নিকোলাস ও বৃদ্ধের গল্প

২১ ডিসেম্বরের রাত একটায় যখন কফি অ্যান্ড স্টোরিজের মালিক নিকোলাস তিন কর্মচারীসহ দোকান বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন নিকোলাসের চোখ যায় দোকানের বারান্দায় বসে থাকা এক বৃদ্ধের ওপর। অন্যদের কাজ গোছাতে বলে সে নিজেই বৃদ্ধের কাছে এগিয়ে যায়।

স্যার, আমাদের বন্ধের সময় হয়ে গেছে…আপনি যদি…

নিকোলাসকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বৃদ্ধ বলে ওঠেন, একটা ব্ল্যাক কফি। নিকোলাস না বলতে গিয়েও পারল না; ভেতরে গিয়ে এক মগ ব্ল্যাক কফি নিয়ে এসে বৃদ্ধের সামনে থাকা টেবিলে রাখল। বৃদ্ধ তাকে চোখের ইশারায় বসতে বললে নিকোলাস বৃদ্ধের সামনের চেয়ারে বসল। ডিসেম্বরের কুয়াশাঘেরা, হাড়কাঁপানো শীতের এক রাতে অপরিচিত এক বৃদ্ধ আর নিকোলাস মুখোমুখি বসে আছে। বড় সাদা চুল-দাড়ির বৃদ্ধ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সামনের টেবিলে থাকা ছাইদানিতে নেভাতে নেভাতে প্রশ্ন করলেন, ইয়ং ম্যান, নাম কি তোমার?

বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তরে নিকোলাস তার নাম বলে হাতঘড়ি দেখে; আজ বাসায় ফিরতে দুইটা বেজে যাবে। সাদা সোয়েটার আর নীল জিনস পরিহিত আমুদে এই বুড়ো তার দেরি করিয়ে ছাড়বে, সে ভাবে।

বাহ! নিকোলাস! আমি কফি শেষ করতে করতে তোমাকে ছোট তিনটা গল্প বলি, দেরি না করে বৃদ্ধ শুরু করে দেন। বুঝলে নিকোলাস, প্রার্থনা বলে একটা দেশ ছিল। সেখানে সাগরে একটা লাল মাছ ছিল, যার বুকের কাছে একটা নীল ছোপ ছিল, লাল মাছটা নিজের ছোপ দেখে নিজেকে কুৎসিত ভেবে লুকাত লজ্জায়।

প্রথম গল্পটা শেষ করে বৃদ্ধ গরম কফিতে গলা ভিজিয়ে আবার শুরু করেন, সেই প্রার্থনা দেশে একটা গভীর বন ছিল। সেই বনে একদিন একটা সাদা বাঘের বাচ্চা ডাইনির হাতে পড়ল। বাচ্চা বাঘটা কাঁদতে শুরু করে দিল।

দ্বিতীয় গল্পটা শেষ করে বৃদ্ধ একটা সিগারেট ধরালে নিকোলাস প্রশ্ন করে, স্যার, আপনার নামটা জানা হয়নি। বৃদ্ধ নিকোলাসের কথা শুনে হাসে। কফিতে চুমুক দিয়ে বলে, প্রার্থনা দেশের রাতের আকাশে অসংখ্য তারা ছিল, একটা তারা ছিল যে অন্যদের মতো জ্বলত না। না-জ্বলা তারাটা অনেক দুখী ছিল।

নিকোলাস হেসে বৃদ্ধকে প্রশ্ন করল, এটা কেমন গল্প! গল্পের শেষ কোথায়?

বৃদ্ধ কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, পানি খাব। তারপর বলছি এটা কেমন গল্প এবং গল্পের শেষ কোথায়।

নিকোলাস ভেতরে গেল বৃদ্ধের জন্য পানি আনতে। পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এসে দেখে বৃদ্ধ নেই। টেবিলে রাখা চকচকে একখানা এক হাজার টাকার নোট। নোটের পাশেই রাখা একটা সাদা বাজারের ব্যাগ। নিকোলাস ব্যাগটা হাতে নিয়ে ভেতরে যায়। বৃদ্ধকে খোঁজে দোকানের ভেতরে। বাথরুমে, এমনকি রান্নাঘরেও। কোথাও বৃদ্ধকে না দেখে সহকর্মীদের প্রশ্ন করে জানতে পারে, তারাও বৃদ্ধকে যেতে দেখেনি। বিস্মিত নিকোলাস তার তিন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে দোকান বন্ধ করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। বৃদ্ধের সাদা ব্যাগটা সে নিজের সঙ্গেই নিয়ে এসেছে। দোকানে থাকলে যদি ব্যাগটা হারিয়ে যায়। তার বাড়ি থেকে দোকান ১০ মিনিটের পথ। বৃদ্ধ যখন ব্যাগটা নিতে আসবেন, সে এক দৌড়ে বাসায় এসে ব্যাগটা নিয়ে যাবে, নিকোলাস ভাবে।

বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে তালা খোলার সময় নিকোলাসের কানে আসে গানের সুর, নিকোলাস জানে সামনের বাসার গারনেট রোজ ছবি দেখছে। ছুটি থাকলেই মেয়েটা উচ্চ শব্দে সারা রাত ছবি দেখে। নিকোলাস দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আলোটা জ্বালায়, সাদা ব্যাগটা পড়ার টেবিলে রেখে খাটে গিয়ে বসে।

ঘরটা সে বেশ যত্ন করে সাজিয়েছে। চারকোনা ঘরটার এক দিকে খাট আর পড়ার টেবিল, আরেক দিকে রান্নাঘর আর বসার জায়গা। নিকোলাস জুতা খুলে বাথরুমে যায়। নিকোলাসের ঘরের সবকিছুই সাদা। খাট, সোফা, ফ্রিজ, পর্দা, বাথরুমের দরজাও।

বিছানায় যাওয়ার আগে নিকোলাসের সাদা ব্যাগটার কথা মনে পড়ে, ব্যাগটার কাছে গিয়ে সেটা খোলে। ব্যাগে কী আছে, সেটা দেখার জন্য নয়, ব্যাগে যদি বৃদ্ধের ঠিকানা অথবা ফোন নম্বর থাকে, সেই আশায়। নিকোলাস ব্যাগ খুলে দেখে একটা প্লাস্টিকের বড়দিনের গাছ, সঙ্গে অনেকগুলো মরিচ বাতি। নিকোলাসের মা মারা যাওয়ার পর থেকে আর বাসায় বড়দিনের গাছ আনা হয় না। সে গাছটা আর বাতিগুলো ব্যাগ থেকে বের করে সোফার সামনের চায়ের টেবিলে রাখে। গাছটা টেবিলের ওপর দাঁড় করিয়ে তাকে মরিচ বাতিগুলো দিয়ে সাজায়। তারপর বাতিগুলো জ্বালায়। ঘন সবুজ গাছটায় সোনালি বাতি জ্বলে ওঠে, আর কিছু বাতি জ্বলে না। বাতিগুলো হয়তো নষ্ট, নিকোলাস ভাবে। তারপর ঘরের আলোটা নিভিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। অন্ধকার ঘরে বসে গাছটা দেখে। বত্রিশের নিকোলাস ঠিক বারোতে চলে যায়।

