খর জুনের ভেজা হাওয়ার গল্প

>এলিয়েটের ভাষায় এপ্রিল 'নিষ্ঠুর' মাস। কিন্তু এই চলমান জুন? করোনাকালে দিনে দিনে সে-ও তো হয়ে উঠছে ভয়াবহ, আরও বেশি খর আবহাওয়ায় ভরপুর। শতবর্ষ আগের কথা। তখনো পৃথিবী প্লাবিত ছিল আরেক মহামারিতে। ফলে সেই সময়ের এপ্রিল, মে, জুন—এই সব মাসগুলোতেও মারির সঙ্গে বসবাস এবং মারির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে মানুষ। সেই বিরুদ্ধ বাস্তবতায় তখন কী করছিলেন লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিকেরা? সেই সময় আর এই সময়কে মিলিয়ে দেখার প্রয়াস আছে এই লেখায়।

'নিষ্ঠুর মাস' এপ্রিলের চলে যাওয়ার অপেক্ষায় যারা ছিল, তাদের সে আশা মিলিয়ে গেছে আগেই। মধুমাস চলে যাচ্ছে, সামনেই গোমরা মুখে দাঁড়িয়ে খর-জুন। তার হাওয়াকে ভেজা কেন বলেছিলেন উনবিংশ শতকের কবি এমা লাজারুস, তা জানা নেই। তবে এই জুন যে আরও বেশি সজল হয়ে উঠতে পারে, সে শঙ্কা প্রবল।

জীবন থেমে থাকবার নয়, থাকেও না। আর তাই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে ঘটনায়, সাহিত্যে, শিল্পে, ক্রন্দনে ও একাকীত্বে। প্রতি সকালেই তাই মানুষ নাভীচেরা শ্বাস বাতাসে ছেড়ে বলে ওঠে—'আহ, বেঁচে থাকা কী সুন্দর'! অসহ মৃত্যুর ভার বয়ে বেড়ানো নিয়মবিরুদ্ধ। তাই যুদ্ধই হোক, আর মড়কই হোক নির্মাণে সুশ্রূষা খোঁজা মানুষ তার গহন ভাবনার ছাপ রেখে যায় নানাভাবে। ফলে এই সংক্রমণ অধ্যায় নিয়ে চলে ঢের পেছনে। এ কালের সঙ্গে মেলাতে চায় পূর্বতনদের সময়কে। ফের পাঠ করে হাজার কিংবা শত বছর আগের অধ্যায়।

আজকের এই দুফোঁটা ভাইরাসের তীর্যক হাসির সামনে দাঁড়িয়ে তাই ফিরে তাকাতে হয় শতবর্ষ আগের অনুরূপ হাসিটির দিকে। সে হাসির দৈর্ঘ্য-প্রস্থের জটিল হিসাবে যদি ধরা দেয় কোনো ধন্বন্তরি নিদান, যদি পাওয়া যায় কোনো উপসম। এই তার আকাঙ্ক্ষা—এই তার নির্মাণ স্পৃহা। এ স্পৃহায় কখনো ছেদ পড়ে না। পড়ে না বলেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ের মধ্যেই যখন স্প্যানিশ ফ্লু এসে হানা দিল, সেই ১৯১৮ সালে বসে পাবলো পিকাসো আঁকলেন এক বিমর্ষ ভাঁড়ের ছবি। সেই ভাঁড়ের মুখ দখলে চলে গেল লাল রঙের, যা সাদা থাকবার কথা ছিল ('পিয়েরট' ১৯১৮)। শুধু এই ছবি কেন, ওই সময়ে শিল্পীর যতগুলো কাজ পাওয়া যায়, তার বেশ কয়েকটিতেই এই লাল রঙের প্রাধান্য বেশ নজরে পড়ে। স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে যে, এ রং কি তবে বছরের পর বছর ধরে চলা যুদ্ধের ময়দান থেকে উঠে এসেছে, নাকি এটি তরুণ-হন্তারক ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে লাখো তরুণের চোখ-মুখ থেকে নির্গত হয়েছে? প্রশ্নের মীমাংসা নেই।

