স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ ও গণতন্ত্রের বর্তমান

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

স্বাধীনতা অর্জন যেভাবে আমাদের স্বপ্ন ও প্রতিজ্ঞায় পরিণত হয়ে একটা জাতীয় চেতনার রূপ নিয়েছিল, গণতন্ত্রও তদ্রূপ। গণতন্ত্র অর্জনের স্বপ্ন বাঙালির রাজনীতিতে বহুকালই কেন্দ্রীয় উপাদান। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিলেও গণতন্ত্রের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাচ্ছে। এ কথা বিএনপির প্রতিধ্বনি হিসেবে বলা নয়। তেমনটা শোনাতে পারে বলেই এ নিয়ে একটা ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার।
বিএনপিই বাংলাদেশের অপর প্রধান দল। কিন্তু এই দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায়, অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক চেতনা ইত্যাদি বিশ্বাস করে কি না, সে বিষয়ে জনমনের সন্দেহ অমূলক নয়। দ্বিতীয়ত, দলটি গঠনতান্ত্রিকভাবেই অগণতান্ত্রিক এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধের কোনো প্রতিফলন তাদের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সাহিত্যে নেই। এসব সমালোচনার ন্যায্যতা প্রমাণের জন্য দৃষ্টান্ত রয়েছে হাতের কাছে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানাল, জঙ্গিবাদীদের আড়াল করল, যাতে তারা সমাজে শক্ত ঘাঁটি গড়তে পারে। তা ছাড়া পুরোনো পাকিস্তানি ধারার হিন্দু ও ভারতবিরোধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উসকে দিল। এক-এগারোর ঘটনায় বোঝা গেল, তাদের এ ভূমিকা রাজনীতির বাইরে থাকা মহলও পছন্দ করেনি, পাকিস্তানি লিগ্যাসি বহন করতে কেউ আর রাজি নয়। সমাজেও ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি নিয়ে সংবেদনশীলতা যথেষ্ট থাকলেও সাধারণভাবে ধর্মের নামে হানাহানি, রক্তারক্তি মানুষ পছন্দ করে না।
আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতা নির্ধারণ করছে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম। তাদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক আমলা, প্রতিষ্ঠিত ধনিক গোষ্ঠীর নতুন প্রজন্ম ও নতুন উঠতি ব্যবসায়ী এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের বিশাল তরুণসমাজের শিক্ষিত অংশ—এমনকি স্বল্পশিক্ষিত ও শিক্ষাবঞ্চিত অংশও রয়েছে। এরা বিশ্বমুখী ও ভবিষ্যৎ–মুখী। এরা জানে তাদের বর্তমান ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার মূলে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। এরাও পূর্ববর্তী প্রজন্মের মতো ধর্মচর্চায় আগ্রহী; কিন্তু তাদের মধ্যে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হয় সামান্যসংখ্যকই, অধিকাংশই পূর্ব প্রজন্মের মতোই ধর্মকে জঙ্গিবাদ পর্যন্ত টেনে নেওয়ার ঘোর বিরোধী। এদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে সন্দিগ্ধতা-সতর্কতা থাকলেও নির্বিচারে ভারত–বিরোধিতায় গা ভাসানোর বিপদ ও অসম্ভাব্যতা তারা বোঝে—কারণ, এ প্রজন্ম ভাববাদ ও আদর্শবাদের চেয়ে বাস্তবের বোধের দ্বারাই চালিত হয়।
যাদের কথা ওপরে বলা হলো, তাদের অধিকাংশই সমাজের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশ, বাকি যারা দারিদ্র্যের মধ্যে আছে, তাদের জীবনের প্রধান বিবেচ্য ব্যক্তিগত বৈষয়িক উন্নতি। ফলে জামায়াত বা জঙ্গিবাদ কিংবা পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি এ সমাজে প্রধান বা শক্তিশালী ধারা হবে না। দেশের একটি প্রধান দল এই বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থ হলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংকট গভীর হতে থাকে। অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধের গতানুগতিক বক্তব্যে বিরক্ত হতেন এবং দলটিকে অতীতমুখী আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু অতীতেও দেখা গেছে, সময়ের দাবি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ প্রয়োজনে নাম, নীতি, কর্মসূচি, বক্তব্য—সবকিছুতেই পরিবর্তন এনেছে। একে রাজনৈতিক সৃজনশীলতা আখ্যা দেওয়া যায় এবং তাতেই দলটি নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজও বড় দল হিসেবে টিকে আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের ধাত্রী সংগঠন মুসলিম লীগসহ পরবর্তীকালের বহু দল হয় বিলুপ্ত হয়েছে অথবা ক্ষয় পেয়ে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু এবং প্রায় সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ প্রমাণ দিতে পেরেছে যে মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তর এই স্বাধীন বাংলাদেশে নিছক ইতিহাস নয়, সমকালীন রাজনীতির প্রাসঙ্গিক বিষয়। সেদিক থেকে বলতে হয়, জামায়াতকে দোসর বানিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও গৌরবময় ঐতিহ্য নিয়ে অস্বচ্ছ অবস্থানে থেকে বিএনপি বরং অতীতচারী তামাদি চিন্তার দলে পরিণত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, বিলুপ্ত মুসলিম লীগের খোলসে সেজে দলটি একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে।
অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই বাস্তবতায় দেশে জঙ্গিবাদের হামলা শুরু হয়েছে। ১ জুলাইয়ে গুলশান হলি আর্টিজানের ঘটনার পর এটি জাতীয়ভাবে গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সংখ্যাগত শক্তি, অস্ত্রশক্তি, অর্থবল সব মিলিয়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের স্বপ্নকে তারা যেন বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করেছে। এটাও সত্য, এদের ধাত্রী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের ভূমিকা অস্পষ্ট নয়। আবার এই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি জোটবদ্ধ। এখানেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, কিংবা মানবাধিকারের ইস্যুগুলো রাহুগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জঙ্গিরা এসবকে পশ্চিমা ধ্যানধারণা হিসেবে মানে না। জামায়াতের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ একটি কৌশলগত চাল, কেননা তাদের ভেতরকার নীতি-আদর্শ তো একই। উভয়েই তো ওয়াহাবি ধারার সালাফিপন্থী। বিএনপি নীতিগতভাবে এ আদর্শের দল না হলেও ক্ষমতার রাজনীতির কৌশল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এদের সহায়তা নিয়ে আসছে। এই সুবিধার রাজনীতিই এ দেশে জঙ্গিবাদের ঘাঁটি গাড়তে সাহায্য করেছে।
মুশকিল হলো, ইসলামের আদিভূমির ও এর প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার কোনো মুসলিম সমাজেই যথার্থ সমাজসংস্কার হয়নি। মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সুফি সাধক ও অন্যদের বিশাল অবদান সত্ত্বেও ইউরোপের জাগরণের প্রেক্ষাপটে, অর্থাৎ চতুর্দশ শতাব্দী থেকে অবক্ষয়, স্থবিরতা ও চিন্তার দৈন্যের প্রতিফলন ঘটেছে এসব রাষ্ট্র ও সমাজে। ইউরোপ-বিজেতা মুসলিম জাতি ধীরে ধীরে সেসব রাজ্য হারাল, নিজেদের স্বাধীনতা খোয়াল এবং একসময় নিজেদের সমাজকে অন্ধকারে ঠেলে দিল।

>গণতন্ত্রের স্বপ্নপূরণের কাজ সমাজ থেকেই শুরু করতে হবে। সমাজকে অন্ধবিশ্বাসের সংস্কৃতিতে ফেলে রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল করা মুশকিল

সেই স্থবিরতা ও অন্ধকারের খেসারত দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলো। তাদের সরকারগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে যত দহরম-মহরমই করুক না কেন, নির্বাচনে দেখা যায়, কট্টরপন্থী ধর্মান্ধ দলগুলোই বিজয়ী হয়। এ বাস্তবতা কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে, গামাল নাসেরের মিসরে, বেন বেল্লার আলজেরিয়ায় কিংবা আরব বসন্তের সূতিকাগার তিউনিসিয়ায় একইভাবে সত্য। মুসলিম বা মুসলিমপ্রধান দেশে সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হলে ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা জানি, বাংলাদেশ ঠিক এসব দেশের মতো নয়। দীর্ঘ মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজও বজায় থাকায় দেখা যাচ্ছে, কিছু তরুণ নানা কারণে জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হলেও আমসমাজ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশকে কট্টর ইসলামপন্থার জঙ্গি ও প্রথাগত—উভয় ধারার রাজনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে আজ। এই বিশেষ সময়কে বিবেচনায় রেখেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। অর্থাৎ এই সতর্কতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি এই সংগ্রামও জরুরি। বাস্তবতাটা শাঁখের করাতই—দুধারী, দেখতে হবে জঙ্গি ও জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক ধর্মান্ধ শক্তি যেন মাথাচাড়া না দেয়, আবার সরকারও যেন কর্তৃত্ববাদের যূপকাষ্ঠে আত্মবলি না দেয়। এই পাহারাদারির দায় নাগরিক সমাজের।
