আশ্রয়প্রার্থীদের জেলে পোরা নীতি

নিজের ঘরকেই মানুষ সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে করে। চেনা পরিবেশ ও পরিজনই তার প্রধান কারণ। কিন্তু তারপরও বহু মানুষকে এই ঘর ছাড়তে হয়। বলা যায় ঘর ছাড়তে বাধ্য হতে হয়।
একজন ব্যক্তি কখন তার চেনা সবকিছু ছেড়ে অজানা–অচেনার পথে যাত্রা করে, তা সহজেই অনুমেয়। অপরিচিতের দরজায় কড়া নাড়ার আগে তাকে বহু কিছুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হয়। বারবার ফিরে দেখতে হয়, যদি পারা যায়, যদি থাকা যায় প্রিয় প্রাঙ্গণে। এই চেষ্টার একেবারে শেষে পৌঁছালেই কেবল একজন ব্যক্তি তার ঘর ছেড়ে অপরিচিতের দরজায় কড়া নাড়ে।
দেশান্তরি মানুষের দুঃখ কেবল তার মতো মানুষেরাই বোঝে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সভ্য ও আধুনিক মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শুধু নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই সে অন্যকে বিচার করবে না। তার একটি পূর্ণদৃষ্টি থাকবে সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে, যেখানে ধরা পড়বে বিদ্যমান বিভিন্ন অসংগতি, মানুষের সামষ্টিক যন্ত্রণার উৎস ও তার নিদানের উপায়। এই যে দৃষ্টি, এটিই কিন্তু মানুষের মানবিক বোধের মূল ভিতটি গড়ে দেয়। এই মানবিক বোধকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রীতিনীতি গড়ে উঠেছে।
আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দেওয়াটা অনেক প্রাচীন রীতি। প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে তাবৎ সভ্যতায় এই নীতি অনুসৃত হয়েছে। এমনকি কোনো অপরাধীও যদি কারও আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাঁকে আশ্রয় দেওয়ার রীতি রয়েছে। আধুনিক বিশ্বে জাতিসংঘ আশ্রয়প্রার্থীদের আশ্রয় পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে সেই ১৯৫১ সালেই। এর আগেই অবশ্য মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণায় এই অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এই ঘোষণা ও স্বীকৃতির বাইরে নয় আমেরিকাও।
আমেরিকা এই নৈতিক বাধ্যবাধকতাকে এত দিন সম্মান করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ এই আমেরিকাতেই আশ্রয় পেয়েছিল। এতে আমেরিকাও লাভবান হয়েছে। বিশ্বের কাছে নিজের মর্যাদা যেমন বেড়েছে, তেমনি তার অর্থনীতি ও জনসমাজও বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু এখন এই ২০১৯ সালে এসে এই আমেরিকাই উল্টো পথে হাঁটছে।
১৬ এপ্রিল মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম পি বার অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন মীমাংসার আগ পর্যন্ত তাদের আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এত দিন আশ্রয় প্রার্থনার ওপর ‘বন্ড হিয়ারিং’-এর বিধান ছিল, যাতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জামিনে মুক্ত থাকতে পারেন। কিন্তু এ আশ্রয়প্রার্থীদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানার আগ পর্যন্ত বন্দী থাকতে হবে। নিজ দেশে সন্ত্রাস, নির্যাতন এমনকি হত্যার আশঙ্কা থেকে পালিয়ে আসা মানুষকে জেলে পোরার যে নীতি আমেরিকা নিল, তা মানবিকতার সর্বজনীন মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল। এই নির্দেশনা ৯০ দিন পর কার্যকরের কথা বলা হলেও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমি কোনো খেলা খেলছি না’ বক্তব্য বলে দেয়, এই অমানবিক নীতি থেকে সহজে সরবে না প্রশাসন। অথচ এই ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকাকে আবারও গ্রেট’ বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মানবিকতার পথ থেকে সরিয়ে তিনি কোন ‘গ্রেট’ আমেরিকা নির্মাণ করছেন, তা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। তিনি সত্যিকার অর্থেই আমেরিকাকে সেরা করতে চাইলে মানবিকতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এই সত্যকে উপলব্ধি করে প্রশাসন আশ্রয় ও অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রতি মানবিক আচরণের পথে ফিরে আসুক।