বুমেরাং

প্রতীকী
প্রতীকী

হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেতে পড়ে গেল। একটু গরম চা ছিটকে পড়ল নিজের পায়ের ওপরে। কার্পেটের সাদা অংশ লালচে হয়ে গেল নিমেষেই। অন্য সময় হলে তাড়াহুড়ো করে হয়তো পরিষ্কারে লেগে যেতেন রাহেলা বানু। আজকে সেটা ইচ্ছে করছে না। চায়ের কাপ মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন নিস্প্রাণ পাথরের মতো হয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে মেঝেতে বসে পড়লেন। খুব সন্তর্পণে অনেক শখের কেনা এই চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে পরখ করলেন, ভেঙেছে কি না। না ভাঙেনি। অবশ্য কাপটা ভাঙলে এটা তার জন্য অপ্রত্যাশিতই হতো। আগেও দু-একবার পড়েছে, কখনো ভাঙেনি। আস্তে করে উঠে রান্না ঘরের দিকে গেলেন। আবারও এক কাপ চা বানানোর জন্য। চা করে নিয়ে আসলেন। আস্তে করে রেখে দিলেন জামিল খন্দকারের সামনের ছোট্ট টেবিলের ওপরে। এত কিছু ঘটে গেল, এর কোনো কিছুই জামিল সাহেবের দৃষ্টিকে বাইরের গুড়িগুড়ি তুষারপাত থেকে সরাতে পারল না। জামিল সাহেবও নিস্পাণ পাথরের মতো বাইরের পানে চেয়ে আছেন। ঝাপসা দৃষ্টিতে ঝরে পড়া তুষার দেখছেন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। জামিল সাহেবের এই কান্না এখন আর রাহেলা বানুকে মোটেও বিচলিত করে না। জামিল সাহেবের এই কান্না রাহেলা বানুর কাছে অর্থহীন, মেকি আবেগের বহিঃপ্রকাশ মনে হয়। জামিল সাহেব একবার চায়ের পেয়ালার দিকে তাকিয়ে, আরেকবার রাহেলা বানুর মুখের দিকে তাকালেন। সেই তাকানো কোনোভাবেই রাহেলা বানুর দৃষ্টিতে আটকাল না। রাহেলা বানু আবারও গিয়ে কম্পিউটারে বসলেন। ইমেইলটি খুললেন। খুব মন দিয়ে মেইলের প্রতিটি কথা পড়লেন তিনি। একমাত্র মেয়ে তন্বী লিখেছে এই মেইল। অনেক দিন কথা হয়নি। না ফোন, skype, ফেইস বুক, কোথাও ছিল না তন্বী সুদীর্ঘ দুইটি মাস।

তন্বী লিখেছে, লক্ষ্মী মা আমার, জানি গত দুই মাসে অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের। তোমাদের ফোন ধরিনি, ফেইস বুকে কোনো স্ট্যাটাস দিইনি। এমনকি মেইলও করিনি। আজকে হয়তো ফোন করতে পারতাম। কিন্তু না, ফোনে তোমাদেরকে এসব বলা যেত না। কদিন যাক, তোমরা একটু সইয়ে নাও, মনটা একটু শক্ত হোক, তখন ফোন করব। অবশ্য তোমার মন এমনিতেই অনেক শক্ত সে কথা আমি ছাড়া আর কে জানে বলো। অনেক চেষ্টা করেও সাব্বিরের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা টিকে রাখতে পারলাম না। আজকে সকালেই ডিভোর্স ফাইনাল হয়ে গেল। বিয়ের এই তিন বছর কম সময় তো নয়। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করলাম, তুমিও করলে, বাবাও তো কম করল না। আমি তো আর তোমার মতো আজীবন সহিষ্ণু না যে, এই যন্ত্রণা বাকিটা জীবন বয়ে বেড়াব। তবে আমার চেষ্টার কমতি ছিল না। সেটা যেমন তুমিও জান, বাবাও জানে। গত দুই মাসে অনেক কেঁদেছি মা। নীরবে নিভৃতে অনেক চোখের জল ফেলেছি। বিধাতার কাছে অনেক প্রার্থনা করেছি, তিনি যেন তোমাদের সম্মান রাখেন। আমার যতই কষ্ট হোক জীবনে, কিন্তু সাব্বির আর আমার সম্পর্কটা টিকে থাক। আমি পারলাম না মা। আমাকে তোমরা ক্ষমা করো। তিন বছর আগে যে ভালোবাসার বীজ বুনেছিলাম, সে বীজ কখনই অঙ্কুরিত হয়ে চারাগাছের জন্ম দেয়নি। থাক, এ নিয়ে আর আপাতত ভাবছি না। কিছুদিন আমার মতো থাকি। আর কিছুদিন অপেক্ষা করো। দেখবে একদিন হঠাৎ করে চলে আসব। ভালো থেক। তোমার তন্বী।
জামিল সাহেব ইমেইলটা সকাল থেকে বেশ কয়েকবার পড়েছেন আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন। অনর্গল চোখের জল ফেলছেন। জামিল সাহেবের এই অশ্রু রাহেলা বানুকে একটুও বিচলিত করেনি। বরং ভেতরে ভেতরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছেন রাহেলা বানু। যে পৈশাচিকতা নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলেন সুদীর্ঘ ২৪টি বছর। রাহেলা বানু কাঁদলেন না, চোখের জলও ফেললেন না। সোজা দোতলায় উঠে গেলেন। নিজের শোয়ার ঘরে ঢুকে দরজা টেনে দিয়ে বিছানায় ওপর হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলেন। অনেক জোরে জোরে চিত্কার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কষ্টে তার বুকটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছিল। একমাত্র মেয়ের এই কষ্টে তিনি আজ সত্যি জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলেছেন। আজকের কষ্ট তার নিজের জীবনের সকল কষ্টকে ছাড়িয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতেই নিমেষে চলে গেলেন সুদূর অতীতে। এমনি কষ্ট তিনি আরও অনেক পেয়েছেন। যে সীমাহীন কষ্ট জামিল তাকে দিয়েছে। সুদীর্ঘ ২৪ বছরে জামিল তাকে যেভাবে তিলে তিলে মেরেছে, নিষ্পেষিত করেছে। স্বদেশ ও পরবাস এই দুই জীবনেই জামিল তাকে অনেক বার মেরেছে। যার কোনোটারই প্রতিশোধ নেওয়া হয়নি। নিতে পারেননি। আজ নিজের মেয়ের এই কষ্টের দিনে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ তাকে সামান্য ক্ষণের জন্য হলেও উদ্বেলিত করেছে। তিনি তো নিজে জামিলকে কিছুই করেননি। প্রকৃতি কখনোই মানুষের সঙ্গে অবিচার করে না। প্রকৃতি ঠিকই জামিলের কৃতকর্মের প্রতিদান দিয়েছে। জামিল নিজে রাহেলার সঙ্গে যা যা করেছে, রাহেলার পরিবারের সঙ্গে যা যা করেছে, এতগুলো বছর পরে তন্বীর জামাই ও তার পরিবার জামিল সাহেবের সঙ্গে ঠিক একই আচরণ করেছে। কি অদ্ভুত? জামিল কি কখনো ভেবেছিল, জীবন নিজেই এভাবে বুমেরাং হয়ে তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে?
