সাংবাদিকতায় অর্ধশত বছর

এম বশীর আহমেদ
এম বশীর আহমেদ

১৯৪৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় জালালপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক এম বশীর আহমেদের জন্ম। বাবা ইউনুস আলী ছিলেন অবিভক্ত আসামের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। ঠিকাদারি ব্যবসা আসামের ডিব্রুগড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সালে আসামের সংঘটিত অহমি ও বাঙালির জাতিগত দাঙ্গার পাশাপাশি হিন্দু–মুসলিমদের মধ্যে আরও একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঠিকাদারি ব্যবসা গুটিয়ে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একাধিকবার নির্বাচিত হয়ে বিভিন্ন জনহিতকর কর্মকাণ্ডে আত্মনিয়োগ করে নিজেকে একজন বিচারক, সমাজহিতৈষী লোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
তৎকালীন প্রভাবশালী ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান এম বশীর আহমেদ ছিলেন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। শৈশব, কৈশোরসহ জীবনটাই কাটে দুরন্তপনায়। জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে বিত্তশালী বাবার উদার সহযোগিতায় এ জাতীয় জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেন তিনি। গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পর তাঁর এক দাদা স্বনামধন্য প্রধান শিক্ষক সিদ্দিক আলীর তত্ত্বাবধানে থেকে পড়ালেখা করতে ছাতকের জুনিয়র হাইস্কুলে যান। সেখানে দুই বছর পড়াকালে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তখন দাদা তাকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার চেষ্টা করেন। একসময় দাদার কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার বেড়াজাল ছিন্ন করে পাড়ি জমান সিলেট শহরে। এখানে প্রথমে দ্য এইডেড হাইস্কুল ও রাজা জি সি স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন। ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হতে হন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট শহরের কাছে লালা বাজার হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখানেও আন্দোলন-সংগ্রামের যুক্ত থাকায় নিয়মিতভাবে মেট্রিক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। ১৯৬১ সালে সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬২ সালে এম সি কলেজে আই কমে ভর্তি হন।
এম বশীর আহমদ সিলেট মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন। এসব আন্দোলন–সংগ্রামের কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রথমে তাঁকে বহিষ্কারের হুমকি ও পরে কলেজে ঢোকার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। সব প্রতিকূল অবস্থার মোকাবিলা করে এমসি কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে আই.কম. পাস করেন। মদন মোহন কলেজে বি. কম ক্লাসে অধ্যয়নকালে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬৫-৬৬ সালে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কলেজের ভিপি নির্বাচিত হন। একই সময়ে সিলেট জেলা ছাত্রশক্তির (এস এফ) সভাপতি থাকাকালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বশীর আহমেদ।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান ১৯৬৬ সালের ১৮ আগস্ট সিলেটের স্থানীয় সার্কিট হাউসে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তৃতাকালে বিক্ষোভ ও জুতা নিক্ষেপের মামলার আসামিদের অন্যতম ছিলেন বশির। গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হলেও তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। আত্মগোপনে থাকাবস্থায় ১৯৬৮ সালে মদনমোহন কলেজ থেকে বি.কম. পাস করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী ছিলেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বড়বোন ফাতেমা জিন্নাহ। নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৬৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর সিলেট রেজিস্ট্রি মাঠে বিশাল সমাবেশ হয়। ফাতেমার এই নির্বাচনী প্রচারণায় দেওয়ান ফরিদ গাজীসহ (তৎকালীন সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গনে গাজী-বশীরকে বলা হতো মানিকজোড়) অন্যান্য নেতার সঙ্গে এম বশির আহমেদ জেলার বিভিন্ন স্থানে সভা সমাবেশে বক্তৃতা করেন।
১৯৬৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল ল’ কলেজে আইনে অধ্যায়নকালে প্রথমে ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হন বশীর আহমেদ। একই সময়ে পড়ালেখার পাশাপাশি ব্যারিস্টার শওকত আলীর মালিকানা ও সম্পাদনায় বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক জনতার বার্তা পত্রিকায় যোগ দেন। পত্রিকাটিতে খণ্ডকালীন সাংবাদিকতায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। প্রথমে নেশা হিসেবে নিলেও পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রণাঙ্গন থেকে যে কয়জন হাতেগোনা সংবাদকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলমযুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখেন, বশির আহমদ ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আগরতলা থেকে স্বাধীনতার পক্ষের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত সাপ্তাহিক জনতায় স্বনামে, বেনামে লেখা তাঁর সংবাদ মুক্তিযোদ্ধাদের ও দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের মনে শক্তি, সাহস ও প্রেরণা জোগায়। মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পান তিনি।
