বর্তমানে বাধ্য

করোনায় মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হচ্ছে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
করোনায় মৃত ব্যক্তিকে কবর দেওয়া হচ্ছে। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
>এ এক অবিশ্বাস্য বর্তমান। করোনাকালের নানা ঘটনা যেন আমাদের কল্পনাকেও হার মানাচ্ছে। আর এই বর্তমানের মধ্যেই তীব্র অসহায়ত্ব নিয়ে বেঁচে আছি আমরা।

‘সময়’ মানুষের জীবনে অদ্ভুত এক ধারণা, যার সঙ্গে তাকে দৌড়াতে হয়, হয় থামতেও। আকাঙ্ক্ষিত হলেও থেমে থাকতে থাকতে কখনো মনে হতে পারে সময়ের সঙ্গে বয়ে চলাই হয়তো সহজ। 

মনে পড়ে, কল্পকাহিনিতে কখনো ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি কোনো চরিত্রের বিশেষ অবস্থা, কথায় কথায় বোঝাতে চেয়েছি চরিত্র সময়ের বোধ হারিয়ে ফেলেছে। আজকাল মনে হয়, না-বুঝেই লিখেছি সেসব। সত্যিই যখন ভবিষ্যৎ ধোঁয়াশা আর এতটাই হিসাবের বাইরে যে কল্পনায় কিছুতেই তার ছবিটা আঁকা যায় না, ঠিক তখন হয়তো সময়ের বোধ হারিয়ে যায়। মানুষ যখন দীর্ঘকালের জন্য শুধু বর্তমানে বন্দী হয়ে পড়ে। বর্তমানেই ডুবে থাকে। দিন যায়, রাত যায়, মাস যায়—‘বর্তমান’ তাকে ছাড়ে না।
তাই আটকে আছি সেখানে। ঘুমাই। উঠি। আয়োজন শেষে খাবারের টেবিলে বসি। কোনো দিন বসি লেখার টেবিলে তারপর...ঘুমাই। উঠি।

কারও প্রিয়জনের সঙ্গে কবে সরাসরি দেখা হবে, জানা নেই। কারও জানা নেই কবে আবার চাকরিতে যাবে। কারও জানা নেই আদৌ ফের চাকরি পাবে কি না। জানা নেই ফেলে যাওয়া চেনা শহরে আর ফিরবে নাকি। কারও জানা নেই কত দিন দুই সারি বাড়ির মাঝখানের রাস্তায় উদয়াস্ত চিৎকার করতে হবে, ‘খালাম্মা, কয়ডা ট্যাকা দ্যান, ভাত খাইতাম।’

একদিন এক রিকশাওয়ালা আসে। রিকশা চালিয়ে নয়, হ্যান্ডেল ধরে টেনে হেঁটে হেঁটে। বাড়ির সামনের গেটে দাঁড়িয়ে বলে, ‘প্যাসেঞ্জার পাইলে নিতাম। কিন্তুক আইজ জমার ট্যাকাটাও উডে নাই।’ কথাগুলো আড়ষ্ট, ফাঁকে ফাঁকে প্রমাণস্বরূপ রিকশার দিকে ইশারা বারবার। খেটে খাওয়া মানুষ, তার হয়তো সরাসরি ভাত খাওয়ার জন্য টাকা চাওয়ার অভ্যাস নেই। আরেক দিন তিন-চারজনকে হাতের মুঠোয় টাকা পুরতে দেখে আরেকজন সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে থাকে অপলক, মুখে কাঁপা কাঁপা অন্ধকার। তার দিকে তাকিয়ে দ্বিধায় পড়ি। শেষে হাতছানি দিয়ে ডাকাতে ধীর পায়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। সে হয়তো কোনো দিন হাত পাতেনি। হাত বাড়াতে সংকোচে মরে যায়। টাকাটা সেদিকে ধরে তাকে নেওয়ার জন্য বলতে হয় দুবার। তার চোখে তখন সব কিছু ঝাপসা।

সকাল থেকে এই সব মুখ, আসে যায়। বারান্দায় দাঁড়াই। ফিরে আসি। ও খালাম্মা, কয়ডা ট্যাকা দ্যান... শব্দ শুনে আবারও বাইরে যাই। মুখ দেখি, পরনের কাপড় দেখি, কখনো দেখি ভঙ্গি। একে দেওয়া যায়? যায়।
ঘুমাই। উঠি। আয়োজন শেষে খাবারের টেবিলে বসি।

লকডাউনের একবারে শুরুর দিকে এ রকম ছিল না। তখন লকডাউন ওরফে সাধারণ ছুটির মোটে এক সপ্তাহ হবে হয়তো। দিনে কয়েকবার জানালায় উঁকি মেরে দেখি পৃথিবীতে মানুষ নেই। গাছের পাতায় দেখি অতিরিক্ত চেকনাই, রাস্তায় এক কণা ময়লাও ওড়ে না। যে জানালা খুললে গরম বাতাসের আগে ঢুকে পড়ত একপশলা ধুলো, সঙ্গে আসত রাস্তার বিচিত্র বাহনের হর্ন কি বাহনকে আরও জোরে চালিয়ে নেওয়ার তাড়নার শব্দ, সেই জানালায় ঝিরিঝিরি বাতাস, প্রচুর অক্সিজেন আকস্মিক।

বাড়ির কাছের পার্কের গেটে বড় তালা পড়েছে। হাঁটতে যাওয়া যাবে না। মনে হলো রাস্তাই তো পার্কের হাঁটাপথের মতো হয়ে পড়ে আছে। একসময় মানুষের বিচরণে মুখর থাকা আর তারপর প্রাকৃতিক কোনো কারণে মনুষ্য প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার মতো প্রাচীন কোনো শহরের রাস্তা যেন। এসব ভাবতে ভাবতে মনে হয় বাড়ির চারদিকের রাস্তাতেই ঘুরে আসি নাহয় দুই পাক। মাস্ক আর গ্লাভসে নিজেকে প্যাকেট করে বেরোই। বাড়ির দরজা পেরোতেই প্রতিটি জড় জিনিসকে সন্দেহ হতে থাকে, যেন প্রত্যেকে ভাইরাসে মাখামাখি। সেদিন প্রথম করোনার মহামারি নিজের চোখে দেখি। কয়েকটা বাড়ি পরে দেখি ফুটপাতে একজন মানুষ উবু হয়ে অদ্ভুত অর্থহীন শব্দ করছে। নির্জন রাস্তায় দূর থেকে গোঙানি শোনা যাচ্ছে। মানুষটির কাছেই হাত-পা ছড়িয়ে বসা একটা কুকুরও কৌতূহলী হয়ে আছে। অস্বীকার করব না এক রকম আশঙ্কা হয়ই যে মৃত্যুপথযাত্রী কেউ, হয়তো করোনারই শিকার। ধীর পায়ে আরেকটু এগিয়ে দেখি বাসার কাছের বাজার অঞ্চলে সস্তার ব্যস্ত রেস্তোরাঁর সামনে প্রায়ই বসে থাকা শুকনো কাঠির মতো তরুণ ছেলেটা, আগে যাকে বার কয়েক দেখেছি। রেস্তোরাঁয় ঢোকার মুখে বসে থাকে কেউ ঢুকলে বা বেরোলে হাত পেতে ভিক্ষা চায়। ভালো করে দেখতেই বুঝি সে ক্ষিদেয় কাঁদছে, কান্নাটা হয়তো দীর্ঘ হতে হতে গোঙানির মতো শব্দে গিয়ে ঠেকেছে। পেটের ওপরে হাত রেখে লালাভরা মুখে সে আমার দিকে অস্পষ্ট উচ্চারণে কিছু বলে, কিন্তু তার কথা কিছুই পরিষ্কার বোঝা যায় না। কোনো রকমে পাশ ফেরে কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারে না। তারপর কয়েকটা বাড়ি ছুটে পার হয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকে ফ্রিজে যা ছিল নিয়ে ছুটে যাই তার কাছে। এমন হাপুস–হুপুস করে খায়, যেন কয়েক দিন অভুক্ত। মনে পড়ে হোটেলটা আজ ছয়-সাত দিন বন্ধ নিশ্চয়। লক্ষ করি ছেলেটা দাঁড়াতে পারে না। পাশে একটা ক্রাচ। আগে যখন তাকে দেখেছিলাম, সঙ্গে ক্রাচ দেখেছি কি না মনে পড়ে। হয়তো তাকে বসে থাকতেই দেখেছি শুধু। ফিরে আসার পথে মনে পড়ে, পরের বেলায় সে কী খাবে? কিংবা কাল? বা পরশু? ফিরে গিয়ে তাকে আমার বাড়িটা দেখিয়ে দিই। তিনতলার বারান্দাটা দেখিয়ে দিই ভালো করে। কিন্তু সে আর কোনো দিন আসে না। জানি না তারপর কত দূরে চলে গেছে। ক্রাচে ভর করে এদিকটায় আসা হয়তো তত সহজ না।