মারি ও শেষ অঙ্ক

স্ত্রী মওরিন ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টেড।
স্ত্রী মওরিন ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে টেড।

সুন্দর বন্ধুটি আমার,

তোমার ছোট্ট সুন্দর মেসেজটা পেয়ে মন কী যে ভালো হয়ে গেল গতকাল! সেই কবে (মার্চ, ২০১৬?) পাঁচ দিনের নেপাল ভ্রমণে এসে কাঠমান্ডুতে পরিচয় আমাদের। এত দিন পর এই সাদা বুড়োকে যে মনে রেখেছ, এ এক বিরাট আশ্চর্য। জানিয়েছ, আর ঢাকায় থাকো না তুমি। হায়, এমনিতেই সময়রেখায় আমাদের বাস দুই মেরুতে—তুমি ছত্রিশ আর আমি চুরানব্বই, ভাবতে পারো? তা–ও যত দিন আমি নেপালে আর তুমি বাংলাদেশে ছিলে, তত দিন একটা নৈকট্যের উষ্ণতা ভেবে নিতাম মিছেমিছি—শীতের রাতে পাগলা ঝোরার পাশে তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে সূর্যকে কল্পনা করার মতো। তা এখন তুমি নাকি দক্ষিণ গোলার্ধবাসী! এ যে একেবারে অন্য গ্যালাক্সির ব্যাপার। নবীন গ্রহরাজিকে আলো আর উত্তাপ দিয়ে বেড়াচ্ছ বুঝি? একটু তো হিংসা হলোই। সেই ছেলেটির সঙ্গে কি তুমি এখনো আছো? যার কাছ থেকে বিচ্ছিরি সব টেক্সট মেসেজ পেয়ে কাঠমান্ডুর সেই রিসোর্টের দেয়ালঘেঁষা শিশুগাছটার নিচে বসে কাঁদছিলে একদিন? জানলে ভালো লাগবে যে আজকাল তুমি আর তত দুঃখী নও।

আমার শরীরের অবস্থা জানতে চেয়েছ। উৎকণ্ঠা জানিয়েছ নেপালের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। আমার শরীর নতুন করে আর কী খারাপ হবে, বলো? মনে হচ্ছে, এই সংগ্রামই শেষ সংগ্রাম। মওরিন, আমার বউ, অকালেই চলে গিয়েছিল মেয়েটা। বলেছিলাম তো তোমাকে! পঁচাশি আর এমন কী বয়স? আজকাল মনে হচ্ছে, ওপারে ও আমাকে খুব মিস করছে। আমার সারা জীবনের সঙ্গী মওরিন—দুর্দান্ত আঁকিয়ে, বিলেত সরকারের পুরস্কার পাওয়া কবি; আহা, ওর মতো দরদি হলাম না জীবনে। আমার ছেলেরাও তেমন হলো না। আমার বড় ছেলে জিমকে মনে আছে তো তোমার? ওর বয়স এখন একাত্তর। বলেছিলাম বোধ হয়, মরণোত্তর দেহদান করেছিল মওরিন। ওর সব সম্পত্তি উইল করে রেখে গিয়েছিল নেপালের দুর্ভাগা মেয়েগুলোর জন্য, পাচারকারী চক্রের হাত থেকে যারা পালিয়ে এসেছে, অথবা যাদের উদ্ধার করা হয়েছে। এদের কারও বয়সই আঠারোর ওপর নয়। ‘মওরিন উইলকিনসন ফাউন্ডেশন’–এর কাজ শুরু করতে সেই যে আমার ২০১৬–তে নেপাল আসা, আর সেই যে রিসোর্টের বাগানে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়া, আর সেই যে ভ্যালি অব লাভে একটা বেঞ্চিতে বসে আমাদের অনর্গল গল্প করা, তারপর আমি আর আমেরিকায় ফিরে যাইনি, জানো? শুরুর দিকটায় জিম আমাদের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন, অন্যান্য এনজিওর সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ সারা আর মাঠপর্যায়ের কৌশল ঠিক করার কাজে আমার সাথে সাথে ছিল। এখন প্রতিবছর দুবার আমাকে এসে দেখে যায়। ওরও তো দেশে সংসার আছে; নিজের ব্যবসাপাতি সামাল দিতে হয়।

সত্যি কথা বলতে, নেপালের সার্বিক অবস্থা ভালো লাগছে না। লকডাউন তো চলছেই, তার ওপর বর্ডারও বন্ধ করে দিয়েছে এরা; এমনকি বাইরের দেশ থেকে আসা নেপালের নাগরিকদের জন্যও। ওদের প্রধানমন্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, গত শুক্রবার মাত্র ছাড়া পেলেন। ট্যুরিজম ওদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি—জানোই তো। তোমার মতো করে ভাবলে আমি বলতাম যে নেপালের প্রতি প্রকৃতি একই সাথে মায়ের মতো সদয় আর জ্ঞাতি শত্রুর মতো নিষ্ঠুর-ভূমিকম্পের কথা আর গিরিধসের কথা ভোলোনি তো? কিন্তু, কথা হচ্ছে, আমি তো তোমার মতো করে ভাবি না।

তুমি লিখেছ, এই ভাইরাস নাকি ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’। কেননা মানুষ অবশেষে অন্তরীণ হয়েছে, তোমাদের বাড়ির সামনে আকাশিয়াগাছ হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে, তোমার মায়ের চিলতে ছাদবাগানে বুলবুলি পাখি এসে বসছে, আমার দেশ আমেরিকার প্রশান্ত উপকূলে বিলুপ্তপ্রায় সবুজ কচ্ছপ সাঁতরে বেড়াচ্ছে। আমি হেসেছি। তুমি না লিখে অন্য কেউ এসব লিখলে ভাবতাম, কী সব আবোলতাবোল লিখেছে। মওরিনও হয়তো তোমার মতোই ভাবত। ও ছিল যাকে বলে হোপলেস রোমান্টিক। তবে একটু ভাবো দেখি, প্রকৃতিকে নিয়ে এই যে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব রচনা করে যাচ্ছ তোমরা—স্বর্গ-নরকের ধারণা আর প্রতিহিংসাকামী, প্রতিশোধপরায়ণ এক ঈশ্বরকে জীবনভর বহন করে যাচ্ছ; আর প্রকৃতিকে যে সেই ঈশ্বরের সব লক্ষণধারী ঈশ্বরী বা কুপিতা দেবী ভেবে নিচ্ছ, তাতে মানুষের বা প্রকৃতির কতটুকু মঙ্গল? আজ বাদে কাল তুমি কাজে যাবে না? কাল বাদে পরশু তোমার-আমার অর্থনীতির চাকা আবার সচল হবে না? দূষণে ছাইবে না আকাশ? মৎস্য-পাখি-কূর্ম-বরাহ আবার নির্বংশ হবে না? প্লাস্টিকে জড়াবে না সামুদ্রিক প্রাণীদের শরীর? প্রকৃতি—যাকে তোমরা ‘মা’ বলো; ধরিত্রী—যাকে তোমরা সর্বংসহা নারী বলো, সেই নারী কি চেনেন না তার অবোধ সন্তানদের? সেই নারী কি জানেন না এই সন্তান কখনোই তার স্বল্পবুদ্ধির ভাই সরল মৌমাছির মতো হবে না? আর বলো দেখি, প্রকৃতির এই কথিত ‘প্রতিশোধ’–এর বিরুদ্ধে যেদিন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে (হবেই), জনে জনে ছড়িয়ে পড়বে তা (পড়বেই), দেশে দেশে মানুষ প্রতিষেধক চিনবে (চিনবেই), তখন তোমরা আর তোমাদের প্রকৃতি-মা কী বলবেন? যে মানুষ প্রস্তর ঠুকে আগুন জ্বালাতে পারে, তার কি নেই সমগ্র জীবজগতের জন্য মঙ্গলদীপ জ্বালানোর শুভবুদ্ধি? তো সেসব যেদিন ঘটবে, তোমাদের প্রকৃতি-মা কি তখন পরাজয় বরণ করে মুখ লুকিয়ে ফিরে যাবেন? নাকি সন্তানগর্বে গর্বিত হবেন?

প্রিয় বন্ধু, আমি মন্ত্রতন্ত্র জানি না, (গ্রহ–নক্ষত্র নিয়ে যদিও আমার কিছু কৌতূহল আছে), দেব–দেবী চিনি যতটুকু, তা–ও একটা মহাকাব্যকে জোরপূর্বক সংকোচন করে ছোট একটা একাঙ্কিকা দৃশ্যায়িত হলে নট–নটীদের যতটুকু চেনা যায়, ততটুকু। নেপালের অলিগলিতে মন্দির, আর আকাশ ফুঁড়ে পর্বতের যে কন্যা মাথা তুলেছেন, তিনি দক্ষের আদরিণী সতী নন, কিংবা পর্বতের দুহিতা পার্বতীও নন, তিনি অন্নপূর্ণা। তাঁর হাতে অন্নের পাত্র। প্রলয়কাণ্ডের অধিনায়ক ভিখারি শিবের নৃত্য দেখে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ভিক্ষার পাত্রে দুটো ভাত দিয়েছিলেন যিনি, তাঁকেই অন্নপূর্ণা বলে। তাই না? তুমি ভালো জানবে। তোমার সনাতনী সমাজে আমি বড় হইনি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখে বড় হয়েছি। বাবা-কাকাদের কূটবুদ্ধিকে ধন্যবাদ, আমাকে সম্মুখসমরে যেতে হয়নি, কিন্তু যুদ্ধে-খাদ্যাভাবে-মন্দায় জরাজীর্ণ একটা জীবনের স্মৃতি যে কঠিন বুকে, সে বুকের বরফ ঠিকই গলে গেছিল অন্নপূর্ণার ওই মিথ শুনে। কিন্তু ওই পর্যন্তই—আমার মুখ দিয়ে তুমি বলাতে পারবে না যে ধরিত্রী আমার মা। আমাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের ওই দুঃখী মেয়েগুলোও আমাদের মা নয়; আমাদের বোন নয়। ওরা মানুষ। আর প্রকৃতি মানুষও নয়—প্রকৃতির পানপাতা মুখ, পটলচেরা চোখ, গোলাপের মতো গাল আর অন্নপূর্ণার মতো স্তনভার কল্পনা করা থামাও তোমরা, প্লিজ। আমি বলব, তোমরা মানুষ দেখেই কল্পনায় তোমরা এত উদ্ধত। যা কিছু তোমাদের বোধের অগম্য, যেমন বাতাসের শনশন, পাখির কলগান, সমুদ্রের শোঁ শোঁ—সবকিছুই তোমাদের নিজেদের ভাষায় তর্জমা করে নেওয়ার একটা বোকামি আছে। আমার দুনিয়ার সাদা মানুষগুলোও ভীষণ অ্যানথ্রোপমর্ফিক—জিমের বউটা ওর পোষা কুকুরকে মানুষের জামা পরায়—ওই সব আমার দুই চোখের বিষ। যা বলছিলাম…স্যরি, বন্ধু-ধরিত্রী আমার মা নয়। ধরিত্রী আমার ঘর। আমি এখানে থাকি, আনন্দে-শোকে-দুঃখে-শঠতায়-মৌনতায়-হিংস্রতায়—বাকি সকলেও থাকে এই ঘরের বাসিন্দা হয়ে—হোক সে এক নারীর কাছে আজীবন বিশ্বস্ত থাকা অ্যান্টার্কটিক পেঙ্গুইন, কিংবা হোক সে সঙ্গমের পর সঙ্গীর মুণ্ডু চিবিয়ে খেয়ে ফেলা মেয়ে প্রেয়িং ম্যান্টিস।

দেখো দেখি, ঝোঁকে পড়ে কত কথা বলে ফেললাম। প্রকৃতি, প্রাকৃতিক নির্বাচন আর বিবর্তনবাদ নিয়ে আমার কিছু নির্মোহ বিচার আছে—আমার তরুণ বন্ধুবান্ধব, এমনকি মওরিন যত দিন বেঁচে ছিল, তত দিন মওরিনও—বলত, আমি নাকি সারাক্ষণ ডারউইনিয়ান ক্যালকুলেটর নিয়ে ঘুরি। জিমের ছোট মেয়েটা যেমন একদিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখছিল কীভাবে খুব সন্তর্পণে বেঙ্গল বাঘ এসে চিত্রল হরিণের পালের মধ্যে থেকে একটা হরিণকে লক্ষ্য করে এগোয়, আর শরীরটাকে একটা সপসপে সরলরেখার মতো অনুভূমিকভাবে লম্বিত করে দৌড়ায়, আর অবশেষে হরিণটাকে ঘাড়ের কাছে কামড়ে ধরে অবশ করে নেয়, আর এরপর তার মাংস টেনে, ছিঁড়ে নেয়—প্রকৃতিদত্ত অভ্যস্ততা আর দক্ষতায়, অর্থাৎ সহজে। খুব কেঁদেছিল নাতনিটা আমার সেদিন। ওর বয়স তখন বছরসাতেক। কিন্তু এখন তো ওরা আর ছোট নয়। আমরাও তো আর ছোট নই। কত দিন আর ছোট থাকব? প্রাপ্তমনস্ক না হলে কীভাবে নেব আমাদের সভ্যতা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের জীবন এবং আমাদের সাথে সংশ্লিষ্ট আরও অনেকের জীবন নিয়ে সমধিক জরুরি সিদ্ধান্ত, বলো?

যাক, অনেক বকলাম। সব হয়তো তোমার পছন্দও হলো না। মনে আছে, ভ্যালি অব লাভে বসে তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যান্য বড় বড় মানবিক ট্র্যাজেডি না ঘটলে আমরা এত দিনেও অন্ধকার থেকে বের হতে পারতাম কি না। মওরিন কবিতা লিখত; ওর মাথায়ও এমন চিন্তা আসত। কিছু মনে কোরো না, আবারও মওরিনের প্রসঙ্গ টানছি—ব্যাকব্রাশ করে টেনে চুল বাঁধলে তোমার আর মওরিনের কপালের রেখা অবিকল এক। সেই কানের কাছে চুলের গুচ্ছের রিং-রিং, সেই তৃতীয় নয়নের ঠিক ওপরে ছোট্ট ভি আকৃতির উইডো’জ পিক—শুধু তোমার চুল কালো আর মওরিনেরটা সোনালি। আমার চেহারা কতটুকু তোমার মনে আছে কে জানে? হয়তো ভাবছিলে, ‘উটকো বুড়োর মতলবটা কী’। হয়তো ময়লা নীল টি–শার্টে ঢাকা, চর্বিতে ঝুলে পড়া আমার বুক দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। মনে আছে, ব্যক্তিগত দুঃখে তুমি কুঁকড়ে ছিলে, কিছুটা যেন ভাঙাচোরাও ছিলে। ‘ছেলেটা আমাকে ভুল বুঝেছে’—এমন কিছুই বোধ হয় বলেছিলে তুমি। কী করে কেউ তোমাকে অমন কষ্ট দিতে পারে, সেটা আমার বোধে কুলায় না। আরে, আমার বয়স নব্বই পেরিয়ে না গেলে সেই দিনই তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিতাম! হা হা…তুমি লিখতে খুব—গল্পটল্প। এখনো কি লেখো? ইংরেজিতে কিছু লেখা হয়েছে কি? বা বাংলা লেখার কোনো অনুবাদ? থাকলে পাঠিও। খুব খুশিমনে পড়ব।

ওহ্, তুমি আরও জানতে চেয়েছ, সোশ্যাল আইসোলেশনের সময়টা কীভাবে কাটাচ্ছি আমি। লকডাউন আমার কাজ কমায়নি মোটেও, শুধু কাজ সমাধা করার বিষয়টাকে আগের থেকে কঠিন করে তুলেছে। জানোই তো, অনাথ আশ্রমের মেয়েগুলোর দৈনন্দিন সেবা আর খাবারের বড় সংকট। দাম বাড়ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। যে মাস্কের দাম ছিল আশি সেন্ট, তার দাম বেড়ে হয়েছে দেড় ডলারের বেশি। তোমাকে নিশ্চয়ই বলতে হবে না দেড় ডলার এই দেশে আসলে কত টাকা। ফাউন্ডেশনের টাকা দিয়ে আশ্রমের সবার প্রয়োজনের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েছি। ফেসবুকে দেখেছ হয়তো, একটা ডোনেশন ক্যাম্পেইন শুরু করেছি, যা দিয়ে আমাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাথে নিয়ে ফিল্ডে সবার জন্য আরও মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার, মাল্টিভিটামিন আর প্যারাসিটামল কেনা হবে। চাইলে তুমিও এতে অংশ নিতে পারো। তোমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে কেউ আগ্রহী থাকলে জানিও।

ভাবছি, এর মধ্যে দুটি বই পড়ে শেষ করব। একটা বই এর মধ্যেই প্রায় শেষ করে এনেছি। জ্যারেড ডায়মন্ডের ‘দ্য ওয়ার্ল্ড আনটিল ইয়েসটারডে’। বইটা অনেক ব্যাপারে আমার চোখ খুলে দিয়েছে; তোমার সাথে আলোচনা করার লোভ হচ্ছে ভীষণ। কিন্ডল থাকলে ঘরে বসে কিনে নিয়ো। গত পাঁচ শ বছরের পাশ্চাত্যের আধিপত্য মানবসভ্যতাকে আদৌ কি কাজের কিছু শিখিয়েছে—বিশেষত শিশুপালন, বয়স্ক ও বৃদ্ধদের যত্ন, পঙ্গু ও অশক্তের প্রতি দায়িত্ব এবং সার্বিক জীবনমান বিষয়ে? সনাতনী সমাজের কিছু কিছু চর্চা কি এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও নতুন বোধ দিয়ে ঋদ্ধ করতে পারে? আমাদের গুহাবাসী, যূথবদ্ধ পূর্বপুরুষ এবং পূর্বনারীদের কাছে কি আজও আমাদের অজস্র ঋণ স্বীকার করার আছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে ডিল করেছে বইটা। এই সময়ে এই বই খুব প্রাসঙ্গিক।

করোনাভাইরাসের কারণে ইতালিতে একটা প্রজন্মকে মরতে দিতে হলো। ওরা তো আমার প্রজন্মেরই মানুষ। এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো আদতে আমরাই। ৯২ নম্বর ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের হয়ে যদি আমার যুদ্ধে যাওয়া হতো, হয়তো এদের কারও কারও বুকে আমি নিজেও গুলি চালাতাম। নয় কি? কয়েকটা দিন এই ভেবে ভেবে খুব অস্থির ছিলাম। আমাদের পশ্চিমের রীতি তো তুমি জানোই—বৃদ্ধ–বৃদ্ধাদের রাষ্ট্র কোথাও কোথাও দেখে, কিন্তু সমাজ, পরিবার কিংবা কমিউনিটি সেভাবে দেখে না। বয়স্ক চাকরিপ্রার্থী চাকরি পায় না; বয়স্ক রোগীর জন্য চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল ও ব্যয়বহুল। তার ওপর তারুণ্য নিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতির অবসেশন তো সবারই জানা। আমাদের সিস্টেমটা এভাবেই সাজানো, এভাবেই চলছে। তার ওপর শারীরিক পরিশ্রমের সামর্থ্য ফুরালে অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাই নিজেদের মানসিক বল হারিয়ে ফেলেন, কেউ কেউ নিজেকে অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করতে থাকেন—এদিকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থেকে যে ব্যক্তিগত অহংয়ের জন্ম, সেটাকে খর্ব করে ছেলেমেয়ের সংসারে গিয়েও উঠতে পারেন না। আগের যুগে, যখন প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে এতখানি সহজ করেনি, যখন চাইলেই হাতের নাগালে তথ্য এবং ঐতিহাসিক ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ পাওয়া যেত না, তখন ভরসা করতে হতো বয়স্ক মানুষের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার ওপর; আস্থা রাখতে হতো অভিজ্ঞ লোকের মুখে মুখে বিস্তৃত জ্ঞানকাণ্ড এবং ভূয়োদর্শনের পরম্পরার ওপর। বয়স্ক মানুষের সেই নৃতাত্ত্বিক গুরুত্ব আজকের জগতে কোথায়? একটি সভ্যতার সকল সঞ্চিত অভিজ্ঞান এখন পাবে বইয়ের পাতায়, কিংবা ইন্টারনেটে। কড়ি আর শতকিয়া দিয়ে অঙ্ক শিখবে? কেন? ক্যালকুলেটর তো আছেই। মায়েরা কি দিদিমার মুখ থেকে রেসিপি শুনে রাঁধবে? কেন? ইউটিউব তো আছেই। এখন বলো, আধুনিক সমাজ, যেখানে আমরা রাষ্ট্র আর সরকারের ধারণার নিচে দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়াই, সে সমাজ যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসাদ হিসেবে আমাদের পাতে তুলে দিচ্ছে আশি-নব্বই-এক শ বছরের দীর্ঘ জীবন, আর তার ফলে অল্পসংখ্যক উপার্জনক্ষম তরুণ-তরুণীর হাতে তুলে দিচ্ছে ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে দেখভালের দায়িত্ব, সেই অপ্রস্তুত সমাজে মারি আর ব্যাধি অকস্মাৎ থাবা বিস্তার করলে আমাদেরকে পরিত্যাগ করা ছাড়া আমাদের সমাজের আর কীই–বা করার আছে?

