ে সংগঠনটি সম্পৃক্ত থাকায় প্রকৃত লেখক-সাংবাদিকদের টানতে পারেনি। তবে তাদের একটি সফল কাজ ছিল, দুই দশক আগে একটি সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের। এতে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন কবি আল মাহমুদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন কবি আসাদ চৌধুরী ও কবি হেলাল হাফিজ।
সাহিত্যাঙ্গনে অন্যদের ছিটেফোঁটা সাংগঠনিক তৎপরতা থাকলেও বহুদিন পর এসে নজর কাড়ে সাহিত্য একাডেমি। তাদের কাজের ধারাবাহিকতা যে আছে, তার প্রমাণ গত সপ্তাহে শততম সাহিত্য আসরের জমকালো বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। দৃশ্যত বহু কবি-সাহিত্যিক একাডেমির পথচলায় শামিল হয়েছেন। আমি তাদের চেতনার প্রতি সম্মান জানাই, শ্রদ্ধা করি।
যেকোনো ক্ষেত্রে সম্মিলিত শক্তির মূল্য আছে। সংস্কৃতি চর্চা বা আন্দোলন-সংগ্রামে কবি-সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকার নজির আছে। তবে লেখকের লেখার উৎকর্ষ সাধনের দায়িত্ব লেখককে নিজেই নিতে হবে। এটা সংগঠন করে দেবে না। তাই আগে লেখা, পরে সংগঠন।
একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য সাংবাদিক যিনি পরলোকগত। তিনি সাংবাদিক নেতা ছিলেন, খুবই প্রিয় নেতা। সব সময় সোচ্চার থাকতেন সাংবাদিকদের স্বার্থ রক্ষা ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। সুন্দর-গোছানো কথা বলতেন, বক্তৃতা করতেন। কিন্তু তাকে লিখতে দেখতাম না। একবার একটি বিষয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করলে তিনি রাজি হন। আমি কাগজ-কলম বাড়িয়ে দিই। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, লেখাতো আর শেষ হয় না। তিন সপ্তাহ পর দেখি লেখা হয়েছে মাত্র সাত লাইন। লেখাটি আর কখনো শেষ হয়নি।
বিষয়টিকে এভাবে বলা যেতে পারে, তিনি নেতা হয়ে এসেছিলেন, নেতা হিসেবে চলে গেলেন, সাংবাদিক হওয়া আর হলো না।
লেখকের মৌলিক কাজ তাঁর লেখা। এ লেখাতেই উজাড় করতে হবে মন-প্রাণ। সমাবেশ-সম্মিলন হবে, অবশ্যই হবে, আড্ডার মেজাজে হলে তা হবে সর্বোত্তম।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক।