যা কিছু ঘটবে বলে!

>

আষাঢ় মাসে আজগুবি সব গপ্পগাথা বলা বাঙালির ঐতিহ্য। এই সংখ্যায় থাকল সমকালীন তিন লেখকের লেখা কল্পনার রঙে রঞ্জিত তিনটি উদ্ভট আষাঢ়ে গল্প

আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টির আয়োজন দেখে রিয়াকে তাড়া দিলাম, শিগগির পাততাড়ি গোটান, এক্ষুণি রওনা দিতে না পারলে ঘনঘোর বিপদ। রিয়াকে একটু হতাশ দেখায়। আগামী সপ্তাহে তার মাস্টার্স এডমিশন নেদারল্যান্ডসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই ফিল্ডওয়ার্কটা শেষ হলে অফিশিয়াল কমিটমেন্টগুলো পূরণ করতে পারত যাওয়ার আগেই।

গ্রামটা একটু বেকায়দা জায়গাতেই। বিলের ধার। পাকা রাস্তা বেশ দূরে। পুরোনো মাটির যে রাস্তাটা বাজার পেরিয়ে পাকা সড়কে উঠেছে, তা কোথাও সরু হয়ে আইলের মতো, কোথাওবা বিলের সমতলে নেমে গেছে, কচুরিপানা মাড়িয়ে যেতে হয় তাতে। ভাড়া করা সিএনজিটা এদ্দুর আসতে পারেনি। অপেক্ষা করছে রথখোলা বাজারে, কিলো চারেক দূরে। বৃষ্টি এড়িয়ে পৌঁছানো যাবে না নিশ্চিত। আবার বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করারও সুযোগ নেই। মেঘের বেশ জমকালো আয়োজন। রাত ভোর করে দিতে পারে।

মিনিটখানেক হাঁটার মধ্যেই বৃষ্টির গন্ধমাখা শীতল বাতাস ধেয়ে এল। পেছন ফিরে দেখি দিগন্তজুড়ে এক ধাবমান ধূসর দেয়াল, যেন আমাদেরই ধরবে বলে পড়িমড়ি করে ছুটে আসছে।

কোনো একটা আশ্রয়ের আশায় ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু বৃষ্টির সঙ্গে বেশিক্ষণ পাল্লা দেওয়া গেল না। মুষলধারার বৃষ্টি আমাদের দৌড়ে হারিয়ে দিয়ে এগোতে থাকে। সাঁঝের আগেই আঁধার জেঁকে বসল বিলের জলে, হিজলের ডালে।

একটা পরিত্যক্ত দোকান পড়ল হাতের বাঁয়ে। যাহোক, ছাউনি তো একটা। পায়ের নিচের মাটি গলতে শুরু করেছে। পা টিপে টিপে পিছলে পড়া ঠেকিয়ে দোকানের সামনের বারান্দামতো জায়গাটায় দাঁড়ালাম। ভেতরটায় আবছা বোঝা যায় এককালে বেশ সমৃদ্ধি ছিল। বছর বিশেক আগে নতুন পাকা সড়ক গেছে অন্য দিক ঘুরে। লোকজনও দোকানপাট, গেরস্তালি নিয়ে হাজির হয়েছে সেই পাকা সড়কের ধারে। মরে গেছে এই রাস্তাটা, সঙ্গে দোকানটাও। ভেতরে ঝাঁজালো ভেষজ গন্ধ, ফার্নজাতীয় কিছু হবে বোধ হয়। সাপখোপ থাকতে পারে ভেবে বারান্দায় দাঁড়ানোই সংগত মনে করলাম।

বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে রিয়া। আমার হাতে কাগজপত্র ধরিয়ে দিয়ে জামা-কাপড়ের জল ঝরানোর চেষ্টা করলে ভেজা জামায় জমে থাকা ঘাম আর পারফিউমের গন্ধ মিশে ওর গায়ের ওম আমার নাকে এসে লাগে। বিবশ হয়ে চোখ বন্ধ করি। আমার হাত থেকে কাগজগুলো ফিরিয়ে নিতে নিতে সে বলে, কী, জ্বর নাকি এরই মধ্যে?

গলা কেঁপে যাওয়ার ভয়ে কথা বলি না। ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করি। বাঁ পকেটে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে সাইলেন্ট করা মোবাইল। সিএনজিওয়ালা? আমাদের দেরি দেখে ফোন করছে হয়তো। করুক। ধরব না। এই অপার্থিব আয়োজন ছেড়ে এক্ষুণি কোথাও যাচ্ছি না আমরা।

বৃষ্টির বিপুল পসরা কখনো ঝুমুর তালে, কখনো দম ধরে, আবার কখনো পাক খেয়ে সাপের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে জলকণা ছিটিয়ে যাচ্ছে গায়ে। বিলের ওপারে দিগন্ত ধরে নীল বিদ্যুতের রেখা। তার আলোয় রিয়ার মুখ দেখি।

দাঁড়িয়ে থেকে পা ধরে এলে রিয়া সাপের ভয় অগ্রাহ্য করে ভেতরে বেঞ্চে গিয়ে বসে। আমি তার পাশে, বেঞ্চের দুদিকে পা রেখে যেন রিয়ার সবটুকু দখলে নিয়ে বসি। সারা দিনের শ্রান্তি আর বৃষ্টির ধকলে টেবিলে হাত রেখে তার ওপর মাথা সঁপে দেয় রিয়া। আমি সোজা বসে অপলক তাকিয়ে। রাস্তার উল্টো পাশের ঘনসবুজ মাঠটা জলে ডুবে এতক্ষণে সাদা হয়ে উঠেছে। ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির শব্দ, ফার্নের তীব্র ভেষজ গন্ধ, আধশোয়া রিয়ার নিশ্বাসে নিশ্বাসে ফুলে ফুলে ওঠা শরীর আর ছড়ানো পায়ে সরু একটা রুপার নূপুর। কতক্ষণ সময় গেল? নাকি সময় যায়নি আদৌ? বসে থেকে থেকে আমারও ঝিম ধরে এল।

আমার একটা অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে জানেন!

কী?

মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবে!

কী কিছু একটা?

কিছু একটা, যা অনেক আগেই ঘটার কথা।

আলতো করে ওর পায়ের নূপুর ছুঁয়ে দিলাম আমি। এমন ঘোর বর্ষায়, এমন নির্জনতায় কিছু একটা তো আজ ঘটতেই পারে, কিছু একটা তো ঘটাই উচিত।

আমার বিয়ে হয়েছিল।

মানে?

এমনই বর্ষার দিন ছিল। বিয়ে শেষে বরযাত্রী দলের সঙ্গে যাচ্ছিলাম পালকিতে। পথে ডাকাতের ভয়, তাই বরযাত্রীরা লাঠিসোঁটা নিয়েই ছিল। কিন্তু ডাকাত হামলে পড়লে কে কোথায় ছিটকে গেল কে জানে! বর আমাকে পাশের ঝোপে ঠেলে দিয়ে বলল, লুকিয়ে থাকো, পরে নিয়ে যাব তোমাকে।

বাহ! বেশ তো গা ছমছমে আষাঢ়ে গল্প!

হুম।

তারপর?

তার আর পর নেই।

কোন জন্মের গল্প এটা? পালকি, নৌকা, ডাকাত?

জানি না।

আরেকটু এগোক না গল্পটা। এ রকম সাসপেন্সের মধ্যে শেষ হয় নাকি? বর ফিরেছিল নিয়ে যেতে?

কোনো সাড়া নেই। অপলক চেয়ে আছে বাইরের বৃষ্টিতে।

বৃষ্টিটা একটু ধরে এল বোধ হয়! আরেকটু কমলে রওনা দেওয়া যাবে। কিন্তু তাতে তো নির্জনতা আর বর্ষার এই পুরো আয়োজন বিফলে যাবে। ‘মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটবে! কিছু একটা, যা অনেক আগেই ঘটার কথা’—এমন পরিবেশে এর চেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত আর কী হতে পারে? নিশ্বাস ঘন হয়ে আসে আমার। এগোতে যাই।

রিয়া থামিয়ে দেয় আমাকে। উৎকর্ণ হই। ঘরের পেছনে বিলের দিক থেকে একটা ভারী পায়ের আওয়াজ এগিয়ে আসে। সে আওয়াজ মুহূর্তে সম্বিত ফেরায়। এতক্ষণ ঘোরের কারণে এমন পরিবেশে সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকিগুলো একদমই বিবেচনায় আসেনি!

পায়ের আওয়াজ বারান্দায় এসে থামে। একটি শক্ত পুরুষালি কাঠামো দুয়ারজুড়ে দাঁড়ায়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আর বিলম্ব করা ঠিক হইব না, বিরজা। নাও চইলা আসছে।

বিরজা?

ঘোরগ্রস্তের মতো উঠে পড়ে রিয়া। ওড়নাটা ঘোমটার মতো দিয়ে দাঁড়ায় লোকটির মুখোমুখি। বেরিয়ে যায় দুজনে।

রিয়া! রিয়া!!

হতচকিত আমার ডাক যেন ওদের কানে পৌঁছায় না। হেঁটে চলে যায় বিলের দিকে।

স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকি।

বিদ্যুৎ চমকের আলোয় বিলের মাঝখানে একটা নৌকা ভেসে যায়। রিয়া বসে আছে।

আজ কিছু একটা ঘটবে, ও বলেছিল। কিছু একটা, যা অনেক আগেই ঘটার কথা।