তোমাকে লিখছি, ২০১৭

.
.

২০১৭, তোমাকে লিখছি, তোমাকে লিখতে বসে বলতে চাইছি কতগুলো গোপন বেদনার কথা। জানো, একদিন আমিও কবি ছিলাম। কবি নাজিম হিকমত যেমন জেলখানার চিঠি লিখেছিলেন তাঁর প্রিয়তমাকে, তেমনি করে আমার একটা চিঠি লিখতে ইচ্ছা করছে। কাকে লিখব, সেটা অবশ্য বড় কথা নয়, কী লিখছি, সেটাই বড় কথা। ১৯৮৯ সালে, তখনো আমি ছাত্র, বেরিয়েছিল আমার প্রথম কবিতার বই, খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে। তেমনি করে খোলা চিঠি লেখা যায়, সুন্দরের কাছেই। এই প্রত্যাশায় যে, ২০১৭, তুমি সুন্দর হয়ো।
বলছিলাম, একদিন আমি কবি ছিলাম। ‘ছিলাম’ বলছি, এটা শিখেছি কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছে। নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতায় আছে, কবিতাটা সাক্ষাৎকারের আকারে লেখা, প্রশ্নকর্তা বলছেন, আপনি তো কবি? কবি বলছেন, না। কিন্তু আপনি তো কবিতা লিখেছিলেন? হ্যাঁ, যখন আমি কবিতা লিখেছিলাম, তখন কবি ছিলাম। এখন তো আমি কবিতা লিখছি না, কাজেই এখন আমি কবি নই।
কবি কে? বুদ্ধদেব বসু তাঁর শার্ল বোদলেয়ারের ভূমিকায় লিখেছিলেন, কবি তিনিই, যিনি সমস্ত পৃথিবীর হয়ে দুঃখ পান। আর জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—
আমি কবি, — সেই কবি, —
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!