শীতের সে রাতে স্বপ্নে নিকোলাস ঘুড়ি-নৌকা-ঘোড়ার দেশে চলে যায়। নিজেকে আবিষ্কার করে এক অদৃশ্য-আলোহীন তারার কায়াতে। তার জীবনের সব প্রিয়-অপ্রিয় মানুষ চোখের সামনে একেকটা জ্বলজ্বলে তারা হয়ে জ্বলছে অন্ধকার নিরুত্তাপ সীমাহীন মহাশূন্যে। শূন্যে ভেসে নির্বাক দেখে যায় প্রাচীন-পরিচিত-পরীক্ষিত মুখগুলোর কথা-হাসি-আলো। চোখ খুললেই অপার্থিব সুন্দর; বন্ধ করলেই পার্থিব একাকিত্ব। অন্ধকার তারার কায়াতে কষ্টে-ঈর্ষায় নিঃসঙ্গ নিকোলাসের নিজের হৃৎপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দনে যেনবা শতবর্ষ পার করে দেওয়ার শাস্তিভোগ হয়ে যায় অলৌকিক কোনো বিচারকের নির্দেশে।

হঠাৎ নিকোলাসের কানে ভেসে আসে অপরিচিত এক নারীকণ্ঠ। কম্পিত স্বরে সে বলে যায়, তোমার আলো লুকানো আছে এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের তৃতীয় তারার কাছে। নিকোলাস ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় দূরে থাকা প্রতিবেশী ছায়াপথের দিকে। অসংখ্য তারা-ধূলিকণা-গ্রহের মিলিত ধোঁয়াটে নকশায়, রহস্যময় সুন্দর নিজের ছায়াপথ পেছনে ফেলে। পথে কত তারাদের সঙ্গে দেখা হয়। কেউ জ্বলছে, কেউ তার মতোই ভাসতে ভাসতে কোথাও যাচ্ছে।

এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের প্রথম তারাটাকে দেখে নিকোলাস প্রশ্ন করে, তৃতীয় তারাটা কোথায় আছে বলতে পারো, মা?

দশ বছরের বাচ্চা মেয়ে, প্রথম তারা, আনন্দের সঙ্গে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে, সামনে গিয়ে ডানে যেতে হবে।

বাচ্চা তারাকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিকোলাস সামনে এগিয়ে যায়। পথে দ্বিতীয় তারার সঙ্গে দেখা হয়। সুন্দরী-মোহনীয়-যুবতী দ্বিতীয় তারা তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসে। নিকোলাস সৌন্দর্য দেখে-ছুঁয়ে-ডুবে-নিজের করে আঁকড়ে ধরার আদিম ইচ্ছা সংবরণ করে এগিয়ে যায় সামনে।

বহুদূর গিয়ে তৃতীয় তারাকে পায়। তৃতীয় তারার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করে, আমার আলো কোথায়, বুড়িমা?

তৃতীয় তারা, কোমর পর্যন্ত লম্বা সাদা চুলের মায়াবী চেহারার বৃদ্ধা হেসে চোখ টিপে নিকোলাসকে বলে, তুমি আমার কপালে চুমু খেলে তোমার আলো দিয়ে দেব।

নিকোলাস বৃদ্ধের কথা শুনে হেসে ফেলে আর ঠিক তখনই তার গা থেকে আলো বের হয়। সদ্য আলোকিত হওয়া নিকোলাস বৃদ্ধার দুই হাত ধরে তার কপালে চুমু খায়। এন্ড্রোমিডা ছায়াপথের তৃতীয় তারা সাদা চুলের বৃদ্ধার হাত ধরে হাসতে থাকে নিকোলাস। কথা বলতে থাকে। জ্বলতে থাকে অন্ধকার আকাশে। দূর থেকে দেখলে তাদের একটা নিমগাছের ছায়ার মতো লাগে।

২২-এর সকালটা অন্য রকম হয়। ঘুম ভাঙতেই নিকোলাসের চোখ যায় পায়ের কাছে আলো জ্বলতে থাকা গাছটার ওপর। নিকোলাস হাসে উদ্ভট স্বপ্নের কথা মনে পড়ায়। সোফার ওপর ঘুমিয়ে পড়ায় তার একটু ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছে, ঘাড়ে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার কাছে পড়ে থাকা দৈনিক পত্রিকাটি হাতে নিয়ে সে কফি বানাতে শুরু করে।