নেপালের শিশুদের সঙ্গে টেড।
নেপালের শিশুদের সঙ্গে টেড।

অথচ জানতে চাও সনাতনী সমাজ বুড়োবুড়িকে কীভাবে দেখত বা দেখে? নিশ্চয়ই ভাবছ, ‘জানি তো; বুড়োদের মাথায় করে রাখে।’ তোমার অনুমান ভুল। সনাতনী মানেই আধুনিক প্রপঞ্চের বিপরীত অক্ষের—এই ধারণা কিন্তু একদম ঠিক নয়। (আর ‘সনাতনী’ তো তেমন মনোলিথিক কোনো ধারণাও নয়। সমাজ যত সনাতনীই হোক, সম্পদ তো আসলে সীমিত।) কৃষিভিত্তিক সমাজে অবশ্য নেতৃত্ব ও মর্যাদার আসনে বয়স্করাই আসীন; একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থার কারণে বৃদ্ধদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নও হতে হয় না। নতুন সম্পদ সৃষ্টি কিংবা পুরোনো সম্পদ সংরক্ষণ কিংবা নতুন প্রজন্মকে বড় করা আর দেখভাল করার কাজে বয়স্কদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকে—এতে সমাজের দৃষ্টিতে তাদের কখনো বোঝা হতে হয় না। কিন্তু জানো তো? কোনো কোনো যূথবদ্ধ সমাজে রেওয়াজ ছিল বুড়োবুড়িদের খেতে না দেওয়ার, যাতে ওরা অনাহারেই মরে যায়। কিছু কিছু বেদুইন সমাজে বুড়োদের পিছে ফেলে রেখে চলে যাওয়ার রীতি ছিল—বৈরী পরিবেশে যখন সমূহ বিপদ, যখন তাঁবু গুটিয়ে নিতে হচ্ছে, বুকের মানিক শিশুদের কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে অজানা কোনো নিরাপদ স্থানের উদ্দেশে, তখন চাইলেও দুর্বল বৃদ্ধদের বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মরু বা মেরু অঞ্চলে খাদ্যের অনিশ্চয়তা দেখা দিলে এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মেরে ফেলা কিংবা আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার নজিরও আছে। এ রকম কত গল্প! ব্যাঙ্কস আইল্যান্ডের এক অসুস্থ বৃদ্ধ তাঁর ভাইকে অনুনয়বিনয় করে বলেন যে তিনি তার ভোগান্তির পরিসমাপ্তি চান। গোত্রের বিধিমোতাবেক তাকে যেন জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়। এতটুকু দয়া কি তার ভাই তাকে করবে না? আর সেই ভাই, আহারে, আলগা মাটির একটা একটা চাপড়া তার জ্যান্ত দেহের ওপর ফেলতে থাকে, আর কাঁদতে কাঁদতে ক্ষণে ক্ষণে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ‘ভাই, বেঁচে আছ?’, ‘ও ভাই, বেঁচে আছ?’। ভাবতে পারো?

খুব মন খারাপ করে দিলাম তোমার? ভাবছ, আমি বুঝি এমন নিষ্ঠুর, অমানবিক তরিকার সুপারিশ করছি? স্যরি। আমাকে ভুল ভেবো না। আবার কখনো কথা হলে এসব আরেকটু গুছিয়ে বলতে পারব, তত দিনে আমার চিন্তাটাও হয়তো দানা বাঁধবে। অনেক কিছুই হয়তো realm of speculation’–এ পড়ে যাবে, যেটা অনুমান ও প্রতি-অনুমানের একটা দুনিয়া, যেখানে জল্পনাই সার। আচ্ছা…বরং আর কিছু না হোক, ৯২ নম্বর ইনফ্যান্ট্রিতে যুদ্ধ করে আমার যে প্রতিবেশী জ্যান্ত ফিরেছিল, তার গল্প বলতে পারি তোমাকে। তুমি তাই নিয়ে লিখতে পারো। বাংলাতেই লিখো না হয়!

আমার মনে পড়ে তুমি আমাকে বাংলায় একটা বাক্য শিখিয়েছিলে: ‘ইবাদত করমু বুড়া হইলে।’ তোমার মনে আছে? আমার এক বাঙালি সহকর্মীকে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে শুনিয়েছিলামও এই লাইনটা। আগে জানতাম না একজন বুড়ো মানুষের মুখে এই লাইনটা শুনতে কত হাস্যকরই না লাগে!

আজকে আর লিখতে পারছি না। কিছু কাজ সারতে হবে। কথা হবে আবার। ভালো থেকো। সাবধানে থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো।

ইতি,
টেড
শুভম কুটির, রানিবাড়ি মার্গ
কাঠমান্ডু, নেপাল

*সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ-সন্দেহে টেড উইলকিনসনকে কাঠমান্ডুর টেকু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর সর্বশেষ অবস্থা অজানা। কল্পিত চিঠিটি অতীতের বিভিন্ন পত্রালাপের (ই–মেইল ও খুদে বার্তা) ওপর ভিত্তি করে লেখা।