ধর্ষণ মামলার সময় বেঁধে দিন

নুসরাত জাহান
নুসরাত জাহান

সমাজে ধর্ষণ এখন মহামারি আকার ধারণ করেছে। কী ঘরে, কী বাইরে—কোথাও নিরাপদ নয় নারী ও শিশুরা। এর মূল কারণ সামাজিক, রাজনৈতিক, পারিবারিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। সমাজে কোনো নারী যৌনতার বা ধর্ষণের শিকার হলে প্রথমেই মেয়েটির চরিত্রের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়। পরিবার থেকে বলা হয়, চেপে যা। কারণ তাকে না হয় সামাজিকভাবে হেয় হতে হবে। আর যদি কোনো কারণে মেয়েটি সাহস করে বিচার চায়, সেখানে তাকে আরও বেশি লাঞ্ছিত হতে হয়। রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে আসে, প্রভাব খাটায়। দাঁড়িয়ে যায় ধর্ষকের পক্ষে। ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে তারা। শুরু হয়ে যায় লেনদেন, টাকার খেলা। আইনের লোকেরাও পিছিয়ে থাকে না। তারাও যোগ দেয়। এতে করে নির্যাতিত মেয়েটি গুটিয়ে যায় ভয়ে, না হয় আপস করে ফেলে। কারণ তখন সে জেনে যায়, আর যাই হোক বিচার পাবে না, বরং উল্টো তাকে হয়রানির শিকার হতে হবে।
এই যে বিচার না পাওয়ার ধারাবাহিকতা, তার থেকেই অপরাধীরা আরও বেশি অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তারা নিজেদের বিচারের ঊর্ধ্বে মনে করে। মাত্র কিছুদিন আগে ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে দেখেছি এর বাস্তব চিত্র। নুসরাত যখন সাহস করে বিচার চেয়েছে, তাকে কী নির্মমভাবে না মরতে হয়েছে।
নুসরাতের সহপাঠী থেকে আরম্ভ করে অধ্যক্ষ, আইনের লোক, রাজনীতিবিদ অনেকে জড়িত এই হত্যাকাণ্ডে। একে একে বেরিয়ে আসছে অপরাধীদের পাহাড়সম অপরাধ কর্মকাণ্ড। এখানে একজন বা দুজন নয়, সমাজের অনেকেই জড়িত। চারজন জবানবন্দি দিয়েছে। এটি হচ্ছে সমাজের মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়ের বাস্তব প্রমাণ। চলতি বছরের গত সাড়ে তিন মাসে ৩৯৬ জন নারী-শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। খোদ পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৩৯টি এবং হত্যা মামলা হয়েছে ৩৫১টি।
এই যে এত এত অপরাধ হচ্ছে কয়টার বিচার হয়েছে? না হয়নি। আর হয়নি বলেই দিন দিন বেড়ে চলছে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন। আমাদের দেশে আইন আছে কিন্তু যথাযথ প্রয়োগ নেই। খাতা কলমে আইন থাকলে তো হবে না, প্রয়োগ করতে হবে যথাযথ। মানুষ নির্যাতিত হয়ে আইনের আশ্রয় চেয়ে না পেলে হতাশ হয়, তখন সেও খারাপ পথে পা বাড়ায়। ভাবে কী লাভ এত ভালো মানুষ হয়ে। কেউ তো মূল্য দিচ্ছে না। বিরূপ মনোভাব তৈরি হয় সমাজের প্রতি, আইনের প্রতি। আর ব্যক্তির যখন নৈতিকতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়, তখন সে ভুলে যায় ন্যায়নীতি, লজ্জা–শরম। অপরাধ তার কাছে মামুলি বিষয় হয়ে যায়। খাদ্য অভ্যাসের মতো নিত্যদিন অপরাধ করে যায়। এক সময় হয়ে উঠে বড় সন্ত্রাসী।
যারা তাদের মূল্যবোধ ঝেড়ে ফেলতে না পারে, তারা চুপসে যায়। নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখে। আমাদের আইনের লোকেরা বেআইনি কাজ করলে, অর্থাৎ আইন ভঙ্গ করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিলে তাকে জবাবদিহি করতে হয় না। সে জানে, তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে মাত্র। সে আবার বহাল তবিয়তে ফিরে আসতে পারবে। কিন্তু তার যদি জবাবদিহি থাকত, আইনলঙ্ঘন প্রমাণিত হলে সাময়িক নয়, তার অপরাধের ওপর নির্ভর করে শাস্তি পেত, তাহলে আইনের লোক হয়ে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে, ধর্ষকের সঙ্গে হাত মিলাত না। একজন ধর্ষিতা যখন আইনের আশ্রয় চাইতে যায়, উল্টো তাকে অপমান করা হয়। সহযোগিতা দূরে থাক, তাকে এমন এক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে যে, সে নিজেই আর অপমানিত হতে চায় না।
আর নষ্ট রাজনীতি তো আছেই। আইনের লোকেরাও মাথা ঝুঁকে তাদের কাছে। বিশেষ করে স্থানীয় রাজনীতির চিত্র ভয়াবহ। আমরা দেখেছি, একজন লম্পট সিরাজকে বাঁচাতে আইনের লোক হতে শুরু করে রাজনীতিবিদ পর্যন্ত একাকার হয়ে গিয়েছিল। তার মূল কারণ অর্থ। সেটি যেভাবেই আসুক—অনৈতিক বা অসৎ উপায়ে, সবাই মিলে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সবকিছুর ঊর্ধ্বে মনে করে। ক্ষমতা ও অর্থ এই দুই যখন অসৎভাবে ব্যবহার হয় তখন অপরাধ বেড়ে যায়। নারীদের এমনিতেই সমাজে দুর্বল ভাবা হয়। আর ধর্ষণের ক্ষেত্রে ধর্ষক মনে করে, কী করবে? ধর্ষিতা আইনের আশ্রয় নেবে? কিন্তু আইন আমাদের পকেটে, ভাবে ধর্ষক।
টাকা দিয়ে সবকিছু ঠিক করে ফেলব এবং তাই হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। এখানে আইন মুখ থুবড়ে পড়ে। আরেকটি বিষয় উঠে আসছে ধর্ষণের ক্ষেত্রে। দেখা যায় বেশির ভাগ ধর্ষক মাদকে আসক্ত, বিশেষ করে ইয়াবা। অনেক সময় বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে পুলকিত হয়েও কিছু তরুণ ইয়াবা সেবন করে। মুঠোফোনে নীল ছবি দেখে মনে খায়েশ জাগে নারীকে কাছে পাওয়ার। সেটা যেভাবেই হোক। কী বিবাহিত বা বান্ধবী বা প্রতিবেশী তার একজন নারী চাই–ই চাই। আর একবার পেয়ে গেলে ছুটতে থাকে সবকিছু তোয়াক্কা না করে। তখন তার কাছে আইন, ন্যায়নীতি সবকিছু তুচ্ছ। শুধু যে যুবসমাজ, তা না। শিক্ষিত–অশিক্ষিত সবাই এই কাতারে আছে। আছে মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজের শিক্ষক ও ছাত্ররা। এ ক্ষেত্রেও আইনের প্রয়োগ নেই। আর কোনো ধর্ষিতা যদি সাহস করে আইনের আশ্রয়ও নেয় কোর্ট পর্যন্ত মামলা যায়, দেখা যায় দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এই মামলা। ধর্ষিতা তো বিচার পায় না, উল্টো অর্থনৈতিকভাবে হেয় হয়। সামাজিকভাবে তার পরিবার হেয় হয়। যেন এ তাদের লজ্জা। যেন এ তাদের অপরাধ।
বিচারহীনতার এই দীর্ঘসূত্রতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। একটা সময় বেঁধে দিতে হবে এসব মামলার ক্ষেত্রে। সোনাগাজীর নুসরাতের মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করা হবে। কিন্তু সমাজের কয়টা বিচার এভাবে হবে? যেখানে প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে নারী। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগ পারে সমাজ থেকে ধর্ষণ কমাতে।