একতলা এই বাড়িটায় চারটা ঘর। একটা ঘরে বৃদ্ধ কামাল থাকেন, একসময় চোখের ডাক্তার ছিলেন; এখন অবসরে। একটা ঘরে থাকে নার্স জুলি, তার স্বামী রবার্ট আর দশ বছরের ছেলে পিটার। তিন নম্বর ঘরটায় খাবার জায়গা আর রান্নাঘর। নিকোলাসের ঘরটা সে বাড়ি থেকে আলাদা করে নিয়েছে। তার ঘরে ঢোকার আলাদা দরজা করেছে বাড়ির দরজার পাশেই। তারপর বাড়ির অন্য ঘরগুলো সে ভাড়া দিয়েছে। নিকোলাসের বাবা মারা যায়, যখন তার বয়স বিশ। তারপর মা মারা যায়, যখন তার বয়স ছাব্বিশ। নিকোলাসের বয়স এখন বত্রিশ আর এই বাড়ির বয়স ত্রিশ।

কফি শেষ করে নিকোলাস কাজের জন্য তৈরি হয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সারা দিন নিকোলাসের খুব ভালো যায়। বিকেলে নিকোলাস তার সহকর্মীদের জন্য নিজ হাতে পিৎজা বানায়। হাসিখুশি নিকোলাসকে দেখে সহকর্মীরা নিজেদের মধ্যে ‘নিকোলাসকে নিয়ে কানাঘুষা’ করেছে। রাত নয়টায় নিকোলাসের শিফট শেষ হলে সে বাসায় চলে যায়। ঘরে ঢোকার সময় পিটার এসে তার পা জড়িয়ে ধরে, পিটারকে কোলে নিয়ে সে ঘরে ঢুকে আইসক্রিম বের করে ফ্রিজ থেকে। তারপর সে আর পিটার সোফায় বসে আইসক্রিম খায় আর ‘টম অ্যান্ড জেরি’ দেখে। নিকোলাস এর ভেতর লক্ষ করে গাছটায় সোনালি বাতির সঙ্গে সবুজ বাতিও জ্বলছে। গাছটা আগের থেকে এখন আরও সুন্দর লাগছে আর বাতিগুলো জ্বলতে থাকায় নষ্ট বাতিগুলোও ঠিক হচ্ছে, সে ভাবে। পিটার চলে গেলে নিকোলাস তার প্রিয় চার্লস ডিকেন্সের বইটা নিয়ে বিছানায় যায়; ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায়।

সে রাতে নিকোলাস আবার ঘুড়ি-নৌকা-ঘোড়ার দেশে চলে যায়। এবার নিজেকে আবিষ্কার করে নিষ্পাপ এক সাদা বাচ্চা বাঘের চামড়া-মাংস-হাড়-রক্তের একের পর এক স্তরের শেষ স্তরে। যে স্তর সব থেকে ভেতরে। নিকোলাস তার ছোট শরীরটা নিয়ে একা ঘুরে বেড়ায় সন্ধ্যা নামা গহিন অজানা এক অরণ্যে। পশু-পাখি-কীটপতঙ্গ এবং তাদের সবুজ-সরল রাজ্য কৌতূহলী চোখে দেখে সাদা বাঘের বাচ্চাটিকে। পথে এক হরিণের সঙ্গে দেখা হলে সেটা ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। নদীর ধারে পানি খেতে গিয়ে পানিতে পড়ে যায় বাচ্চা বাঘটি। ক্লান্ত ভেজা শরীরটা অনেক কষ্টে পানি থেকে তুলে একটা বটগাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে বাচ্চা বাঘটি। রাতে হিংস্র শব্দ করে মেঘ গর্জে ওঠে, হিংস্র মেঘের সঙ্গী হয়ে বন্য ঝড়ও সঙ্গে আসে। কৃষ্ণরূপী বাতাস-বাজ-বৃষ্টির প্রাচীন জাদুকরি সুরে নৃত্যরত রাধা হয়ে ওঠে গাছ-পাতা-মাটি। ঘুম ভেঙে যায় বাচ্চা বাঘের। সে বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে লেপ্টে থাকে বটগাছের শেকড়ের সঙ্গে। অসম্ভব ঠান্ডা আর অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে তার ছোট হাত-পা-শরীর-আত্মা।

বাচ্চা বাঘটা একটু পরে দেখে সামনেই একটা গুহা থেকে আলো আসছে। নিজের ভয়ার্ত-ভেজা-ভারী শরীরটা নিয়ে সে এগিয়ে যায় আলোর দিকে। গুহার মুখে দাঁড়িয়ে দেখে এক ডাইনি বিশাল এক হাঁড়িতে রান্না করছে। কাঠের আগুনে চুলায় বসানো বিশাল হাঁড়ি থেকে ফুটন্ত পানির ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। হাঁড়ি থেকে মাথা বের করে চিৎকার করছে তার মতোই ছোট ছোট কিছু প্রাণী। গুহার অল্প আলোতে কুৎসিত ডাইনির বিকট হাসি আর হাঁড়িতে ফুটন্ত প্রাণীগুলোর মর্মান্তিক আর্তনাদ দেখে-শুনে-বুঝে ছোট সাদা বাঘের বাচ্চা ভয়ে জঙ্গলের ভেতর দৌড়াতে থাকল ঝড়ের মধ্যে। বাঘের বাচ্চাটা দৌড়ে জঙ্গলের বাইরে চলে যায়। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে একটা নিমগাছের নিচে।

তারপর একসময় সাদা বাচ্চা বাঘটার ঘুম ভাঙলে সে দেখে, একটা সাদা পরির কোলে সে শুয়ে আছে। পরিটা তাকে দেখে হাসে, আদর করে তার গালে, হাত রাখে তার মাথায়। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় পরিদের রাজ্যে। ধীরে ধীরে সাদা বাচ্চা বাঘটা বড় হতে থাকে পরিদের রাজ্যে।

২৩-এর সকালে নিকোলাসের ঘুম ভাঙে অদ্ভুত এক শূন্যতায়। বিছানা থেকে উঠে পড়ার টেবিলের সামনে যায় নিকোলাস। ফ্রেমে বাঁধানো তার ছোটবেলার ছবিটা হাতে নেয়। মা-বাবা তাকে কোলে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ পায় না, সে ভাবে।

সেদিন কাজ শেষে নিকোলাস তার বন্ধু ডা. সেনকে সঙ্গে নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে আসে কবরস্থানে। তার এই বন্ধুটা এবং আরও কিছু বন্ধু নিয়েই নিকোলাসের জীবন। আত্মীয় বলতে প্রায় নেই। ফেরার পথে সেন তাকে বিয়ে করার পরামর্শ দেয়। বন্ধু ডাক্তার হলে এই এক বিপদ, সবখানে সে রোগ আর রোগী খুঁজে পায়। যেমন তার মনে হয়, নিকোলাস ইদানীং ডিপ্রেশনে ভুগছে। সেনকে নিকোলাস আশ্বস্ত করে, সে ঠিক আছে এবং বাড়ির দিকে রওনা হয়।

ফেরার পথে প্রিয় তেহারি কিনে নিয়ে যায়, নিকোলাসের মা খুব ভালো তেহারি রান্না করতেন। সপ্তাহে অন্তত দুবার ছেলেকে রেঁধে খাওয়াতেন। অনেক দিন পর সে তেহারি নিয়ে ছবি দেখতে বসে। ‘কোকো’—তার প্রিয় ছবিটা আবার দেখে সে, মন ভালো করে দেওয়ার মতো ছবি। ছবি দেখা শেষ হলে সে লক্ষ করে গাছটায় আজ সোনালি, সবুজ ও নীল বাতি জ্বলে আছে। গাছটাকে গতকালের চেয়ে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে, সে ভাবে। গাছটা দেখে তার মনে পড়ে সে একটা কবিতা লিখেছিল। অনেক আগে কবিতা লিখত নিকোলাস। সোফা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলের নিচে থেকে সেই কবিতার খাতাটা বের করে নিকোলাস। পাতা উল্টে দেখে। একটা কবিতা আবৃত্তি করে জোর গলায়।

সবুজের সঙ্গে নীলের দেখা, লালচে এক শীতের সন্ধ্যায়;

অবাক সবুজ নীলকে সুধায়, এ রং সে পাবে কোথায়?

নীল তখন অহংকারী, উত্তর দেয় নাক উঁচিয়ে

সব রং কি সবাইকে মানায়?

এই গল্প তিনটি রঙের, নদীর মতোই তিন বাঁকে তার জীবন গড়ায়;

মানুষ তবে এক একটা রং, তফাত শুধু আঁকায়-ছায়ায়-মাত্রায়;

কেউ খোলা মাঠ হয়ে মিশে যায় সবুজের শান্তিতে

কেউ বন্ধ চিঠি হয়ে মিশে যায় নীলের কষ্টে

কেউ মিষ্টি জবা হয়ে মিশে যায় লালের ভালোবাসায়

সবাই রং, সব রঙের খেলা, জীবনের শূন্য ক্যানভাসে।

সে রাতে নিকোলাস স্বপ্নে দেখে, সে ঘুড়ি-নৌকা-ঘোড়ার দেশের সমুদ্রের তলদেশে একটা ভাঙা জলদস্যুদের জাহাজে বেড়ে ওঠা ছোট লাল গোল্ডফিশ হয়ে গেছে। ভাঙা জাহাজের গায়ে বড় বড় নিমগাছের নকশা করা; সেই জাহাজের আশপাশে অন্য কোনো জলজ প্রাণী আসে না। ভয় পায় আসতে। ভাঙা জাহাজে লাল গোল্ডফিশের সঙ্গে থাকে একটা বড় হাঙর মাছের ভূত। লাল গোল্ডফিশ ভূতের সঙ্গে থেকে এখন অভ্যস্ত, জল-জাহাজ-জীবন ভূতের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া কষ্টের হলেও পরে মানিয়ে নিয়েছে; মাঝেমধ্যে জীবনের স্বার্থে-প্রয়োজনে-অপারগতায় অনেক কিছু মেনে নিতে হয় মানুষ-কুকুর-পাখি-মাছকে। মাছে-ভূতে যখন মারামারি করে দিন কাটাচ্ছে, তখন তাদের জাহাজে আসে আরেকটা ছোট লাল মেয়ে গোল্ডফিশ। হাঙর ভূতের সঙ্গে অনেক ঝগড়া করে মেয়ে মাছটাকে ভাঙা জাহাজে নেওয়া হয় তাদের সঙ্গে। মাছটার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হলেও হাঙর ভূতের হয় না। ছোট দুটি লাল গোল্ডফিশ একসঙ্গে সমুদ্রের এক মাথা থেকে আরেক মাথা সাঁতরে বেড়ায়, আঁকড়ে বেড়ায়। কুড়িয়ে আনে সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থাকা প্রাচীন সব সোনা-রুপা-হিরা-রুবি। ধার করা গুপ্তধনে সাজায় সাগরের গভীরে পড়ে থাকা, পরিত্যক্ত ভাঙা জাহাজটিকে।