১৯১৮ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রসঙ্গ উঠলে একটি বইয়ের নাম উচ্চারিত হবেই। আর তা হলো মার্কিন লেখক ক্যাথেরিন অ্যান পোর্টারের ওই বছরই লেখা 'পেল হর্স, পেল রাইডার'। এই বইটি নিয়ে বেশি আলোচনার কারণ আর কিছুই নয়। পোর্টার নিজেই স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত সেই মারিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে পোর্টার পরে লিখেছেন, 'এর আগের আমি, আর পরের আমি এক নই।'

১৯১৮ সালে পাবলো পিকাসোর তৈলচিত্র `পিয়েরট` শিরোনামের এ শ্বেতমুখ ভাঁড়ের ছবিতে লালের রঙের ব্যবহার মনোযোগ দাবি করে। ছবি: সংগৃহীত
১৯১৮ সালে পাবলো পিকাসোর তৈলচিত্র `পিয়েরট` শিরোনামের এ শ্বেতমুখ ভাঁড়ের ছবিতে লালের রঙের ব্যবহার মনোযোগ দাবি করে। ছবি: সংগৃহীত

স্প্যানিশ ফ্লু পৃথিবীতে যে অভিঘাত রেখে গিয়েছিল, সে তুলনায় শুধু এ বিষয়টিকে উপজীব্য করে শিল্পসাহিত্য অঙ্গণে নড়াচড়া কমই হয়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু এ অঙ্গণে নড়াচড়া কম হলেই যে তা সমাজে স্থায়ী ছাপ ফেলে যাবে না, তার কোনো মানে নেই। আজকের কোভিড-১৯-এর মতো সেকালেও সমাজে এক বিভাজনের, বিচ্ছিন্নতার ও পালাবদলের আওয়াজ নিয়ে হাজির হয়েছিল মহামারি। এমনকি সে সময়ের মহামারি নিয়ে হওয়া রাজনীতির সঙ্গে এ সময়ের রাজনীতিরও রয়েছে এক অদ্ভুত মিল। অমিলও যে নেই তা নয়। সে ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই দিন কয়েক আগের ফাঁকা সড়ক, টাল দেওয়া কফিনের সারি, জীবাণুনাশকের ঝাঁঝাল গন্ধ, দোকান-পাট, অফিস-আদালতে যে বন্ধ সাইন ঝুলছিল বা এখনো ঝুলছে, তা বরং সে সময় আরও প্রকট ছিল।

পোর্টারের আখ্যানে শুধু তাঁর নয়, পুরো জগতের রূপান্তরের নানা চিহ্ন সংকলিত হয়েছে। মহামারি সে সময়ে বিদ্যমান বাস্তবতায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। বিশ্বযুদ্ধের ওই বাস্তবতায় নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি সরাসরি যুক্ত ছিল পুরুষের সঙ্গে। কিন্তু দেখা গেল, যখন মহামারি এল, তখন এই নিরাপত্তার প্রশ্নটি আর কাজই করছে না। নারী-পুরুষ, শত্রু-মিত্র ইত্যাদি সুসংজ্ঞায়িত ভূমিকাগুলো সব এক ভূমিকায় বদলে গেল। এক অদৃশ্য ও অজানা শত্রু সবাইকে এক কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিল। দেখা গেল পুরুষের মতো নারীও রয়েছে সমান ঝুঁকিতে। বাঁচার স্বার্থেই অতি প্রিয়জন ও বস্তুও ক্রমে অচ্ছুত হয়ে উঠছে। সমাজে আপাত বিচ্ছিন্ন মনে হওয়া শ্রেণিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব যেমন একদিকে ঘুঁচে যাচ্ছে, তেমনি আবার সক্রিয়তার সংজ্ঞায় রচিত হচ্ছে নতুন ব্যবধানও। এই জাগতিক ধরন-ধারণে পরিবর্তনের গল্পটি সেকালে আখ্যানের মাধ্যমে বর্ণনা করেছিলেন পোর্টার। একালে ঠিক একই বিষয়কে দার্শনিক ব্যাখ্যাসহ হাজির করছেন স্লাভয় জিজেক, কিংবা ইয়ুভাল হারিরি।

ফরাসি কবি গিয়ম অ্যাপলেনিয়ার মারা গিয়েছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ছবি: সংগৃহীত
ফরাসি কবি গিয়ম অ্যাপলেনিয়ার মারা গিয়েছিলেন ইনফ্লুয়েঞ্জায়। ছবি: সংগৃহীত

এখানে আলোচনায় আসতে পারে ইংরেজ কবি টি এস এলিয়টের কথা। এলিয়ট ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই আক্রান্ত হয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জায়। একই সময়ে এলিয়টের দাম্পত্য জীবনেও হানা দিয়েছিল নানা সংকট। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয়। এই দাম্পত্য সম্পর্কের অবনতিকে এলিয়ট বর্ণনা করছেন 'গার্হস্থ্য ইনফ্লুয়েঞ্জা' হিসেবে। এলিয়টের লেখাপত্রে স্প্যানিশ ফ্লুর প্রসঙ্গ এভাবেই হাজির হয়েছে। ওই মহামারির আগে-পরের সময়ে বসেই এলিয়ট লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড', যার একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তির উল্লেখ শুরুতেই করা হয়েছে। এপ্রিলকে এলিয়ট 'নিষ্ঠুরতম মাস' হিসেবে দেখছেন, তার কারণ হিসেবে তাঁর দাম্পত্য জীবনকে দেখা হয়। কিন্তু তা কি মহামারিও নয়, যখন আমরা জানি যে বসন্তেই এ রোগ ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপে। কবির সেই সময়ের অভিজ্ঞতা এতে তাই জায়গা করে নিয়েছে অনায়াসে। ব্যক্তিগত দুর্গতির সঙ্গে মিলে গিয়েছিল সামষ্টিক দুর্যোগ। এলিয়টের 'বাদামি কুয়াশা' ফুঁড়ে বের হয়ে আসা 'শবের দঙ্গল' বা ভূমিতে বীজের মতো 'শবের রোপণ' আর ব্যাপক বিস্তারি 'জ্যান্ত-মড়ার' রাজ্যের বর্ণনা অন্তত সে কথাই বলে। এর বিকারগ্রস্ত ভাষাভঙ্গিও আদতে মহামারি-সৃষ্ট।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আরেক ইংরেজ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের কথা। স্প্যানিশ ফ্লুতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আক্রান্ত হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লেখা তাঁর কবিতা 'দ্য সেকেন্ড কামিং'-এ যে নৈরাজ্যের বর্ণনা রয়েছে, তার পেছনে যুদ্ধ, বিপ্লব ইত্যাদি যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সেই মড়কের বিভীষিকা। 'সবকিছু ভেঙে পড়বার', কিংবা জগৎজুড়ে এক বিরাটাকায় নৈরাজ্যের চেপে বসবার যে বয়ান ইয়েটস হাজির করেন, তার মূলে রয়েছে এই স্প্যানিশ ফ্লু-ই।

এলিয়ট ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই আক্রান্ত হয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জায়।ছবি: সংগৃহীত
এলিয়ট ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই আক্রান্ত হয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জায়।ছবি: সংগৃহীত

স্প্যানিশ ফ্লু ছিল সত্যিকার অর্থেই এক বিভীষিকার নাম। জলভরা ফুসফুসের কারণে ভারী হয়ে আসা চারপাশ যখন চেপে বসত বুকের ওপর, তখনি আচমকা কোথা থেকে রক্ত ছলকে উঠত নাক-মুখ-কান দিয়ে। এই রক্তাভ সমাপ্তি যদি বিভীষিকা না হয়, তবে বিভীষিকা কী? সে কি কেবলই চেনা শত্রুর বিরুদ্ধে হওয়া যুদ্ধের ময়দানেই থাকে?

এখানে আসতে পারে ফরাসি কবি গিয়ম অ্যাপোলেনিয়ারের কথা। বিশ্বযুদ্ধের ময়দান যাঁর মৃত্যুর কারণ হতে পারেনি, যাঁর জীবনীশক্তিতে টান লাগাতে পারেনি দৃশ্যমান শত্রুপক্ষের ছোড়া কোনো গোলা, সেই অ্যাপোলেনিয়ার মারা গেলেন অদৃশ্য সেই হন্তারকের কাছে, যার নাম ইনফ্লুয়েঞ্জা। সেই সময় অ্যাপোলেনিয়ার কী করছিলেন? কোনো কবিতা, বা অন্য কিছু? না তেমন কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। ওই বছর তাঁর যে চিত্রল কবিতাগুচ্ছ প্রকাশ পায়, তা রচিত হয়েছিল তারও তিন-চার বছর আগে। তবে তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় কোনো বিস্ময় এসে ধরা দিত সবার সামনে। কারণ, সেই সময়ে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সবাই ছিলেন এক নতুনের টানে বুঁদ। প্যারিসে শিল্পসাহিত্যে একের পর এক নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।