এই বিস্মৃত ব্যাখ্যার পটভূমিতেই দেখতে হবে আমার এ নিবন্ধের প্রথম বক্তব্যটি—স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ হলেও গণতন্ত্রের স্বপ্ন আজ অধরা থেকে যাচ্ছে। তবে এ কথা বলা যাবে না যে আমরা একেবারে অগণতান্ত্রিক সমাজে পড়ে আছি। অনেক ক্ষেত্রেই গণতন্ত্রায়ণ হচ্ছে। কিন্তু জঙ্গিবাদের হুমকির মুখে জননিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা ও এর চেতনা, মূল্যবোধ রক্ষার প্রশ্নগুলো মুখ্য হয়ে ওঠে। অপর প্রধান দল বিএনপি তো এমন কোনো প্রমাণ দেয়নি যে এসব তাদের হাতে নিরাপদ। বাংলাদেশ এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আমরা লক্ষ করছি, ক্রমাগতই সরকার এবং তার বাহিনীগুলোর ক্ষমতা বেড়ে চলেছে। সরকারপ্রধান অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছেন। কঠোর গণতান্ত্রিক নীতির আলোকে এ নিয়ে আপত্তি করা স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার তার ক্ষমতা বা তার চেয়ে সঠিক হয় বলা যে জনগণের বিপুল ত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতা ও দেশের লক্ষ্যাদর্শকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে।
বাস্তবতা এমনটাই যে সুষ্ঠু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বাংলাদেশের সম্ভাব্য যে বাস্তবতা তা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেক খারাপ বলেই মনে হয়। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে জামায়াত ও জঙ্গিরা অতীতের মতো ক্ষমতার অংশীদার হবে, প্রশ্রয় পাবে—এমন দুশ্চিন্তার জোরালো ভিত্তি আছে। এই পরিণতি বর্তমান স্থিতি নষ্ট করতে পারে।
আশা করি, এ কথার সরল কোনো সিদ্ধান্ত টানবেন না কেউ। বিষয়গুলো আরও জটিল। আমি গণতন্ত্রের জন্যই সওয়াল করতে বসেছি। কিন্তু এখানে কট্টরপন্থা, আধা সামরিক সংস্কৃতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি-রাজনীতির অবক্ষয় এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। এসব কাজ সরকারের ওপর চাপিয়ে সমাজ নিশ্চেষ্ট থাকলে কাজ হবে না। সমাজ থেকেই সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে হবে।
গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ আদর্শ অর্জনের জন্য সরকারকে দায়ী করে দায়িত্ব সম্পাদনের চেয়েও জরুরি হলো সমাজকে এর জন্য তৈরি করা। সে কাজে সমাজ থেকেই আন্দোলন হওয়া দরকার। আমরা লক্ষ করি, জনসম্পৃক্ত এ ধরনের আন্দোলন একদম বিফলে যায়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ওসমানী উদ্যান রক্ষা, চট্টগ্রাম আদালত ভবন রক্ষা, এমনকি ইদানীং আমরা দুর্নীতি দমন কমিশনকেও আগের তুলনায় অনেকটাই সক্রিয় হতে দেখছি। সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনও বিফলে যাবে বলে মনে করি না। সমাজ যদি মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কারের যৌক্তিকতার পক্ষে জনমত তৈরি করে অভিন্ন জাতীয় স্কুল শিক্ষা প্রবর্তনের পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, তবে গণতন্ত্রের সংকট সহজে কাটবে না। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নানা মাত্রায় চলতেই থাকবে, যার উপজাত হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ উভয়ই প্রাণশক্তি ফিরে পেতে থাকবে।
গণতন্ত্রের স্বপ্নপূরণের কাজ সমাজ থেকেই শুরু করতে হবে। সমাজকে অন্ধবিশ্বাসের সংস্কৃতিতে ফেলে রেখে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সফল করা মুশকিল।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।