রাহেলার আজ খুব মনে পড়ছে। তার ভালো মানুষ বাবাকে কতটা অপমান সহ্য করতে হয়েছে জামিল ও তার পরিবারের কাছে। এই বাবা তাকে প্রায়ই বলতেন, মারে, জীবনে কাউকে কষ্ট দিসনে। একরত্তি কষ্ট মানুষকে দিলে সেই কষ্ট তোর জীবনে আবার ফিরে আসবেই। হাহ, নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। রাহেলার ভালো মানুষ বাবা তো কাউকে কখনো কষ্ট দেননি কিন্তু জামিল তাকে কষ্ট দিয়েছে। সীমাহীন অপমান দিনের পরে দিন। আর একদিন সেই অপমান এমনি চরমে পৌঁছে গেল যে রাহেলার বাবা সেটা সইতেই পারলেন না। হার্ট অ্যাটাক করে মারাই গেলেন। জামিল রাহেলাকে নানারকম ফন্দি ফিকির করে দেশে যাওয়াটাও বন্ধ করে দিল। বাবাকে শেষ দেখা হয়নি রাহেলার। জামিলের প্রতি তার স্ত্রী হিসেবে দায়িত্বের একবিন্দুও অবহেলা দেখায়নি রাহেলা। যদিও এই দায়িত্ব পালনের সঙ্গে ভালোবাসার লেশমাত্র ছিল না। ভালোবাসা? সেতো উড়ে গিয়েছে কবেই। চব্বিশ বছর আগে যেদিন জামিলের ঘরে আসা সেদিনই একটি সুন্দর জীবনের মৃত্যু, একটি ভালোবাসার পরিসমাপ্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তখন রাহেলা। সুদূর গ্রাম থেকে শুধু নিজের মেধার যোগ্যতায় এত দূর এসেছিল রাহেলা। স্কুলশিক্ষক বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য। রাহেলা সুন্দরী ছিল। নমনীয় মুখাবয়ব। সব সময়ই এক ধরনের হাসি লেগেই থাকত মুখে। অসম্ভব ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন রাহেলা বন্ধুদের মাঝে অনন্যাই ছিল। ছেলেদের প্রেম নিবেদন সেতো নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। কিন্তু নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে সবকিছুকেই আগলে রেখেছিলেন রাহেলা বানু। কেউ তাকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি। পেরেছিল শুধু একজন। না, সে জামিল নয়। অন্য কেউ। তার কথা রাহেলা ছাড়া আর কেউ জানে না। ঠিক ঝড়ের মতোই রাহেলার জীবনে একদিন আবির্ভূত হয়েছিল পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের মাস্টার্সের ছাত্র সজল। সজলই পেরেছিল রাহেলার ইস্পাত কঠিন মনকে নাড়া দিতে। সম্পর্ক যদিও বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু রাহেলা মনে মনে অনেক দুরেই এগিয়েছিল। ভালোবেসেছিল সজলকে। সেই ভালোবাসার কথা কখনই আনুষ্ঠানিক ভাবে বলা হয়নি সজলকে। যদিও সজল বলেছে অনেকবার। রাহেলা বলবে কীভাবে। তার আগেই সব শেষ।

প্রতীকী
প্রতীকী


রাহেলার মামা ছিলেন জামিলের বাবার বন্ধু। সেদিন শুক্রবার। হঠাৎ​ সকালবেলা মামা এসে নিয়ে গেলেন রাহেলাকে। রাহেলা কি আর জানত, ভেতরে ভেতরে এমন একটা ব্যাপার ঘটেছে। মামার বাসায় পৌঁছার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাবাও এলেন। দুজনেই হতচকিত। মামাই এক সময় কথাটা পারলেন। বললেন জামিলের কথা। খুব ভালো ছেলে। এমন মেধাবী ছেলে তিনি জীবনে দেখেননি। দেখতে সুদর্শন। ফ্যামিলি ভালো। জামিল ই​তিমধ্যে রাহেলাকে দেখেছে ও পছন্দও করেছে। রাহেলা ভেবেই পাচ্ছিল না কে আবার কবে তাকে অভাবে দেখল যে দূর থেকে দেখেই পছন্দ করে ফেলল। দিনকাল যা পড়েছে, এমন সুযোগ হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না, মামা বললেন। তোমাদের আর ভাবাভাবির কিছু নাই। আজকে বিকেলে ওরা সবাই আসছে। সব ঠিক থাকলে আজকেই বিয়ে?
আজকেই বিয়ে, বাবা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন? তা কী করে হয়? রাহেলার মতামতটা তো জানতে হবে। আরে রাহেলার আবার মতামত কি? ওতো আর কারও সঙ্গে প্রেমট্রেম করে না। তেমন পছন্দের কেউ থাকলে আমরা না হয় ভেবেচিন্তে দেখতাম। আর জামিলের মতো ছেলেকে কোনোভাবেই অন্তত হাত ছাড়া করতে চাই না। রাহেলার বাবা অনেক জোড়া জুড়ি করলেন কিন্তু নাছোড়বান্দা মামার যুক্তির কাছে তার কোনো যুক্তিই টিকল না। রাহেলা ঘটনার আকস্মিকতায় যেন আকাশ থেকে পড়ল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাহেলা চুপচাপ বসে রইল আর সারাক্ষণ মামি এসে কানের কাছে জামিল ও তার পরিবারের গুণকীর্তন করে গেলেন।
রাহেলা কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনো একটা অজুহাতে কী এখান থেকে বেরিয়ে যাবে এখন? আজকে কী সজলকে সব বলবে সে? কিন্তু কি বলবে? সজল, আমিও...। তাতে কি এই সমস্যার সমাধান হবে? না হয় বললই দুজন দুজনকে। কিন্তু তারপর? এই এ রোখা মামাকে কি করে রুখবে? কোন কোন যুক্তিতে সজলকে জামিলের চেয়ে বেশি ভালো প্রমাণ করবে? সজলের ব্যাপারে কী রাহেলা তাহলে একটু বেশিই দেরি করে ফেলল? নাহ, আসলেই কী সজলের সঙ্গে তার কিছু হয়েছে? সজল কী এখন এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত? বাবাকে কি বলা যায়? কিন্তু বাবাকে কি বলবে রাহেলা? অদ্ভুত এক টানাপড়েন এ আরও কয়েকটি ঘণ্টা কেটে গেল। বিকেলে জামিলরা চলে আসল। দেখাদেখি হলো। জামিল সুদর্শন, স্মার্ট, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। পরিবারের লোকজনকে দেখেও ভালোই মনে হয়েছে। জামিলের বাবা এই বাসায় ঢোকার পরে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছেন। এক সময় রাহেলার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, আরে বিয়াই সাহেব এটাই হলো কপাল, বুঝলেন। ভাগ্যে লেখা থাকলে আমি আপনি কি করতে পারব বলেন? কী অদ্ভুত। এখনো বিয়েই হয়নি। ওনারা বিয়াই হলেন কীভাবে, রাহেলা বিরক্ত হয়।
এক সময় বাবা রাহেলার কাছে আসলেন। ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বসলেন। রাহেলা বাবার কোলে ঢোলে পড়ল। যেন সমস্ত আবেগ ঝরে পড়ল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল অনেকক্ষণ। জামিল সাহেবও কাঁদলেন। দুজনের কান্নার জল মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। রাহেলা বাবার কান্নার অর্থ বুঝলেও বাবা কি বুঝলেন রাহেলার কান্নার মানে? না বাবা হয়তো ঠিক বোঝেননি। এই কান্নার অর্থ বাবা কোনো দিনও বুঝবেন না। খুব কম সময়ের মধ্য রাহেলার জীবনের অনেক বড় একটা ব্যাপার ঘটে গেল। পরের কটা দিন একটা ঘোরের মধ্যে পার হয়ে গেল। শুধু মনে হলো, জীবনটা এমন কেন? এক ধরনের স্বপ্ন কিংবা দুঃস্বপ্নের মাঝামাঝি একটা অবস্থানে রাহেলার কয়েকটা দিন কেটে গেল। সেই অবস্থায় প্রথম ছেদ পড়ল যখন রাহেলা শুনল, দুই সপ্তাহ পরে জামিলের সঙ্গে রাহেলা কানাডা যাচ্ছে।