ক্যাথরিন অ্যান পোর্টারের লেখা `পেল হর্স, পেল রাইডার` বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাথরিন অ্যান পোর্টারের লেখা `পেল হর্স, পেল রাইডার` বইয়ের প্রথম প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত

এই মারির বছরই প্রকাশিত হয়েছিল জেমস জয়েসেরে বিখ্যাত উপন্যাস 'ইউলেসিস'-এর প্রথম তিন অধ্যায়, যা লেখা হয়েছিল কিছু আগে। এই সময়েই জয়েস তাঁর এই সুবিখ্যাত উপন্যাসের একটি অংশ লিখেছেন। জয়েস এ সময়টাতে ছিলেন জুরিখে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালের একটা বড় অংশ তিনি সেখানেই কাটান। সে যাই হোক, এই 'ইউলেসিস'-এর হ্যাডেস পর্বে জয়েস বলছেন তাঁর চরিত্র লিওপোল্ড ব্লুমের মুখ দিয়ে সেই মহামারিকালের কথা। কীভাবে? সেই বিরলপ্রজ ক্যানভাসার ব্লুম এক কবরখানার পাশ দিয়ে যেতে যেতেও ভোলেন না ক্যানভাস করার কথা। 'মৃতদের জন্য' করা সেই ক্যানভাসে তিনি বলে যান 'স্কারল্যাটিনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির' কথা। জয়েস এই উপন্যাসে অনেক বেশি প্রতীকের মাধ্যমে কথা বলেছেন। হাজার পৃষ্ঠায় বলা মাত্র একদিনের এ গল্প ধারণ করেছে মহাকাব্যের গভীরতাকে।

১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু 'বোম্বে ফ্লু' নামে এই ভারতীয় উপমহাদেশে এসে পৌঁছেছিল জাহাজে করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই ডামাডোলের মধ্যেও এই বোম্বে ফ্লুর বিষয়টি প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল কিন্তু এই জুনেই। সেই বোম্বাই জ্বরে ভারতের আনুমানিক ৫ শতাংশ মানুষ মারা পড়েছিল। প্রথম মহাযুদ্ধে ঔপনিবেশিক শক্তির হয়ে প্রাণ উৎসর্গ করতে যাওয়া সৈনিকেরা যখন দেশে ফিরল, তখন তারা সঙ্গে করে নিয়ে এল এই ব্যাধির জীবাণু। আনুমানিক ১৫-২০ লাখ মানুষ সে সময় মারা পড়ছিল ভারতে। সে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা এখানকার সাহিত্যে তেমন পাওয়া যায় না। 'মরদেহের ভারে ফুলে উঠেছে গঙ্গা'—লিখছেন নিরালা, যার প্রকৃত নাম সূর্কান্ত ত্রিপাঠী। পরিবারের বহু মানুষকে তিনি হারিয়েছিলেন এই বোম্বাই জ্বরে। নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বেঁচে যান। এর মধ্য দিয়ে আমূল বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবন। তিনি বলছেন, 'চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল সব পরিজন।' মজার বিষয় হচ্ছে, গোটা বিশ্বের মতো ভারতও এই মহামারিকে মনে রাখেনি। নিঃসন্দেহে কারণটি রাজনীতি। একদিকে বিশ্বযুদ্ধ, একদিকে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনের শেষ পর্যয়ের প্রস্তুতি, একদিকে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন এক ধারণা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আবির্ভাব, আরেক দিকে ভিন্ন এক গোলার্ধে এক নতুন শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের কাল ছিল সেটি। ফলে উত্তেজনা ও নৈরাশ্যের জোগানে কোনো ঘাটতি ছিল না।

জেমস জয়েসের বিখ্যাত উপন্যাস `ইউলিসিস`-এর একটি অংশ রচিত হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর সময়েই। ছবি: সংগৃহীত
জেমস জয়েসের বিখ্যাত উপন্যাস `ইউলিসিস`-এর একটি অংশ রচিত হয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লুর সময়েই। ছবি: সংগৃহীত

তাকানো যেতে পারে ১৯১২ সালের দিকে। স্প্যানিশ ফ্লু হানা দেবার ছয় বছর আগে জ্যাক লন্ডনের উপন্যাস 'স্কারলেট প্লেগ' প্রকাশিত হলো। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়কে উপজীব্য করে রচিত প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে বিচেনা করা হয় একে। জ্যাক লন্ডন সে সময়ে বসে যে সময়ের চিত্র এঁকেছেন, তা আদতে আমরা অতিক্রম করছি। তাঁর উপন্যাসের সময়কাল ২০৭৩ সাল, যার ৬০ বছর আগেই পৃথিবী উজাড় হয়ে গেছে। শত বছর আগে লেখা সেই বইয়ে তিনি মহামারি নিয়ে সারা বিশ্বে বিস্তৃত হওয়া ও রাজ করা যে ভয়, তার বর্ণনা দিয়েছেন, যে ভয় বেশ ভালোই টিকে আছে আজও। তাই এখন যে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত 'দ্য স্ট্যান্ড' বইয়ের কল্যাণে বারবার করে বলা হচ্ছে যে, 'আমরা স্টিফেন কিংয়ের গল্পের রাজত্বে বাস করি', তা বেশ বড় সত্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে আরও বড় সত্য হচ্ছে আমরা 'জ্যাক লন্ডনের গল্পের রাজত্বেই আদতে আছি', আর 'হোমারের রাজত্ব থেকে আদৌ কখনো বের হতে পারব কি না, কে জানে।'

আজ স্লাভোয় জিজেক বা ইয়ুভাল হারিরি বৈশ্বিক মহামারি নিয়ে যত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হাজির করছেন, তাকে তাই অনায়াসেই এমনকি প্রাচীনকালের সত্যদ্রষ্টা শিল্পীদের কাজের সম্প্রসারণ বলা যায়। নতুন প্রেক্ষাপট, অর্থনীতির গোপন সম্বন্ধে হওয়া অদল-বদল এই বিশ্লেষণ ও আখ্যানে যতটা যা পরিবর্তন হাজির করছে, এই সময়ে এমনকি বাংলাদেশের শিল্পী আমান উল্লাহ থেকে শুরু করে পশ্চিমের তরুণ শিল্পীদের কাজে তাই পূর্বতনদের কাজের ছায়া সুস্পষ্টভাব দৃশ্যমান। পশ্চিমে তো তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্যোগকালে অগ্রজ শিল্পীদের আঁকা নানা চত্রিকর্মের অনুরূপ দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছেন ভিডিও, ডিজিটাল, ফটোগ্রাফি কিংবা পরিপার্শ্ব বদলে নতুন চিত্রকর্মের জন্ম দিয়ে।

এই সময়ের মহামারি নিয়ে কথা বলছেন স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্লাভয় জিজেক। ছবি: সংগৃহীত
এই সময়ের মহামারি নিয়ে কথা বলছেন স্লোভানিয়ান দার্শনিক স্লাভয় জিজেক। ছবি: সংগৃহীত

মোদ্দা কথা মানুষ শুধু পলায়ন ও দোষারোপ কিংবা আত্মসমর্পণেই নিজের সামর্থ্যের সীমাটি টেনে দিচ্ছে না। বরাবরের মতোই সে নির্মাণ করছে। যদি এখানেই তার সমাপ্তি হয়, তাতেও কিছু যায় আসে না, সে সংকেত রেখে যেতে চাইছে ভাবী প্রজন্মের জন্য। সে জানান দিতে চাইছে যে, 'আমি হয়তো নই, কেউ না কেউ তো বাঁচবে।' তাই সে আশ্বাস রেখে যেতে চায় এই জুনের হাওয়াতেই, এই জুনের খর রোদের প্রযত্নেই।


সূত্র: প্যারিস রিভিউ, হিস্টরি ডটকম, নিউইয়র্কার, এনসিবিআই, ক্যারাভান ম্যাগাজিন, ক্যামব্রিজব্লগসহ উল্লিখিত কয়েকজন লেখকের মূল লেখা।

অন্য আলো অনলাইনে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]