আপন গৃহে পরবাসী

জামান সাহেব আর রাগিব সাহেব দুই ব্যবসায়িক পার্টনার বা অংশীদার মিলে অবশেষে ম্যানহাটনের রেস্তোরাঁ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ হিসেবে জানা গেল, পাশেই আরেক নামীদামি ভারতীয় রেস্তোরাঁ তাদের খাবারের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। কাজেই জামান সাহেবদের দোতলার রেস্তোরাঁয় গ্রাহক সমাগম কমে যাবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাংলা সাপ্তাহিকে শুরু হলো বিজ্ঞাপন দেওয়া।
দীর্ঘদিন পরও কোনো ক্রেতা না পেয়ে অনেকটা হতাশ হলেন দুজন। দামের পরিবর্তন না করে মেন্যুতে খাদ্যের পরিমাণ বাড়িয়েও মাস শেষে অর্থ পকেটে আসা তো দূরের কথা, সব বিল পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়।
অবশেষে এক ভারতীয় ক্রেতা মিলে গেল, দামের কিছু ছাড় দিয়ে সত্যিই একদিন রেস্তোরাঁ বিক্রি হয়ে গেল। বেশ কিছু নগদ ডলার মুনাফা হলো। রাগিব সাহেব চলে গেলেন তাঁর আগের চাকরিতে। জামান সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি করবেন না। তিনি ব্যবসা করবেন, পরিচিত এক রিয়েলটর বাড়ি কেনার পরামর্শ দিলেন। কম পুঁজি খাঁটিয়ে অল্প দিনে বেশি মুনাফা। বেচা–বিক্রির ঝামেলা ক্রেতাকে নিতে হবে না, সব ব্রোকাররা করে থাকে।
অকশনের বাড়ি কিনতে পারলে ভালো মুনাফা। তিন শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে পছন্দের বাড়ি কেনা যায়। ব্রোকার ফি ক্রেতাকে দিতে হয় না। এভাবেই বোঝালেন রিয়ালটর মঞ্জু ভূঁইয়া। প্রস্তাবটা শুনেই জামান সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। মুহূর্তেই যেন সম্মোহিত হয়ে গেলেন।
মঞ্জুকে আশ্বাস দিয়ে জামান সাহেব বলেন, ঠিক আছে, আপনি সাহায্য করেন তাহলে তো কথা নেই, আমি প্রস্তুত। ব্যাংকের বাড়ি পেলে জানাবেন।
রাতে বালিশে মাথা রেখে গরল অঙ্ক সরলভাবে মিলিয়ে নিলেন জামান সাহেব। স্ত্রী সালেহা বেগমের সঙ্গে ব্যাপারটা শেয়ার করবেন কি না, তাই নিয়ে ভাবছেন। তারপর ঠিক করলেন, না এখন এসব কথা স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ না করাই ভালো। কারণ সালেহা বেগম সবকিছু বোঝার আগেই একটা বাঁধা দিয়ে বসবেন। বাঁধা দেওয়ার কারণও আছে, রেস্তোরাঁ বিক্রির সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলেন, বর্তমান বাড়ির মর্টগেজটা যতটুকু পারো পরিশোধ করে দাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
জামান সাহেব কথাটা কানে না নিয়ে আবার নতুন ধান্দায় যাচ্ছেন, বিষয়টা সালেহা বেগম কিছুতেই মেনে নেবেন না।
সপ্তাহ দিন যেতে না যেতেই ব্রোকার মঞ্জু ভূঁইয়ার ফোন, জামান সাহেব ব্যাংকের বাড়ি নিলামের তারিখ পেয়ে গেছি। এবার অনেক বাড়ি নিলামে এসেছে, প্রায় সবগুলো বাড়িই অভিজাত এলাকায়। যে কয়েক দিন হাতে আছে, বাড়িগুলো সরেজমিনে দেখে নেওয়া ভালো, আপনি কি বলেন? জামান সাহেব বলেন, ঠিক আছে, আপনার সুবিধে মতো সময় বের করে আমাকে জানাবেন।
ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সব কয়টা বাড়ি দেখা হলো, ভালো লোকেশনের বাড়িগুলোর একটিও অক্ষত পাওয়া গেল না। কোনোটি আগুনে পোড়া, কোনোটি অর্ধেক ধ্বংস হয়ে গেছে দেখে জামান সাহেবের মন ভরল না। মঞ্জু ভূঁইয়া আশ্বাস দিলেন, দরুন আসল দামের অর্ধেকে যদি এসব এলাকার বাড়ি পাওয়া যায়, তা হলে মেরামত বাবদ কয়েক হাজার ডলার খরচ হলেও ক্ষতির কিছু নেই। মেরামত কাজের লোকও আমার জানাশোনা। ওরা কম খরচে আমার কাজ করে দেবে। জামান সাহেব আশ্বস্ত হলেন।
নিলামের তারিখে আদালতে যেতে হবে, আগের দিন মঞ্জু ভূঁইয়া ফোন দিয়ে জানালেন, হাজার তিরিশেক ডলারের ব্যাংক কর্তৃক সত্যায়িত চেক সঙ্গে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে ৩০ হাজার ডলারের চেক নিলেন জামান সাহেব।
কোর্ট হাউস লোকে লোকারণ্য, কয়েকজন পরিচিত লোকের সাক্ষাৎও পাওয়া গেল।
জামান সাহেব লক্ষ্য করলেন, সবার সঙ্গেই একেকজন রিয়ালটর ব্রোকার। কারণ ব্রোকার ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে কেউ নিলামে হাজিরা দেওয়ার নিয়ম নেই। নিলামের কোনো অভিজ্ঞতা নেই জামান সাহেবের। দেশে থাকতে দেখেছেন, গ্রামের মসজিদে জুমার নামাজের পরে মসজিদের জমি নিলাম হতো। গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কিছু জমি মসজিদের নামে দান করতেন। এই জমিগুলো বছরে একবার নিলাম হতো। জামান ভাবছেন, এই নিলামও কি একই তরিকায় হবে? এবার ভাবছেন, একই তরিকায় কেন হবে, এটা আমেরিকার নিলাম বলে কথা। এক সময় সব চিন্তাভাবনার সমাপ্তি ঘটিয়ে নিলামের কার্যক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
কোর্ট হাউসে সুনসান নীরবতা। প্রত্যেকটা দরজা বন্ধ করে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা। এক পাশে সরকারি উকিল, ব্যাংকের উকিল বসা।
মধ্যখানে একজন বিচারক উঠে এসে নিলামের নিয়মকানুন বলে দিলেন। তারপর বিশেষ পোশাক পরিহিত প্রায় ছয় ফুট লম্বা সাদা একজন বাড়ির বর্ণনাসহ নিলাম ডাকা শুরু করে দিলেন। জামান সাহেব অবাক হলেন, ওমা, এ তো দেখছি ‘যেই লাউ সেই কদু’; দেশে যেমন সরকারি ডাক থেকে শুরু আর জনতার ডাকের ওপরে এক দুই তিন মারার একই পদ্ধতি। শুধু ভাষার বর্ণনাটা ভিন্ন।
যাক এবার জামান সাহেবের দেখা সব ভাঙাচোরা বিক্ষত বাড়িগুলো একে একে চলে যাচ্ছে অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি দামে। জামান সাহেব ভাবছেন, মঞ্জু ভূঁইয়া তো এ রকমই বলেছিল।
অবশেষে যে বাড়িটি নিলামে উঠল, তার সরকারি দাম হাঁকতেই মঞ্জু ভূঁইয়ার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে গেল। জামান সাহেবকে ফিশ ফিশ করে বলে দিল, এটা ছাড়া যাবে না। আমার চেনাজানা মহল্লা। জামান সাহেব কোনো উৎসাহ না দেখিয়ে বলেন, কিন্তু এ বাড়ি তো আমরা দেখিনি। বোঝা গেল, মঞ্জু ভূঁইয়া এবার ডাকে তিন মারবেই। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। বাড়ির মালিক হয়ে গেলেন জামান সাহেব। মঞ্জু ভূঁইয়া কোর্টের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে পেয়ে গেলেন তার প্রাপ্য ব্রোকার ফি।