কানাডা, এখন? আমার ফাইনাল? আরে রাখো তোমার ফাইনাল, মামা বললেন। এসব পরেও করতে পারবে। আর কী দরকার। কানাডা গিয়েও তুমি পড়ালেখা করতে পারবে। এখন তোমার প্রথম কাজ হলো জামিলের সাথে যাওয়া। জামিল পিএইচ ডি করতে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে তোমাকে ওর খুব দরকার। কানাডা যাও। সেটল কর। তারপর আস্তে আস্তে সব করতে পারবে। একটা প্রায় সম্পূর্ণ স্বপ্নের সমাধি রচনা করে আরেকটা অনাগত স্বপ্নের হাত ধরে ঠিক চব্বিশ বছর আগে রাহেলা জামিলের হাত ধরে কানাডা আসে।
এরপর দ্রুত পাল্টে যায় দৃশ্যপট। রাহেলা খুব সহজেই চিনতে শুরু করে জামিলকে। এ যেন সবকিছুকে নতুন করে চেনা নতুন করে জানা। জীবনের ছক এমনি করেই বিধাতা একে রাখেন যে চাইলেই তাকে পাল্টানো যায় না। বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই রাহেলার ভেতরে আরেক জীবন চলে আসে। বছর ঘুরতেই চলে আসে তন্বী। তন্বীর আগমন রাহেলার সবকিছুকে ওলট পালট করে দেয়। আবার নতুন স্বপ্ন দানা বাঁধে তন্বীকে ঘিরে। ভুলে যেতে চায় জামিলের দ্বিমুখী আচরণের কথা। ভুলে যেতে চায় জামিলের ভদ্রবেশী চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা আরেকটি পশুকে। জামিল নানা ভাবে রাহেলাকে কষ্ট দিতে থাকে। এক, দুই, তিন বছর গড়িয়ে গেল। জামিলের পিএইচ ডি করা হয়নি। বিয়ের আগেই জামিল কানাডার রেসিডেন্সি পেয়েছিল। এখন কি সব ব্যবসা বাণিজ্য করে। ওসব নিয়েই সারা দিন ব্যস্ত। রাহেলার সময় কাটে তন্বীকে নিয়ে। এখনো প্রতিদিন একেকটা নিত্য নতুন স্বপ্ন রাহেলাকে বাঁচতে শেখায়। পড়ালেখা? সে অনেক দুরের কথা। জামিল বলে আরে এই দেশে এত পড়ালেখা করে কী হয়? দেখলে না আমিই তো ডিগ্রি শেষ করলাম না। আর তোমার তো কোনো সমস্যা নাই। টাকা পয়সার কী কোনো কমতি আছে? সেই ব্যবসার শুরুতেই জামিল প্রথম ধাক্কাটা দেয় রাহেলাকে, রাহেলার বাবাকে। তার কিছু টাকা লাগবে। রাহেলা বলে আমার বাবা এত টাকা কোথায় পাবেন? জামিল বলে, একমাত্র মেয়ের সুখের জন্য তোমার বাবা তার গ্রামের জমি জমা বিক্রি করতে পারবেন না? কি বল এসব? ঠিকই বলি, রাহেলা জবাব দেয়। জামিল চিত্কার করে বলে, আমার টাকা লাগবে। তুমি আমার বউ। আমার ব্যবসায় তোমারও কন্ট্রিবিউশন থাকা উচিত। রাহেলা উত্তর দেয়, আমাকে তুমি কাজ করতে দাও বাইরে। আমি তো কাজ করতেই চাই। জামিল আরও রেগে যায়, কাজ কাজ করো না তো। ভালো পরিবারের মেয়েরা এ দেশে কাজ করে না। রাহেলার কাজ তো দূরের কথা, এমনকি বাসায় লোকজনের যাতায়াতও অনেক সীমাবদ্ধ ছিল। জামিলের নিকট আত্মীয়রা ছাড়া আর কেউ খুব একটা আসত না। বাইরের পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলা বলতে গেলে একদম হারাম ছিল। আর জামিল? যাচ্ছেতাই করে বেড়াত। সারাক্ষণ ব্যবসার নাম করে ফোন, skype, ফেইস বুকে নামে বেনামিতে অনেক আইডি ছিল। নিজে মন খুলে কারও সঙ্গে কথা বলতেও পারত না রাহেলা। রাহেলার ফোনে জামিল সব সময় আড়ি পাতত। রাহেলা অসহায় ছিল। সব দেখেশুনেও অবলীলায় সহ্য করে যেতে হয়েছে। ওই যে বললাম, বিধাতার বেঁধে দেওয়া ছকের বাইরে রাহেলা কখনই বেরিয়ে আসতে পারেনি।
