ইশতেহার ২০২০

ট্রাম্প, আপনি কি জানেন, হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যুর
জন্য আপনি দায়ী? পৃথিবীজুড়ে লক্ষ সন্তানহারা
                   মায়ের বুকফাটা আর্তনাদের জন্য আপনি দায়ী?
পুতিন, আপনি কি জানেন, একটা সামান্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিস, না
প্রাণী, না উদ্ভিদ, না জড়, তার সামনে মানুষের অসহায়             

                                   আত্মসমর্পণের জন্য আপনি দায়ী?
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, আপনি কি
জানেন, আপনার মহাব্যর্থতাই দায়ী দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া
                                                এই মারণ-ভাইরাসের জন্য?
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড, আপনি কি জানেন,
মানুষের এই অশ্রু আর্তনাদ আতঙ্কের জন্য আপনি দায়ী?
নিউইয়র্কের চিড়িয়াখানায় যে বাঘটি করোনাভাইরাস বহন করছে,
আপনারা সেই ভাইরাস বয়ে নিয়ে গিয়েছেন তার কাছে।
হ্যাঁ। আপনারা।

কিম, আপনি কি জানেন
মুন, আপনি কি জানেন
লি, আপনি কি জানেন
আবে, আপনি কি জানেন
বরিস, আপনি কি জানেন

আপনারা প্রত্যেকে মানুষের চোখে এনেছেন অশ্রু
মনে এনেছেন ভয়
আত্মায় এনেছেন অসুখ

এখন মা তার সন্তানকে বুকে নিতে পারছে না
এখন সন্তান তার বৃদ্ধ বাবাকে স্পর্শ করতে পারছে না
এখন প্রেমিক-প্রেমিকারা ভুলে যাচ্ছে চুম্বন
এখন কবরস্থানে জমি পাওয়া যাচ্ছে না
এখন হিমঘরে লাশ রাখার জায়গা নেই

পৃথিবীতে এত অক্সিজেন,
কিন্তু বুকে টেনে নেবার জন্য ভেন্টিলেটর নেই
কারণ, আপনারা গড়েছেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবী

আমেরিকার পরমাণু বোমাসজ্জিত সাবমেরিন-বহরের
২০২১ সালের বাজেট ১২৮ বিলিয়ন ডলার।
১২৮০০ কোটি ডলার।
১০ লক্ষ ৮৮ হাজার কোটি টাকা শুধু সাবমেরিনের জন্য!

এখন ভেন্টিলেটর কেনার টাকা নেই!
পিপিই কেনার টাকা নেই নিউইয়র্ক হাসপাতালে।
ডাস্টবিনের ব্যাগ গায়ে জড়িয়ে কাজ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা!

মোদি, আপনার পরমাণু বোমার এক বছরের বাজেট দিয়ে
আপনি ভারতের প্রতিটি মানুষকে দিতে পারতেন পানীয়জল।
এক ফোঁটা পানির জন্য মরুভূমিতে মগজ-গলা রোদের ভেতরে
তপ্ত বালির ওপর দিয়ে ছয় মাইল হেঁটে যেতে হতো না
                                        কোনো রাজস্থানি নারীকে!
আপনার পরমাণু বোমার এক বছরের খরচ দিয়ে
                     প্রতিটি বাড়িতে বানিয়ে দিতে পারতেন শৌচাগার!
আপনার দেশের ৬০ কোটি মানুষ রোজ সকালে প্রকৃতির ডাকে
সাড়া দিতে যাচ্ছে খোলা আকাশের নিচে, কিসের গর্ব আপনার?

ইমরান খান, আপনার পরমাণু বোমার এক বছরের খরচ
দিয়ে আপনি বানাতে পারতেন এক লক্ষ প্রাইমারি স্কুল!
প্রতিবছর বানাতে পারতেন ১০ হাজার হাসপাতাল!

আপনাদের বিশ্বায়ন এখন করোনাভাইরাস পৌঁছে দিয়েছে   

                             আমাজনের আদিবাসী কিশোরীর ফুসফুসে
আপনাদের বিশ্বায়ন এখন করোনামৃত্যুর ছোবলে
নীল করে তুলছে আফ্রিকার আদিবাসী বনাঞ্চল
বাংলাদেশের গ্রাম্য কুটিরে খিদে সইতে না পেরে
                                আত্মহত্যা করছে কিশোরী

মোদি আপনি কি বুঝতে পারছেন, আপনার সিটিজেন
অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট আটকাতে পারেনি একটা ভাইরাসকেও!
দিল্লি থেকে যে রণবীর বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে
দুই শ কিলোমিটার পথ বেয়ে পাড়ি জমিয়েছে মৃত্যুর ওপারে,
তার হৃৎপিণ্ডে জমাট বাঁধা নীল রক্তটুকু আপনার সৃষ্টি?

ইমরান খান, আপনারা কি বুঝতে পারছেন, ট্যাংক
                                               কোনো সিকিউরিটি নয়?
আপনার এফ সিক্সটিন জাবর কাটছে গাভির মতো,
আর বেলুচিস্তান ইরানের সীমান্তে হাজার হাজার মানুষ
প্রচণ্ড গরমে তাঁবুর নিচে গাদাগাদি করে সেদ্ধ হচ্ছে,
বাথরুম নেই, পানি নেই...লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষা নেই!
তারা নিজেরা সংক্রমিত হচ্ছে, আর সংক্রমণ ছড়াচ্ছে
পুরো পাকিস্তানে! নো ফ্যাসিলিটি! নো হিউম্যানিটি!

ট্রাম্প, মোদি,
আপনারা কি বুঝতে পারছেন, সীমান্তে দেয়াল
কিংবা কাঁটাতারের বেড়া তুলে নিজেদের নিরাপদ রাখা যায় না?
আপনারা কি বুঝতে পারছেন, পরমাণু বোমাসজ্জিত মিসাইল
আপনাদের নিরাপত্তা দেবে না?

জানি, মানুষ পরাজিত হবে না।
জানি, মানুষ অনেক মৃত্যুর দামে কিনে নেবে জীবন।
আবার জন্মাবে মানুষ। আবার মানুষ মানুষের কাছে আসবে।
আবার মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।
একদিন আবিষ্কৃত হবে ভ্যাকসিন। একদিন পৃথিবী থেকে
নির্মূল হবে শেষতম করোনাভাইরাসটিও।

কিন্তু থেকে যাবে একটি ভাইরাস।
তার নাম লোভ।
থেকে যাবে জাতিগর্ব।
থেকে যাবে বর্ণবাদ।
থেকে যাবে শ্রেণিভেদ।
থেকে যাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ।
থেকে যাবে উগ্রবাদ।

আইএমএফ বস ক্রিস্টিয়ানা, আপনি কি জানেন,
মানবতার এই অবমাননার জন্য আপনি দায়ী?
জেফ বেজোস, আপনি কি জানেন,
যে ছয় মাসের শিশু করোনাভাইরাস বুকে নিয়ে মারা গেছে,
তা ছড়িয়েছেন আপনি?
আম্বানি, আপনি কি বুঝতে পারছেন,
টাকা কোনো নিরাপত্তা নয়?

যখন ২০ ভাগ মানুষের কাছে পৃথিবীর ৮০ ভাগ সম্পদ,
তখন করোনাভাইরাস আসবেই।
যখন দুই ভাগ মানুষের কাছে বন্দী ৯৮ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা,
তখন করোনাভাইরাস আসবেই।

কিন্তু এক বছর পরেই আপনারা ভুলে যাবেন সব।

আপনাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।
আপনারা শুধু দায়ী তা-ই নয়, আমরাও দায়ী
মানবতার এই অবমাননায়,
আর্তমানুষের এই করুণ কান্নার জন্য।

আমরাই তো ভুলে যাব সব।
আমরা আবারও আপনাকে, ট্রাম্প, ট্রাম্প বানাব।
আমরা আবারও আপনাকে, পুতিন, পুতিন বানাব।

আর তারা বানাবে আপনাকে, ডেভিড ম্যালপাস,
                                                বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট।
তারা নিয়োগ করবে বিশ্বব্যাংকের তরুণ নির্বাহী, যারা আমাজনের
জঙ্গলে পাঠাবে টয়লেট রোল, আফ্রিকার মানুষদের বলবে
                                 হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে।

আবারও ধোঁয়া ছড়াবে চিমনিগুলো। আবারও কালো হয়ে পড়বে
আকাশ। বর্জ্যে-বিষে ছেয়ে যাবে এই নীল গ্রহের অ্যাটমোস্ফিয়ার।
সমুদ্রপানি উঁচু হবে
ডুবে যাবে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ডস...

আবারও ট্রাম্প দাঁত খিলান করতে করতে বলবেন,
সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে।
করোনা ইজ আ হোক্স।
ক্লাইমেট চেঞ্জ একটা ধাপ্পাবাজি!

কাঁটাতারে ঝুলবে ফেলানী।
মেক্সিকান বর্ডারে মারা যাবে রিভেরা।
পূর্ব ইউরোপের বর্ডারে হিমশীতল কাভার্ড ভ্যানে
মরে পড়ে থাকবে ৩০ জন দেশবিহীন মানুষ।
আয়লান মরে পড়ে থাকবে সমুদ্রের বালুকাবেলায়
লাল জামা পরা পুতুলের মতো। তার জামায় লেগে থাকবে
তিনটি সমুদ্রঝিনুক, হাতের মুঠোয় বাঁচার আকুতি,
                                                  পকেটে শুকনো লবণ।
ছোট্ট শিশু ওমরান হতবাক হয়ে দেখবে তার মাথার ওপরে
                   ভেঙে পড়ছে বাড়িঘর, তার ঠোঁটে লেগে আছে রক্ত!
নুসরাত পুড়ে যাবে, বলে যাবে, আমি সারাটা পৃথিবীকে বলে যাব। 

আমাদের আত্মাভরা ভাইরাস।
আর আপনারা হলেন সেই ভাইরাসের প্রধান পোষক
                ট্রাম্প, পুতিন, লি, মোদি, ইমরান, বরিস, আবে।

কিন্তু সেই ভাইরাস আজ চিনছে না ধনী-গরিব, মানছে না
মিসাইল, অ্যাটম বোমা, সিএএ, কাঁটাতার, সীমানাপ্রাচীর

কারণ, অ্যাটম বোমা কোনো নিরাপত্তা নয়।
মারণাস্ত্র দিয়ে এই নীল গ্রহটিকে ছয়বার ধ্বংস করা যায়,
কিন্তু একটা শিশুকেও বাঁচানো যায় না।
কারণ, মিসাইল কোনো সিকিউরিটি নয়!

কারণ, বৈষম্য আর অসাম্যের চেয়ে বড় কোনো ভাইরাস নেই!
শোষণ আর লোভের চেয়ে বড় কোনো মহামারি নেই!
জাতিগর্ব আর সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বড় কোনো দুর্যোগ নেই!
যুদ্ধ আর হিংসার চেয়ে বড় কোনো ভাইরাস নেই! 

আমাদের আত্মার ভাইরাস নির্মূলের জন্য ভ্যাকসিন চাই
এই পৃথিবীকে শুশ্রূষা দেবার জন্য ভেন্টিলেটর চাই
এমন ভেন্টিলেটর চাই, যা দিয়ে গড়ে তোলা হবে শুদ্ধ পৃথিবী

যেখানে কয়েকজন মানুষ ঠিক করে দেবে না
                ৭৮০ কোটি মানুষ কীভাবে মারা যাবে
যেখানে ৭৮০ কোটি মানুষ রচনা করবে
তাদের নিজস্ব ও সম্মিলিত বাঁচার ইশতেহার,
প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ, বন, পাহাড়, আকাশ, নদী, সাগর নিয়ে
সবাই মিলে যে বাঁচা, সেই বাঁচার মতো
                                          বাঁচার সবুজ ইশতেহার!                                                     

১৬ এপ্রিল ২০২০, ঢাকা।

সচিত্রকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী