সুলতান সুলেমান কি দেখব, অপর্ণা?

সিরিজের প্রধান চরিত্র সুলতান সুলেমান ও হুররেম সুলতান
সিরিজের প্রধান চরিত্র সুলতান সুলেমান ও হুররেম সুলতান

ডিসেম্বর এলেই চনমনে রোদে পাই একাত্তরের বিজয়ের উত্তাপ। ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে চলার চরণধ্বনি। এরই মধ্যে হঠাৎ করেই আমাদের সামনে এল জঙ্গিবাদের বিপদ। হলি আর্টিজানের ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিল। এর আগে জেএমবি, বাংলা ভাই, হুজির বিপদ আমরা দেখেছি। দেশের মানুষ তাদের সমর্থন করেনি। তাদের দমন করা গেছে। কিন্তু এবার প্রথম দিকে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না এরা কারা। বিচ্ছিন্নভাবে ধরা পড়ছিল, কিন্তু সবগুলো টুকরো একখানে করে পুরো ধাঁধাটার সমাধান করা যাচ্ছিল না। কিন্তু হলি আর্টিজানের পরে পরিস্থিতির অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা আছে, এটা পৃথিবীকে আরও ভোগাবে। আমাদেরও তাই এক মুহূর্তও অবকাশ নেওয়ার উপায় নেই।
কিন্তু এই যুদ্ধেও যে বাংলাদেশ বিজয়ী হবে, তার কারণটি নিহিত রয়েছে এ দেশের মানুষের মধ্যে। এই দেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। এ দেশের সংস্কৃতিতে। এ দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, সমন্বয়বাদী, প্রেমময়। বিপ্লবীরা উদ্ধৃতি দেন, গেরিলারা মানুষের মধ্যে মিশে থাকবে, মাছ যেমন পানির মধ্যে থাকে। আমাদের দেশে কোনো চরমপন্থী, উগ্রতাবাদী, জঙ্গিবাদীর পক্ষে এই দেশের মানুষের মধ্যে মাছের মতো ডুবে থাকা সম্ভব নয়। মানুষ কোনো রকমের চরমপন্থা সমর্থন করে না।
আমরা যেন ভুলে না যাই, আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের শুরু ভাষা আন্দোলন থেকে। সাংস্কৃতিক আন্দোলন রূপান্তরিত হয়েছে স্বাধিকার আন্দোলনে, তা উন্নীত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। আজকেও আমরা যদি পথ হারিয়ে ফেলতে না চাই, আমাদের একটা সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। এবং তার সমস্ত উপাদান ও বাস্তবতা এই দেশের জল-হাওয়া-মাটিতে রয়েই গেছে।
এটা কি কল্পনা করা যায় যে ৩০-৪০ হাজার মানুষ, তাদের অনেকেই তরুণ, সারা রাত জেগে থেকে উচ্চাঙ্গসংগীত উপভোগ করবে? এটা হয়েছে, কারণ বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় সংগীতের রয়েছে সুমহান ঐতিহ্য। আর আছে আমাদের জারি-সারি-ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালি, আছে লালন-হাসন-রাধারমণ, আছে মৈমনসিংহ গীতিকা থেকে শাহ আবদুল করিম। আমাদের সংস্কৃতির সম্পদগুলো যদি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা মহা উদ্যোগ আমরা নিতে পারি, তাহলে এই দেশে অপসংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িকতা, ভেদবুদ্ধি, জঙ্গিবাদ, উগ্রপন্থা, হিংসা মোটেও জায়গা পাবে না।
এই প্রসঙ্গ দুটো সাম্প্রতিক বিষয় আলোচনায় আসতে পারে। গত ৩০ নভেম্বর টেলিভিশন শিল্পী ও কলাকুশলীদের ১৩টি সংগঠন শহীদ মিনারে সমবেত হয়েছিল ‘শিল্পে বাঁচি, শিল্প বাঁচাই’ স্লোগান নিয়ে। তাদের পাঁচ দফা দাবি। বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে বাংলায় ডাবকৃত বিদেশি সিরিয়াল বা অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ করতে হবে, টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণ, ক্রয়, প্রচারে ক্লায়েন্ট/এজেন্সির হস্তক্ষেপ বন্ধ করে চ্যানেলের অনুষ্ঠান বিভাগের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, অগ্রিম করের ন্যূনতম হার পুনর্নির্ধারণ করতে হবে, বিদেশি শিল্পী-কুশলীদের অবৈধ কাজ করা বন্ধ করতে হবে। এবং ডাউনলিংক চ্যানেলের মাধ্যমে দেশের দর্শকদের টার্গেট করে বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করতে হবে।
প্রথমেই এই সংগঠনগুলোকে ধন্যবাদ দিতে হবে যে তারা বুঝেছে, আমাদের চ্যানেলগুলোতে নৈরাজ্য চলছে, দেশের দর্শক বিদেশি অনুষ্ঠান ও চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। এর সমাধান যে তারা চাইছে, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে দুই মতই দেখছি। কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক স্বকৃত নোমান বলেছেন, ছোটবেলা থেকে আলিফ লায়লা বা সিন্দবাদ দেখে এসেছি, এটা কেন বন্ধ করতে বলা হবে? আমার নিজের মত হলো, আসলে দরকার একটা নীতিমালা। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নীতিমালায় ছিল, বিদেশে নির্মিত বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপনে বিদেশি মডেল ব্যবহার করা যাবে না। বিদেশে তৈরি বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য অতিরিক্ত মূল্য দিতে হবে। এই নিয়মের কথা কি আমরা ভুলে গেছি? নাকি এটা আর প্রযোজ্য নেই?
একটা নীতিমালা প্রণয়ন করা যায়, তাতে বলা থাকবে, একটা টেলিভিশন চ্যানেল তার প্রাইম টাইমের কত মিনিট বিদেশি সিরিয়াল দেখাতে পারবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণযুগে আমরা ম্যাকগাইভার কিংবা টিপু সুলতান তো বিটিভিতেই দেখেছি। কিন্তু পাশাপাশি রক্তকরবী, ইডিয়ট কিংবা সকালসন্ধ্যা কিংবা এইসব দিনরাত্রির মতো ধারাবাহিক নাটকও তো দেখেছি।
দ্বিতীয় প্রশ্নটাও দেখলাম ফেসবুকেই তোলা হয়েছে। একজন বিজ্ঞাপনদাতা সেখানেই বিজ্ঞাপন দেবেন, যেখানে দিলে তাঁর লাভ হয়। নিজেদের বাঁচাতে তাঁকে সেখানে বিজ্ঞাপন দিতে আপনি বাধা দিতে পারেন কি না। এই বিষয়ে আমার চিন্তাটা বলি। যখন শুনলাম, হুমায়ূন আহমেদের নাটক আজ রবিবার ভারতীয় চ্যানেলে হিন্দিতে দেখানো হচ্ছে, তখন খুব গর্ব হয়েছিল। হিন্দিভাষীরা বুঝুন বাংলাদেশেও ভালো নাটক হয়। কিন্তু যখন শুনলাম, এটা কেবল বাংলাদেশ থেকেই দেখা যায়, ভারতে দেখা যায় না, তখন মরমে মরে গেছি। হুমায়ূন আহমেদের সিরিয়াল এবার আমাদের হিন্দিতে দেখতে হবে, আমরা কি তাহলে বাংলা ভুলে গেছি! নাকি এটা আমাদের হিন্দি শেখানোর কৌশল? হিন্দি শিখতেও আমার আপত্তি নেই, বহু ভাষায় পারদর্শী হওয়া দারুণ ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে হুমায়ূন আহমেদের নাটক হিন্দিতে দেখতে হবে! কেমন যেন আত্মগ্লানি বোধ হয়। টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকদের সংগঠন মিডিয়া ইউনিটি এই ধরনের ডাউনলিংক চ্যানেলের অবৈধ প্রচার বন্ধ করতে বলেছে। বিদেশি চ্যানেলে বাংলাদেশের দর্শকদের উদ্দেশে বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারও নিয়মের বরখেলাপ। এরই মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয় এই অনিয়ম বন্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আইনে যদি না থাকে, তা করা যাবে না। যদি কেউ করার চেষ্টা করে, নিশ্চয়ই তা বন্ধ করতে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেই হবে।
ভারতেও কিন্তু বিভিন্ন রাজ্য নিজেদের তৈরি চলচ্চিত্র ও নিজ ভাষার টিভি চ্যানেলকে সুরক্ষা দেয়। পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা হলে হিন্দি ছবি চালাতে হলে অতিরিক্ত কর দিতে হয়। আর ভারত ও বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল প্রদর্শনের নিয়মের কী হাল? বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ভারতে দেখানো নিষিদ্ধ না হলেও এর ওপর মাত্রাতিরিক্ত মাশুল আরোপ করে রাখা হয়েছে। প্রতিটি চ্যানেলের জন্য ৫ কোটি ভারতীয় রুপি মাশুল দিতে হবে। এখন পর্যন্ত কলকাতায় প্রচারের জন্য ভারতে বাংলাদেশের কোনো টিভি চ্যানেল নিবন্ধিত হয়নি। অথচ বাংলাদেশে মাত্র ৩ লাখ টাকা মাশুল দিয়ে ভারতের চ্যানেল ডাউনলিংক করা যাচ্ছে (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর ২০১৬)।
এই বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের অবস্থান সবচেয়ে প্রশংসনীয়। ২০১৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ভারতের টিভি চ্যানেল সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করে তথ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) চিঠি পাঠান। যদিও সেই সুপারিশের কোনোটিই এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি (প্রথম আলো, ২৯ নভেম্বর ২০১৬)।
বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল ভারতে দেখাতে হলে যত টাকা মাশুল দিতে হবে, বাংলাদেশে ভারতের চ্যানেল দেখানোর জন্য সমপরিমাণ মাশুল নেওয়া হোক। অর্থমন্ত্রীর এই ধারণার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারি। এবং টেলিভিশনে প্রথম ৪০টি চ্যানেল বাংলাদেশি চ্যানেল হতে হবে, এই প্রস্তাবকেও আমরা সমর্থন করি