একদিন বাবার ফোন পেল রাহেলা। ফোন পেয়ে বাকরুদ্ধ রাহেলা। বাবা বললেন, জামিল ফোন করে বলেছে তার অনেক টাকা লাগবে। খুব জরুরি। আমি যেন দ্রুত টাকা পাঠাই। আজ রাহেলা মুখ খুলল। এত দিন যেই কষ্ট শুধু নিজের মধ্যেই ধারণ করেছে আজকে তা ঝরে পড়ল। বাবাকে সাবধান করে দিল একটা টাকাও যেন জামিলকে না দেয়। বাবা বললেন তিনি ইতিমধ্যেই ১০ লাখ টাকা জোগাড় করে জামিলের বাবার কাছে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। আরও টাকা জোগাড়ের ব্যবস্থা চলছে। শীঘ্রই পাঠিয়ে দেবেন। রাহেলার শুধু চিত্কার করে কান্না করা ছাড়া আর কিছুই করার রইল না।

প্রতীকী
প্রতীকী

এর কদিন পরে রাহেলা হঠাৎ শুনতে পেল জামিল ফোনে কারও সঙ্গে ঝগড়া করছে। রাহেলা এগিয়ে যেতেই ঝপাৎ​ করে মুখের ওপরে দরজা বন্ধ করে দিল জামিল। রাহেলার মনে সন্দেহ হয়। আড়ালে দাঁড়িয়ে সব কথা শোনার চেষ্টা করল। রাহেলার বুঝতে বাকি রইল না ওপাশে তার বাবা ছিল। কী সব বিশ্রী ভাষায় গালাগালি। রাহেলা আর দাঁড়াতে পারল না। নিজের কান চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ল। এরপর কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। অনেকক্ষণ পর জামিল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাহেলার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। বলল, রাহেলা এখনই তোমাকে দেশে যেতে হবে। তোমার বাবা হাসপাতালে। তুমি সব গুছিয়ে নাও, আমি টিকিটের ব্যবস্থা করছি। রাহেলা মামাকে ফোন করে জানল তার বাবা কিছুক্ষণ আগে জামিলদের বাসায় হার্টঅ্যাটাক করে মারা গেছেন। নিস্প্রাণ পাথরের মতো রাহেলা তার সুটকেস গোছাতে লাগল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, সন্ধ্যা হলো। জামিলের খবর নাই। মাঝরাতে জামিল বাসায় ফিরে জানাল, না টিকিট পাওয়া যায়নি। আগামী এক সপ্তাহেও যাওয়া যাবে না। রাহেলা যা বুঝার বুঝে নিল। না রাহেলা তার বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পায়নি।
এর পরে সুদীর্ঘ সময়ের কাহিনি। সময় চলে গিয়েছে ধীরে। তন্বী বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করেছে। একদিন তন্বীরও বিয়ের প্রস্তাব আসল। বিয়ে হলো। লন্ডনপ্রবাসী রাশেদের হাত ধরে তন্বী কানাডা থেকে লন্ডনে চলে গেল। নাটকের একই দৃশ্যপট আবার শুরু হলো। শুধু পাত্রপাত্রী ভিন্ন। রাহেলার মা ছিল না, তাই কষ্ট শেয়ার করার কেউ ছিল না। কিন্তু তন্বী তো সবই রাহেলাকে বলত। রাহেলা এখন কি করবেন? তন্বীকে বলবেন সব ছেড়ে ছুড়ে চলে আসতে? তিনি তা অনেকবার বলেছেন। কিন্তু তন্বী শোনেনি। তন্বী শুধু বারবার বলেছে দেখি না মা কী হয়। মানুষ তো বদলাতেও পারে। কী আর করা, রাহেলার নিজেরই তো মেয়ে। না রাশেদ একটুও বদলায়নি। অনেক ঘটনার পর জামিল সাহেব একদিন ফোন পান রাশেদের কাছ থেকে। রাহেলা এবারও পাশে দাঁড়িয়ে। সব শুনতে পায়। ওপাশ থেকে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। এক সময় জামিল সাহেবের হাত থেকে ফোনটি নিচে পড়ে যায়। রাহেলা ৯১১ কল করেন। জামিল সাহেবের স্ট্রোক করে শরীরের নিচের