কোর্ট থেকে ফিরে এসে ছেলেমেয়ে সবাইকে সংবাদটা দিলেন। ইতস্তত করে স্ত্রী সালেহা বেগমকেও শুভ সংবাদটা দিলেন। সবাই খুশি হলেও সালেহা বেগম বেঁকে বসলেন। স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস থাকা সত্ত্বে ও এ ব্যাপারটা তাকে খুবই আহত করল। শুধু বললেন, এ কাজটা তুমি মোটেই ভালো করোনি। এটার জন্য তোমাকে অনেক পস্তাতে হবে।
যাই হোক, পরে যখন বাড়ির দখল নিতে গেলেন তখন সত্যিই জামান সাহেবের মনে হলো, প্রথমেই একটা বিরাট ধাক্কা খেলেন তিনি। দেখেন বাড়িতে কে বা কারা বসবাস করে আসছে। মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন যাবৎ তারা এ বাড়ির বাসিন্দা। আবার কোর্টের শরণাপন্ন হতে হলো। উটকো ঝামেলা শেষে শুরু হলো বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করার কাজ, প্রায় পনেরো হাজার ডলার খরচ করে বাড়িটি বিক্রির উপযোগী করা হলো। বাড়ির কাজে আবার দায়িত্ব বর্তাল মঞ্জু ভূঁইয়ার ওপর।
নিয়ম মাফিক বিক্রির তৎপরতা শুরু হলো, কিন্তু কোনো উৎসাহী ক্রেতা পাওয়া গেল না। ধীরে ধীরে মঞ্জু কেটে পড়লেন। জামান সাহেব অনেক চেষ্টা করেও বাড়ি বিক্রি করার কোনো ব্যবস্থা করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলেন, বাড়িটি ভাড়া দেবেন। পছন্দ মতো ভাড়াটে জোগাড়ে হিমশিম খেতে হলো। এ অবস্থায় বাড়িটি খালি রেখেই মাসের পর মাস ব্যাংকের মর্টগেজটা পকেট থেকে দিতে হচ্ছে।
বাড়ি ভাড়ার সাইন দেখে একদিন এক বিদেশিনী ফোনে যোগাযোগ করলেন। জামান সাহেব সহাস্যে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানালেন।
জিনা স্যাম্পেইন নামে স্থূলকায় বাদামি রঙ্গের পরচুলাধারী এক মহিলা এসে বাড়ি ভাড়াপ্রার্থী হলেন। আলাপের একপর্যায়ে জানা গেল, কোনো এক প্রাইভেট ক্লিনিকে সেবিকার (কাজের পরিচয়পত্র সাপেক্ষে) চাকরিতে নিয়োজিত আছেন। ভাড়ার যাবতীয় শর্তযুক্ত কাগজে সই করে পুরো বাড়িতে তার দুই মেয়েকে নিয়ে বসবাস করবেন। কথাবার্তায় কোনো জটিলতার গন্ধ খুঁজে পাওয়া গেল না, তাই জামান সাহেব ঠিক করলেন, এই মহিলাকেই চাবি দিয়ে দেবেন। সবকিছু সমাধান শেষে বাসার দায়িত্ব বুঝে পেলেন মিস স্যাম্পেইন।
জামান সাহেব সুস্থির নিশ্বাস ফেললেন। যাক, এবার অন্তত মর্টগেজটা আর পকেট থেকে দিতে হবে না। মাস শেষে ভাড়া সংগ্রহ করতে ছুটে এলেন জামান সাহেব। লেবার খরচসহ এক গাদা রসিদ নিয়ে হাজির হলো মিস স্যাম্পেইন। জামান সাহেব প্রথমে অবাক হলেও পরে মিস স্যাম্পেইনের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হলেন।
শুধু এটুকু বললেন, পরবর্তীতে কোনো ধরনের সমস্যা হলে আমাকে অবশ্যই জানাবে।
বাড়ির সামনে ছোট্ট লনে সবুজের সমারোহ, এক কোণে কিছু গোলাপের চারা বসন্তের আগমনী বার্তা বহন করে সুভাষ ছড়ায় সবুজ ঘাসগুলো বেড়ে উঠে দ্রুত। ঠিকমতো পরিচর্যা না হলে স্যানিটেশনের আইনে জরিমানা হজম করতে হয়। তাই ভাড়াটে হিসেবে মিস সেম্পেইনকে এর দায়িত্ব দেওয়া হলো। কিন্তু সে তা আমলে নেয়নি, যার ফলে জরিমানা দিতে হয় বাড়ির মালিককে।
