ভোট জালিয়াতির মামলায় নিউজার্সিতে দুই বাংলাদেশি গ্রেপ্তার

সেলিম খালিক ও আবু রেজিয়েন। ছবি: সংগৃহীত
সেলিম খালিক ও আবু রেজিয়েন। ছবি: সংগৃহীত

আমেরিকায় নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসন সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে দুই বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করেছে এফবিআই। তাঁরা হলেন প্যাটারসনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলম্যান শাহীন খালিকের ভাই সেলিম খালিক (৫১) ও তাঁর সমর্থক আবু রেজিয়েন (২১)। সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে ডাকযোগে আনা ব্যালটে কারচুপির মাধ্যমে আরেক বাংলাদেশি প্রার্থীকে পরাজিত করার অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা হয়েছে।

গত ১৯ মে অনুষ্ঠিত সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্যাটারসনের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলম্যান শাহীন খালিকের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রার্থী হন মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান। ভোট গণনা শেষে শাহীনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিনি পান ১ হাজার ৭২৯ ভোট। অন্যদিকে, দ্বিতীয় স্থান অধিকারী মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান পান ১ হাজার ৭২১ ভোট। নির্বাচন কমিশনের ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করে আবারও ভোট গণনার আবেদন জানান আক্তারুজ্জামান। দ্বিতীয়বারের গণনায় আকতারুজ্জামানের ভোট বেড়ে যায়। তবে শাহীন খালিক এগিয়ে থাকেন তিন ভোটে। এরপর আবারও গণনার অনুরোধ জানালে তৃতীয় দফায় দুজনের সমান ভোট হয়।

এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় এবং ভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশন দ্বন্দ্বে থাকায় নিউজার্সি স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে ভোট নিয়ে প্রতারণা, ভোট ডাকাতি ও ভোট গণনার ফলাফল নিয়ে কারচুপির মামলা করা হয়। এই মামলার তদন্ত শুরু হলে ২৫ জুন শাহীন খালিকের বড় ভাই সেলিম খালিক ও তাঁর সমর্থক আবু রেজিয়েনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

সিলেটের বিয়ানীবাজারের সেলিম খালিক বসবাস করতেন প্যাটারসন সিটির ওয়েন এলাকায়। তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ করা হয়েছে, ডাকযোগে আসা ব্যালট গণনায় প্রতারণা (তৃতীয় ডিগ্রি), বেআইনিভাবে ব্যালট নিজের কবজায় রাখা (তৃতীয় ডিগ্রি), সরকারি নথির পরিবর্তন ঘটানো এবং ভোট গণনার ফলাফলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা তথ্য প্রদান (চতুর্থ ডিগ্রি) করেছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল গুরবির গ্রুয়েল গণমাধ্যমকে জানান, খালিক নির্বাচনের বিধি লঙ্ঘন করে প্যাটারসন সিটির দুই নম্বর ওয়ার্ডের একজন ভোটারের বাসায় যান। তাঁর কাছ থেকে একাধিক ব্যালট সংগ্রহ করেন। অথচ সেগুলো বিধি অনুযায়ী ডাকযোগে নির্বাচন কমিশনের অফিসে আসার কথা। খালিক সেগুলো এনে নির্বাচন কমিশনে জমা দেন। সে সময় নির্বাচন কমিশনকে নিশ্চিত করতে পারেননি যে ভোটাররাই তাঁকে লিখিত অনুমতি দিয়েছেন ব্যালট পেপার বহনের জন্য।

অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘এ-১ ইলেজেন্ট ট্যুরস’ নামে খালিকের একটি বাস কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়া ‘ইস্টার্ন স্টার ট্রান্সপোর্টেশন, এলএলসি’ নামেও (স্কুলের ছাত্রছাত্রী পরিবহন) তিনি একটি ব্যবসা পরিচালনা করেন। সে ব্যবসায়ও জালিয়াতি ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। পৃথকভাবে সেগুলোর তদন্ত চলছে।

একই সঙ্গে গ্রেপ্তার প্রসপেক্ট এলাকার অধিবাসী আবু রেজিয়েনের বিরুদ্ধে ডাকযোগে আসা ভোট প্রদানে প্রতারণা (তৃতীয় ডিগ্রি) এবং বেআইনিভাবে নির্বাচনের ব্যালট দখলে রাখার (তৃতীয় ডিগ্রি) অভিযোগ করা হয়েছে আদালতে। অ্যাটর্নি জেনারেল উল্লেখ করেন, তিনি কমপক্ষে তিনটি ব্যালট পেপার ভোটারের কাছ থেকে ক্রয় করেন এবং তা নিজের দখলে রাখেন। এসব ব্যালট তাঁর কাছে রাখার অনুমতি ছিল না।

আবু রেজিয়েনের কাছ থেকে একটি ইউএসবি ড্রাইভ জব্দ করা হয়েছে। সেটি যাচাই করার সময় একটি ভিডিওচিত্র পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা গেছ, তিনি তিনটির অধিক ব্যালট প্রদর্শন করছেন, যেগুলো পূরণ করা হয়নি। কিংবা প্রচলিত বিধি অনুযায়ী খামে ছিল না। অর্থাৎ তিনি ব্যালট সংগ্রহ করেছেন এবং নিজ ইচ্ছায় ভোট দেবেন, যদিও ব্যালটগুলো তাঁর নয়।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘ভোট জালিয়াতির অভিযোগে একই সিটির আরও দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন বর্তমান কাউন্সিলম্যান মাইকেল জ্যাকসন (৪৮) ও নির্বাচিত কাউন্সিলম্যান আলেক্স ম্যান্ডেজ (৪৫)। তাঁদের সবাইকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে মানুষের বিদ্যমান আস্থায় সন্দেহের বা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটতে পারে—এমন কোনো আচরণকেই আমরা সহ্য করব না।’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেলিম খালিকের সর্বোচ্চ ১৬ বছর এবং আবু রেজিয়েনের সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে বলেও উল্লেখ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

জানা গেছে, মামলার তথ্য প্রকাশের সময় অভিযুক্তরা অ্যাটর্নিসহ হাজির হয়েছিলেন। এ কারণে তাঁরা দুজনই দ্রুত জামিন পেয়েছেন।

উল্লেখ্য, এই আসনে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আকতারুজ্জামান। চার বছরের মেয়াদ শেষে আবার প্রার্থী হলেও নিজের অবস্থানের ঠিকানা নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় শাহীন খালিকের কাছে তিনি পরাজিত হন। শাহিনেরও চার বছরের মেয়াদ শেষ। তাই তিনি আবার প্রার্থী হয়েছিলেন এ নির্বাচনে। শাহীন খালিকের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার এবং আকতারুজ্জামানের বাড়ি সিলেট সদরে। আট বছর ধরেই এই ওয়ার্ডের নির্বাচন ঘিরে নিজেদের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডার উদ্ভব হলেও এই প্রথম ভোট জালিয়াতির মামলায় গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল, যা কমিউনিটিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এর জের পড়ছে গোটা বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপর।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্যাটারসনের বাস করা প্রবীণ একজন প্রবাসী বাংলাদেশি বলেন, ‘যাঁরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদেরও নিরপরাধ ভাবার কোনো অবকাশ নেই।’