তবে আমরা যে পারিনি, সেটাও আমাদের স্বীকার করতে হবে। একটা সময় বিটিভি দেখার জন্য পশ্চিমবঙ্গবাসী ঘরের চালে ঘটিবাটি টাঙাত। এমনকি ৫১বর্তীও তো সারা পৃথিবীতে বহু বাংলাদেশি ও অনেক ভারতীয় দেখেছেন। কিন্তু এখন এত চ্যানেল! বেশির ভাগই রাজনৈতিক কারণে লাইসেন্সপ্রাপ্ত। তাদের পেশাদারি মনোভাব নয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন আছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে নাকি আর পেশাজীবীদের কদর নেই, আছে বাণিজ্যবুদ্ধি ও লবিস্টদের পোয়াবারো।
আর এখনো কি ভালো অনুষ্ঠান হয় না? হয়। দর্শক দেখেন না? দেখেন। দেখেন অনলাইনে, ইউটিউবে। এমনকি ভারতীয়রাও বাংলাদেশের নাটক দেখেন। টিভিতে নয়, অনলাইনে। কারণ, ওখানে বিজ্ঞাপনের অত্যাচার কম। কত মিনিটের অনুষ্ঠানে কত মিনিট বিজ্ঞাপন দেখানো যাবে, এটারও একটা নীতিমালা নিজেদেরই করে নেওয়া উচিত। হাফিংটন পোস্টের ব্লগে একটা সুন্দর লেখা লিখেছিলেন একজন ভারতীয় দর্শক, সৌরজিৎ আয়ার, তিনি করপোরেট এক্সিকিউটিভ ও লেখক। লেখার শিরোনাম, ‘কেন বাংলাদেশি টিভি-নাটক দর্শনযোগ্য?’ ওই লেখায় তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের টিভি-নাটক ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নয়, বরং প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিচ্ছবি, আবার তা আর্ট-ফিল্মের মতো একঘেয়ে নয়। বরং বেশ বিনোদনমূলক। এগুলোতে সামাজিক বক্তব্যও থাকে। তিনি বলছেন, এইসব নাটক পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দেখানোর ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ টাকা আয় করতে পারে। (http://www.huffingtonpost.in/sourajit-aiyer/why-bangladeshi-tv-dramas-are-worth-watching/)
আর দরকার বিটিভির স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনা। মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রীকে বলব, সারা দেশে একটা সাংস্কৃতিক গণজাগরণ তৈরি করুন। আর তথ্যমন্ত্রীকে বলব, বিটিভিকে পেশাজীবীদের হাতে তুলে দিয়ে এর স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হোন।
বাংলাদেশকে যদি জঙ্গিবাদ, উগ্রপন্থা, অসহিষ্ণুতা থেকে রক্ষা করে প্রীতিপূর্ণ একটা দেশ হিসেবে এগিয়ে নিতে হয়, সাংস্কৃতিক জাগরণের কোনো বিকল্প নেই। সংস্কৃতি ও ভাষার গরিমাই আমাদের দিয়েছে ’৫২, দিয়েছে ’৭১-এর বিজয়, এই গরিমাই আমাদের দেবে ভবিষ্যৎ বিজয়ের নিশ্চয়তা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক সুবিমল মিশ্রের একটা লেখার শিরোনাম ছিল, ‘সতীত্ব কি রাখব, অপর্ণা?’ অপর্ণা সেন ছিলেন পাক্ষিক সানন্দার সম্পাদক, তাঁর পত্রিকায় পাঠকের সমস্যার সমাধান বাতলে দেওয়া হতো। সুবিমল মিশ্র একজন পাঠিকা হয়ে বিদ্রূপ করে লিখছেন, ‘সতীত্ব কি রাখব, অপর্ণা?’
আমরা কী দেখব, কী দেখব না, সেটা যেমন আমার অধিকার, তেমনি আমার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য, আমার শিল্প, আমার অর্থনীতি রক্ষা করাও আমার অগ্রাধিকার। আমাকে যেন জিজ্ঞেস করতে না হয়, সুলতান সুলেমান কি দেখব, অপর্ণা? সুলতান সুলেমান আমাদের সংস্কৃতির জন্য ক্ষতিকর কি না, সে সিদ্ধান্ত যেন আমরা ঘরে বসে নিতে পারি এবং চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই নিতে পারে। তাদের সহায়তা করবে একটা সুন্দর নীতিমালা।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।