অংশ পুরোটাই অবশ হয়ে যায়। মুখের বাম পাশটাও অবশ হয়ে যায়। তিনি সব বুঝতে পারেন শুনতে পারেন কিন্তু বলতে পারেন না। রাহেলার তৃতীয় সত্তা আজকে রাহেলাকে বলছে তুমি তো এই দিনটির জন্যই অপেক্ষা করছিলে রাহেলা। ভেবে দেখ তোমার বাবার সঙ্গে জামিল কী ব্যবহার করেছিল? তুমি নিজে তো তার শোধ নিতে পার নাই। হ্যাঁ, ঠিক তাই। এমন একটা কিছু জামিলের পাওনা ছিল। রাহেলার বাবা তো মরে গিয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু জামিল বেঁচে থেকে তার পাপের প্রতিফল ভোগ করে যাবে। এর চেয়ে বড় প্রাশচিত্ত আর কী হতে পারে। যদিও জামিলের এই পঙ্গুত্বের বোঝা রাহেলাকেই বয়ে বেড়াতে হবে তবুও এই জামিলকে নিয়ে রাহেলা আজ এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ অনুভব করে। এখনো তো অনেক বাকি। রাহেলার সঙ্গে যা যা করেছে তার কোনো প্রতিশোধ তো রাহেলা এখনো নেয়নি। কোনো দিন নেবেও না। নিতে হয় না আসলে। বিধাতা সব বিচারই করেন। জামিলের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের শাস্তি জামিল পাচ্ছে। সবাইকে পেতে হয়, সবাই পায়।
রাহেলা বেগম এবার সুন্দর করে জীবনকে সাজাবেন। তন্বীকে আবার একটা ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবেন। নিজের জীবন আর কদিন। ২৪ বছরের সব না পাওয়ার বেদনাকে ভুলবেন তিনি। এক জীবনে সব শেষ হয়ে যায় না। জীবন অনেক বড়, জীবন অনেক সুন্দর। এই জীবন রাহেলা আর তন্বীর মতো সুন্দর মনের মানুষেরা সাজিয়ে দেয়, রাঙিয়ে দেয়, ভরিয়ে দেয় আর যুগে যুগে জামিল আর রাশেদের মতো নোংরা কুৎসিত মানুষেরা জীবনকে কলঙ্কিত করে, কলুষিত করে, নিঃশেষ করে, জীবনকে অসহনীয়, অর্থহীন করে তোলে। মানুষের অনেক কৃতকর্মই তার নিজের জীবনে বুমেরাং হয়ে আসে। অনেকেই সেটা বোঝে না, বুঝতে পারে না।
তন্বী এসেছে অনেক দিন পর। রাহেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন আর ভাবেন কী সুন্দর তার এই মেয়েটা। এই মেয়ের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আজ তিনজনে বসেছে ওদের ড্রয়িং রুমে। বাইরে রোদেলা আকাশ। সামনের মাঠ পেরিয়ে সবুজ বন। মাঠে দুটি ছেলেমেয়ে খেলছে। দূরে একটু দূরে ওদের মা কী অপলক তাকিয়ে আছে ছেলেমেয়েদের দিকে। আস্তে আস্তে বিকেলের সোনালি রোদ আজকে রাহেলা বানুর ঘরে চলে এসেছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। তন্বী এমনি করে থাকুক তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে, যুগ যুগ ধরে, অনন্তকাল। মেয়ের মাথায় চুলের গভীরে বিলি কাটতে গিয়ে একসময় রাহেলা বানু হারিয়ে যান সুদূর অতীতে। আর দুফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পরে তন্বীর গোলাপি গালে। তন্বী মাকে আরও সজোরে জড়িয়ে ধরে। পেছনে হুইল চেয়ারে জামিল সাহেব বসে থাকেন। তার মুখের বাম পাশটা সজোরে কাপতে থাকে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম এই দৃশ্যটি তিনি উপভোগ করতে পারেন কি না কেউ জানে না।

(লেখক কানাডার সাস্কাচেওয়ান প্রদেশের সাস্কাতুনপ্রবাসী)