মিস স্যাম্পেইন এভাবে একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে থাকে। ছয় মাস যেতে না যেতেই মিস স্যাম্পেইন কোনো কারণ ছাড়াই ভাড়া বন্ধ করে দেয়। ধীরে ধীরে তার খোলস পরিবর্তন হতে থাকে গিরগিটির মতো। জামান সাহেবের ফোনের কোনো উত্তর মেলে না অন্যপ্রান্ত থেকে। কাজের স্থানে খোঁজ নিলে জানা যায়, ওই নামে কেউ সেবিকার কাজ করে না। ধীরে ধীরে থলের বিড়াল বের হতে থাকে। বাসায় গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ফেরত আসতে হয়, কারণ ভেতর থেকে দরজা খুলতে কেউ এগিয়ে আসে না।
বাড়িওয়ালার নামে মাসে মাসে আসতে থাকে পানির বিল, শর্তানুযায়ী তা ভাড়াটে বহন করার কথা। উপায়ান্ত না দেখে জামান সাহেব উকিলের শরণাপন্ন হলেন। বাড়িওয়ালা বনাম ভাড়াটে মামলা চালু হয়ে গেল। কোর্ট হাজিরার তারিখ পাওয়া গেল তিন মাস পরে।
জামান সাহেব এবার নতুন অভিজ্ঞতার ঝুলি খুলে বসলেন। তিন মাস পরে কোর্টে গিয়ে দেখেন, মিস স্যাম্পেইন কোর্টের বারান্দায় বসে আছে। জামান সাহেবের সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো একেবারে সাবলীলভাবে।
জজ উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে কোর্টের তারিখ আরও তিন মাস পিছিয়ে দিলেন। জামান সাহেব তার উকিলের কাছে জানতে চাইলেন, এমনটা কেন হলো। উত্তরে উকিল জানালেন, এটাই নিয়ম। জামান সাহেব যেন নিজে থেকেই মাইনকার চিপায় পরে গেলেন। ছয় মাসের ভাড়া না পেয়ে কোর্টের শরণাপন্ন হলেন। এখন কোর্ট আরও ছয় মাসের সময় বর্ধিত করে দিল। তার মানে এক বছর বাড়িওয়ালাকে প্রাপ্য ভাড়া থেকে বঞ্চিত করা হলো।
ইতিমধ্যে জামান সাহেব কোর্টের সমন পেয়ে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়েন। সমনের ভাষা এমন, মিস স্যাম্পেইন তাঁর বিরুদ্ধে নালিশ করেছে। সুতরাং নির্ধারিত তারিখে তাকে কোর্টে হাজির হতে হবে। সমন নিয়ে তাঁর উকিলের শরণাপন্ন হলেন জামান সাহেব। উকিল বিশ্লেষণ করে বলেন, এটা হচ্ছে অতি নিম্নমানের নালিশ যা শুধু বাদী–বিবাদী একজন সরকারি উকিলের সামনে কোর্টের আইন মোতাবেক সুরাহা করতে পারেন। এতে কারও কোনো উকিলের সাহায্য নেওয়ার প্রয়োজন নেই। কোর্টে গিয়ে দেখেন, বাদী মিস স্যাম্পেইন দুটো রসিদ হাজির করে বলছে, সে একটি গ্যাসের চুলা ও একটা ফ্রিজ খরিদ করেছে যা বাড়ির মালিক সরবরাহ করার কথা। কিন্তু বিবাদী জামান সাহেব এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় চুলা আর ফ্রিজসহ ভাড়া দেওয়ার নিয়ম, জামান সাহেব তা–ই করেছেন। এরপরও কোর্টের রায় চলে গেল ভাড়াটের পক্ষে, সুতরাং জামান সাহেবকেই এই উল্লেখিত টাকাটা পরিশোধ করতে হলো। পরে জানা গেল, ফ্রিজ আর চুলা খরিদ করে ভাড়াটে ওই মহিলা নতুন কিচেন তৈরি করে বাড়ির একটা অংশ সাবলেট দিয়ে বসে আছে। এভাবে কোর্ট কাচারির সমাধানের পেছনে চলে গেল পাঁচটি বছর। তিন তিনজন উকিলের পরিবর্তন করা হলো। পরিশেষে সব মিথ্যে পসরার স্খলন ঘটিয়ে জিনা সেম্পেইনকে একদিন বাড়ি ছেড়ে দিতে হলো। জামান সাহেব বাড়ির মালিকানা ফিরে পেলেন ঠিকই, তবে ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে।