মা-বাবাই পারেন সন্তানের বিগড়ে যাওয়া রুখতে

আমার ছেলের বয়স এখন কুড়ি। সেদিন তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম ঘরের বাজার-সদাই কীভাবে করতে হয়, তা দেখাতে। তাকে কার্ট টেনে নেওয়ার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তাকে দেখানো হচ্ছিল, মাছ কীভাবে বাছাই করতে হয়। ‘কাটার আগে বলে দিতে হয়, মাছের টুকরোর আকার কেমন হবে’, আমি এসব বকবক করছিলাম। কিন্তু তার সাড়া পেলাম না। ও মা, দেখি সে তেলাপিয়া, রুপচাঁদা, কাতল, বোয়াল, ফলি, বাতাসা ইত্যাদি মাছের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আম্মু, মানুষের মতো কি মাছদের নামেরও আকিকা হয়?’
প্রশ্ন শুনে আমি থ, ‘এটা কোনো প্রশ্ন হলো?’ এমন সময় এক বৃদ্ধ চাচা গ্রোসারির কর্মচারীদের উদ্দেশে হাঁক দিলেন, ‘ও বাবা, ভুতি মাছ আছেনি? থাকলে দুই প্যাকেট দ্যাও।’
আমার ছেলে এবার দ্রুত বৃদ্ধ চাচার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভুতি মাছের চেহারা দেখার অত্যধিক আগ্রহ তার। আমি নস্টালজিক হলাম। মেনি মাছকে কোনো কোনো অঞ্চলে ভুতি মাছ বলে। ছেলে তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘দাদু, ভুতি মাছ কেমন?’ দেখলাম বৃদ্ধ চাচার চোখ ঝিকমিক করে উঠল। তিনি আমার ছেলেকে আপাদমস্তক দেখে নিলেন। তারপর মেনি মাছের প্যাকেট দেখিয়ে বললেন, ‘দাদুভাই, ভুতি মাছ হইল এইটা।’ বাজার সেরে চলে আসার সময় চাচা বললেন, ‘মা গো, এই দ্যাশে আইছি আট-নয় বছর হইল। দেখসি কচি বয়সী পোলা-মাইয়ারা কত উগ্র। বাপ-মায়ের সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়া ইংরাজিতে কতা কয়। মা গো, আপনার ছেলেটা খুব সরল। খুব মায়া তার মনে। আমি অচেনা-অজানা, অথচ সে আমারে দাদু বইলা ডাকসে। ওর বয়সী আমার নাতি-নাতনি আছে। কিন্তু তারা আমারে এমন মহব্বতের সাথে দাদু ডাকে নাই। আল্লাহ ওরে অনেক বড় করুক।’ চাচার কথা শুনে আমি অশ্রুসিক্ত হলাম।
বৃদ্ধ চাচার কথাগুলো শোনার পর আমার কিছু কথা মনে পড়ল। আমার পরিচিত এক দম্পতি; নিউইয়র্ক শহরে তাঁদের দু-তিনটি বাড়ি আছে। তিন মেয়ে, এক ছেলে তাঁদের। ওই দম্পতি যেখানেই যান, ছেলেমেয়ের উচ্চাভিলাষ নিয়ে খুব গল্প করেন। বড় মেয়ের হাতখরচ প্রতি সপ্তাহে পাঁচ শ ডলার। ভিক্টোরিয়া সিক্রেটের পারফিউম, অন্তর্বাস মাইকেল কোর’স, কেলভিন ক্লেইন কোচ ব্রান্ডের জ্যাকেট ইত্যাদি গল্প চলতেই থাকে। একবার নাকি মেয়েটির ফুপু তাকে বার্থডে গিফট হিসেবে কার্ভ পারফিউম সেট দিয়েছিল। কিন্তু মেয়েটি নাক সিটকে ‘ডিজগাস্টিং’ বলে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলেছিল ওই পারফিউম। মেয়ের মা অতি উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘জানেন ভাবি, আমার এই মেয়ে অন্য দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। ওর বাবার তো চিন্তার শেষ নেই। মেয়ের বিয়ের জন্য অলরেডি ডায়মন্ডের সেট বানিয়ে রেখেছে। দাম কত জানেন? বাংলা টাকায় প্রায় এক কোটি! চিন্তা করা যায়?’ শুনে আমি ভেতরে-ভেতরে বিরক্ত হলাম।
কথায় কথায় টাকার বড়াই করা লোকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করি। আমি আঁতকে উঠলাম যখন জানলাম ওই দম্পতির বড় মেয়ের বয়স মাত্র ১৪। কারণ, টিনএজার একটি মেয়েকে এভাবে মাথায় তুলে নাচলে তার ভবিষ্যৎ অবশ্যই ভালো হবে না। এত ছোট মেয়ের ঘাড়ে বিলাসিতার ভূত চাপিয়ে দেওয়ার পেছনে বাবা-মা দুজনেই দায়ী। মেয়েটির আচরণে এরই মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়েছে। না হলে ফুফুর দেওয়া বার্থডে গিফট ছুড়ে ফেলে কীভাবে?
তারপর বছরখানেক কেটে গেল। আমি চাকরি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ইচ্ছা থাকলেও দেখা–সাক্ষাৎ হওয়ার সময় ও সুযোগ, কোনোটাই হচ্ছিল না। একদিন এক শপিং মলে দেখা হয়ে গেল মেয়েটির মায়ের সঙ্গে। তাঁর মুখে উচ্ছ্বাসের ছিটেফোঁটা নেই। অতীতের মতো আর কথা বলেন না। ধরন বদলে গেছে। তাঁর অনুরোধে কফি নিয়ে বসলাম। তারপর যা শুনলাম, আমার অন্তর অবশ হয়ে গেল। বড় মেয়ে এখনো হাইস্কুলের চৌকাঠ পার হয়নি। কিন্তু এখনই কথায় কথায় মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। বাইরে ও বাসায় আপত্তিকর পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। বাসায় মেহমান এলেও হাই-হ্যালো করে না। মা তাকে খোলামেলা পোশাক পরতে নিষেধ করলে মেয়েটি রেগেমেগে ফোন হাতে ৯১১ নম্বরে কল করবে বলে হুমকি দেয়। ইদানীং সে এক আমেরিকান ছেলের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। বলতে বলতে তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। বড় সন্তানের যদি এমন অধঃপতন হয়, বাকিগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে?
ওই নারীর দুর্বিষহ অবস্থা দেখে আমার খারাপ লাগল। এখানে অনেকেরই ছেলেমেয়ের বিগড়ে যাওয়ার ইতিহাস আছে। অনেক ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরাই এর জন্য দায়ী থাকেন। বাচ্চাদের বয়ঃসন্ধির সময় বাবা-মাকে খুব সতর্ক থাকতে হয়। অনেকে সেটা উপেক্ষা করে তাদের অতি আদরে মাথায় তোলেন। এ কারণে বাচ্চারা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ থেকে বাঁচার মন্ত্রটি খুব সাধারণ। সন্তানকে আদর করুন, সঙ্গে শাসনও। সঠিকভাবে আচরণ করুন, আবদার মেটান, তবে অন্যায় আবদার নয়। এতে তার ভবিষ্যৎ যেমন ভালো হবে, তেমনি তার বেয়াড়াপনার জন্য নিজেকেও অস্বস্তিতে পড়তে হবে না।