স্বাধীনতার পর দেশের প্রাচীনতম পত্রিকা দৈনিক আজাদের যোগ দেন বশীর আহমেদ। এখানে কূটনৈতিক প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ’৭৪ সালের দিকে তিনি দৈনিক সংবাদে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে অপরাধ বিষয়ক প্রতিবেদনে সাফল্য দেখান। ’৯৭ সালে সংবাদের বিশেষ প্রতিনিধি হন।
স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অপরাধপ্রবণতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। তখনই জাতীয় দৈনিকে কর্মরত ক্রাইম রিপোর্টারদের এক সভায় ১৯৮৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রমনাগ্রীনে গঠন করা হয় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (ক্র্যাব)। এর যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন বশীর আহমেদ। সংবাদপত্রে যত দিন সম্পৃক্ত ছিলেন, তত দিন নাম–যশ–খ্যাতির পাশাপাশি সততা-নিষ্ঠা ও সাহসের সঙ্গে কাজ করেন। বিরামহীন সাংবাদিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
বশীর আহমেদ ছিলেন একজন আদর্শবান অসাম্প্রদায়িক ও মুক্ত মনের মানুষ। শারীরিক অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে ২০০১ সালের প্রথম দিকে তিনি দৈনিক সংবাদ থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যান। তাঁর সহধর্মিণী ফয়জুন্নেসা আহমেদ দিলারার মালিকানা ও সম্পাদনায় ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল সাপ্তাহিক দেশ সমাচার পত্রিকায় প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নানা কর্মব্যস্ততার মাঝেও স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে রয়েছে তাঁর বিশেষ অবদান। সুনামগঞ্জকে জেলায় রূপান্তরের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে জোরালো বক্তব্য দেন। সিলেট বিভাগ বাস্তবায়ন পরিষদের উপদেষ্টা হিসেবে সভা-সমাবেশ-মিছিল এবং ঘেরাও আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ঢাকাস্থ জালালাবাদ অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে ও ছাত্রদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে বশীর রাজধানী ঢাকাসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশে বক্তৃতা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ স্বাধীনের পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে যোগ দেন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাকে সাড়া দিয়ে বাকশালে যোগ দেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে আবদুস সামাদ আজাদ জগন্নাথপুর সংসদীয় আসন ছেড়ে দেওয়ায় এই আসনে উপনির্বাচনে প্রার্থী হন বশীর। জনমত জরিপ ও আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সিদ্ধান্তে তিনি যোগ্য প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্তে শেষ পর্যন্ত তাকে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। ফলে আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত ছাতকের এই আসনটি আওয়ামী লীগের হাত ছাড়া হয়। এ নিয়ে স্থানীয় স্থানীয় নেতা–কর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছিল।
দৈনিক সংবাদের ক্রাইম বিটের প্রধান ও সাপ্তাহিক দেশ সমাচারের প্রধান সম্পাদক বশীর আহমেদ গত ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে আটটায় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী সাংবাদিক আবাসিক এলাকার জামে মসজিদে জানাজা শেষে পাশের কালশী গোরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
প্রায় অর্ধশত বছরের সাংবাদিকতা জীবনে এম বশীর আহমদ জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটের স্থায়ী সদস্য এবং বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। দীর্ঘ ২৫ বছরের কর্মস্থল দৈনিক সংবাদ পরিবার, ক্র্যাবের সভাপতি আবুল খায়ের ও সাধারণ সম্পাদক দিপু সারওয়ারসহ কার্যনির্বাহী পরিষদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়।
অনেকেই বলেছেন, দাপুটে ক্রাইম রিপোর্টার বশীর আহমেদের মৃত্যুতে ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন একজন অভিভাবক হারাল। সিলেট প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি প্রবীণ সাংবাদিক মো. মাহবুবুর রহমান ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, সত্তর-আশির দশকে সাংবাদিক হিসেবে ঢাকায় ব্যাপক পরিচিতি ছিল বশীর আহমেদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক হিসেবে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।