হঠাৎ একদিন সমুদ্রদেবতা বিরক্ত হয়ে ওঠেন মানুষের নির্মম অত্যাচারে। যুদ্ধ শুরু হয় জলের সঙ্গে স্থলের। সমুদ্রের জলে ঝড় ওঠে আর সেই ঝড়ে টুকরা টুকরা হয়ে ভাঙতে থাকে স্থল। ঝড়ে ভাঙা জাহাজের অবশিষ্টও সমুদ্রের জলের সঙ্গে ভেসে চলে যায়। একদিন মেয়ে গোল্ডফিশটাও চলে যায়। বলে যায়, এমন সাগরে যাচ্ছে যেখানে ঝড় ওঠে না। অনেক চেষ্টা করেও মেয়ে গোল্ডফিশকে ফেরানো যায় না। সে চলে যায় তার নতুন-নিরাপদ-নীল আশ্রয়ের খোঁজে। কষ্টে-ক্রোধে-ক্লান্তিতে ছেলে গোল্ডফিশের বুকে একটা ছোপ হয়ে যায় নীল রঙের। যুদ্ধ শেষে জিতে যায় জল। সময়-প্রকৃতি-দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে মানুষ জেতে না, হেসে বলে ওঠেন সমুদ্রের দেবতা। দেবতা ভাবেন, মানুষ অনেক বোকা। পরাজিত হবে জেনেও তারা যুদ্ধে যায় এই তিনের সঙ্গে।

বুকে নীল ছোপ নিয়ে সমুদ্রের তলদেশে পড়ে থাকা এক টুকরা ভাঙা কাঠের নিমগাছের নকশার দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলে গোল্ডফিশটা। তার পাশে এসে দাঁড়ায় চেনা-জানা-অজানা হাঙরের ভূত। মানুষ ছেড়ে গেলেও ভূতরা যায় না, হাঙর বলে ওঠে। সমুদ্রের গভীর জলের তলদেশে একা দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক মাছরূপী নিকোলাস। পাশে তার ছায়ার সঙ্গে মিশে থাকা আরেকটা ছায়া।

২৪-এর সকালে নিকোলাস ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় বসে মামুনকে ফোন দিয়ে জানায় সে আজ কাজে যাবে না। তারপর তৈরি হয়ে বেরিয়ে যায় বাজার করতে। বাসায় ফিরেই রান্না শুরু করে দেয়। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই একে একে তার অতিথিদের আগমন শুরু হয়। কামাল চাচা, জুলি আর রবার্ট, ছোট্ট পিটার, ডা. সেন, আর সবার শেষে আসে গারনেট রোজ। নিকোলাসের এক রুমের বাসায় বড়দিনের উৎসব জমে ওঠে কফির গন্ধে, বন্ধুদের হাসিতে, পিটারের দুষ্টুমিতে, গারনেটের গানে। সবাই খাওয়ার সময় নিকোলাস লক্ষ করে তার বড়দিনের গাছটিতে এখন সোনালি-সবুজ-নীল বাতির সঙ্গে লাল বাতিও জ্বলছে। গাছটায় এখন আর কোনো বন্ধ বাতি দেখা যাচ্ছে না। সবাই যেতে যেতে রাত দুইটা বাজল। যাওয়ার সময় তাদের জন্য নিকোলাসের কেনা উপহারগুলোও খুশি হয়ে নিয়ে গেল তারা। গারনেটকে বাসা অবধি এগিয়ে দিয়ে এল নিকোলাস। বাসায় ফিরে শাওয়ার সেরে এক মগ কফি নিয়ে গাছটার সামনের সোফায় বসল।

ঘরের দরজা আজ খোলা। শীতের রাতের অন্ধকার দেখতে ভালোই লাগছে। নিকোলাস নিজের কথা ভাবে। পৃথিবীতে এমন একটাই প্রাণী আছে যে তার সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে রাস্তায়-ডাস্টবিনে-নর্দমায় ফেলে দেয়, কিন্তু সেই প্রাণীর নাম বাঘ নয়। আর নিমগাছের নিচে ফেলে যাওয়া নিকোলাসকে নিজের কোলে তুলে নেয় যে, তার আসল নাম পরি হলেও ডাকনামটা হয় মা।

দৃষ্টির সঙ্গে তার দুই বছরের প্রেম আর চার বছরের সংসার শেষে যখন তার যাওয়ার সময় হলো, বলে গেল, তুমি থাকো তোমার মদ নিয়ে। এখন আর নিকোলাস সেটা খায় না। এমন কোনো সমুদ্র নেই, যার বুকে ঝড় ওঠে না। এমন কোনো মানুষ নেই, যার জীবনে ঝঞ্ঝার তরঙ্গ আসে না। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে যে চলে যায়, সে হয়তো জলের সঙ্গী ছিল। ঝড়ের সঙ্গী নয়। ভালোবাসা এত সহজ?

জীবন থেকে মানুষ-মদ-স্বপ্ন-প্রেম চলে যাওয়ার পর একদিন সুখটাও তাকে ছেড়ে চলে যায়। আবার একদিন তার কাছে ফিরে আসে সুখ। এসে বলে, সুখকে নিজের পরিচিত ছায়াপথে ছড়িয়ে দিতে হয়। তারপর অসংখ্য অপরিচিত ছায়াপথে। তারপর গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।

নিকোলাস দেখে গাছটার সোনালি-সবুজ-নীল-লাল বাতিগুলো এখন আর স্থির নেই। অদৃশ্য কোনো প্রাচীন সুরের তালে তারা কী সুন্দর করেই না নেচে যাচ্ছে! নিকোলাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো নৃত্যরত রঙের আলো দেখছে। সে ভাবে, বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে লাইটথেরাপি বলে। অলৌকিক ভাষায় বলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। আর তার ভাষায় এটা হলো নতুন করে বেঁচে ওঠা। নিকোলাস জানে, বিজ্ঞান বলে বিভিন্ন আলো আমাদের মস্তিষ্কে বিভিন্ন রকমের অনুভূতি তৈরি করে। সব কটি আলো মিলে তাহলে কোন অনুভূতি সৃষ্টি করে? মন কি তাহলে নেচে ওঠে?

নিকোলাস উঠে গিয়ে নৃত্যরত বাতিগুলোর জন্য একটা গান ছেড়ে দেয়। সান্তানার ‘মারিয়া মারিয়া’ গানের সঙ্গে বাতিগুলো মনের আনন্দে নাচতে থাকে। কফির মগ হাতে নিকোলাসও বাতিগুলোর নাচের সঙ্গী হয়ে যায় অন্ধকার ঘরে। তখন রাস্তায় দাঁড়ানো সেই রাতের বৃদ্ধটা নিকোলাস আর বাতিদের নাচ দেখে মুগ্ধ হয়ে নিজেও একসময় তাদের সঙ্গে নাচতে শুরু করে দেন গলির মাথায়। বৃদ্ধের পাশে থাকা কুকুরগুলোও মনে হয় যেন একটু দুলে ওঠে।

নিকোলাস-বাতিগুলো-বৃদ্ধ-কুকুরগুলোর সঙ্গে ঠিক ভোররাত ৪টা ৩০ মিনিটে নেচেছিল পৃথিবী-মঙ্গল-বৃহস্পতি-ছায়াপথের সবকিছু।

বৃদ্ধ দরজার ওপারে থাকা নিকোলাস এবং বাতিগুলোকে শেষবার দেখেন, একমুখ হাসি নিয়ে হাঁটতে শুরু করে দেন তাঁর কুকুরগুলো সঙ্গে নিয়ে। রাস্তা অন্ধকার থাকার জন্য বোঝা যায়নি কুকুরগুলো ছিল, নাকি হরিণগুলো ছিল। হাসিটা একটু জোরে ছিল বলে বোঝা যায়নি সেটা হা হা হা ছিল, নাকি হো হো হো ছিল। অন্ধকার থাকায় বোঝা যায়নি মাথার টুপিটা কালো ছিল, নাকি লাল ছিল।

বহু বছর পর নিকোলাস হয়তো তার এই গল্পটা আবার ভাববে এবং বহু বছর পরও নিকোলাস হয়তো জানবে না সেই রাতের বৃদ্ধটা কে ছিল।

অন্য আলোয় লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]