কবি তিনিই, যিনি ঝরা পালকের বেদনাতেও কষ্ট পান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি এমনভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও আঘাত না লাগে, আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়। কবিরা এ রকমই বলতে পারেন।
২০১৭, তোমাকে বলি, আমিও কবি ছিলাম। আমিও কষ্ট পেতাম। রফিক আজাদের সেই চরিত্রের মতো, যে এমন নরম পালক এ রকম শক্ত মাটিতে পড়ে থাকা ঠিক নয় বলে কষ্ট পেয়েছিল। কিন্তু বলো, ২০১৭, আমি কি কবি? আমাদের চারদিকে এত নিষ্ঠুরতা, এত অমানবিকতা দেখেও চিৎকার করে যখন উঠিনি, পাগল হয়ে যাইনি, তখন আমি কি নিজেকে আর কবি বলে দাবি করতে পারি?
২০১৬ আমাদের কষ্ট দিয়েছে। অসহ্য কষ্ট। ২০১৭, তুমি ভালো হয়ে এসো, সুন্দর হয়ে এসো। তোমাকে নিয়ে যেন ২০১৮-এর কাছে আমাদের অভিযোগ করতে না হয়।
২০১৭, আমাদের অক্ষমতাকে তুমি কী বলবে। যেমন ধরো, গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জের চিনিকলের জমিতে বসত-গাড়া সাঁওতালদের ওই চালাঘর আর ছাপরাঘরগুলোতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, এই দৃশ্যও তো আমাদের দেখতে হলো। আমরা নিয়মমাফিক প্রতিবাদও করেছি, বিবেকের তাড়নায় কেউ কেউ ছুটেও গেছেন, আমিও লিখেছি একখানা কলাম, এই পাতাতেই, কিন্তু তাতেই কি প্রতিকার হয় আসলে? মনে কি হচ্ছে না, প্রতিকারহীন অপরাধে বিচারের বাণী এখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদছে। টেলিভিশনের খবরে দেখলাম, শীত নেমে আসছে, উত্তরবঙ্গের হিম রাত্রির ভয়াবহ শীত, আর অনেকগুলো শিশু-নারী এই শীতের রাতে থাকছে খোলা আকাশের নিচে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই কবিতাটার মতোই বলতে ইচ্ছা করছে, ‘আমি রাজনীতি বুঝি না, কিন্তু কতগুলো মানবসন্তান পড়ে থাকবে খোলা আকাশের নিচে, আমি তা সইতে পারছি না।’
সইতে পারছি না, কিন্তু সয়ে তো গেল, ২০১৭। ২০১৬–তে সয়ে নিয়েছি, ২০১৭, তুমি অমনটা হয়ো না।
কিংবা ধরো, মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে নৌকাভরা নারী-শিশু। আমরা বলি, ওরা রোহিঙ্গা। যেন রোহিঙ্গারা মানুষ নয়। কত দুঃখে মানুষ রাতের অন্ধকারে ভিটেমাটি ছেড়ে প্রাণভয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়, তা কি আমরা কোনো দিনও বোঝার চেষ্টা করেছি? যখন শিশু আয়লানের লাল শার্ট পরা দেহটা পুতুলের মতো পড়ে রইল সৈকতে, কেঁপে উঠল পুরো বিশ্ব। আমরাও বললাম, ইউরোপ, তোমার বন্দর বন্ধ করো না। অভিবাসীদের গ্রহণ করো। যখন আলেপ্পোর ধ্বংসস্তূপের ধূলিবালির মধ্যে শিশু ওমরান নিজের মুখে হাত দিয়ে দেখল রক্ত, সেই ছবি দেখাতে গিয়ে কাঁদতে লাগলেন সিএনএনের খবরপাঠিকা, আমরাও কেঁদে উঠলাম। এই পত্রিকার এই রকমের পাতাতেই আমি ওমরানকে নিয়ে লিখলাম কবিতা। ২০১৬ আমাদের দিয়েছে ওমরানকে, কিন্তু যেন আর কোনো ওমরান রক্তাক্ত না হয়, তা তো চাইবই তোমার কাছে, ২০১৭। কিন্তু আমাদের বাড়ির কাছে ঘটে যাচ্ছে এই রকমের অমানবিক হিংস্রতা, এথনিক ক্লিনজিং, চলছে যুদ্ধাপরাধ, আমরা কি তার যথেষ্ট প্রতিবাদ করতে পেরেছি?
আমরা নিশ্চয়ই চাইব এমন পরিস্থিতি যাতে কোনো রোহিঙ্গা বা সিরীয়কে যেন অজানার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠে পড়তে না হয়। পাশাপাশি এই বেদনাও তো বাজে, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সীমান্ত, কূটনীতি, ভবিষ্যৎচিন্তা, নিজ নাগরিকদের নিরাপত্তার প্রশ্ন আমাদের এতটাই বোধশূন্য করে তুলেছে যে, আশ্রয়প্রার্থী নারী-শিশুদের আমরা ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি যদি কবি হই, ঝরা পালকের বেদনাতেও তো আমার কষ্ট পাওয়ার কথা। মানুষের ক্রন্দন কেন তাহলে আমার বধির হৃদয়ের পাষাণ দেয়ালে বাধা পেয়ে ফিরে যাচ্ছে? ২০১৬ আমার গোপন বেদনার অব্যক্ত কান্না শুনতে পায়নি, ২০১৭ তুমি এমন ব্যবস্থা করো, যাতে তোমাকে তা শুনতে না হয়।
কিংবা ধরো, পত্রিকার প্রথম পাতায় ছবি ছাপা হলো—লাশের ছবি, তার নিচে বলা হলো, কিশোর জঙ্গি। কিশোর কথাটা শুনলেই তো আমার অন্য রকম অনুভূতি হওয়ার কথা। আমি তো কিশোর আলো নামের একটা পত্রিকা সম্পাদনাও করি। কিশোরদের নিয়ে পিকনিক করতে বেরিয়ে পড়ি শহর থেকে দূরে। তাদের নিয়ে কিআনন্দ নামের অনুষ্ঠান করি দিনভর। তারা বিজ্ঞান পড়বে, নাকি পড়বে মানবিক শাখায়, সেই নিয়ে প্রবন্ধ লিখি। আর একটা কিশোরের দেহ পড়ে রইল। জঙ্গি নামে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমরা?
২০১৭, বলো, কেন মানুষ এত আদর্শান্ধ হয়! কেন বড়রা তাদের মতবাদ চাপিয়ে দেয় এই রকম শিশু-কিশোরদের কোমল মনের ওপরে। কেন শিশুরা জিঘাংসু হবে, কেন আত্মঘাতী হবে? কেন তারা বোমা তুলে নেবে হাতে, তুলে নেবে চাপাতি, কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র! ওদের বলো, ২০১৭, ওদের বলো, আমাদের শিশুদের শিশু থাকতে দিন। আমাদের শিশুদের শৈশব কেড়ে নেবেন না। আমরা আর কোনো শিশুকে বোমার শেলবিদ্ধ হতে দেখতে চাই না। আর কোনো কিশোরকে হন্তারকের বেশে বা নেশায় উন্মত্ত দেখতে চাই না। আমরা একজনও মানুষ চাই না, যে অন্যের বেদনার কারণ হয়। অন্যকে আঘাত করে নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে যেন একজনও উদ্যত না হয়। পৃথিবী বিচিত্র, মানুষ বিচিত্র, বিচিত্র মানুষের গায়ের রং, ভাষা, সংস্কৃতি, মত, পথ। সবাই মিলেই এই পৃথিবীতে পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারতে হবে। স্রষ্টা সবাইকেই সমানভাবে আলো দেন, মেঘ-বৃষ্টি দেন, তিনি তো বৈষম্য করেন না।
২০১৬–তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব কিংবা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছে সংখ্যালঘু পরিবার। একুশ শতকেও মানুষে মানুষে কত ভেদ। মানুষ হা রে রে রে করে বেরিয়ে পড়ে অন্যের বসতবাড়িতে আক্রমণ করতে। মানুষ কবে প্রকৃত মানুষ হবে?
সময় বহমান। সময় ও নদীস্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময় নিরপেক্ষ। এই সব কথা আমরা বহুদিন ধরে শুনে আসছি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, সময় আসলে নিরপেক্ষ নয়। দুটো যমজ শিশুর একটাকে পাহাড়ের চূড়ায় আর একটাকে সমুদ্রতটে রেখে দিলে অনেক বছর পরে দুজনের বয়স এক থাকবে না, এটা আমরা এখন জানি। স্টিফেন হকিং তাঁর ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমে বলেছেন, এটা কোনো তাত্ত্বিক প্রস্তাবনা নয়, নিত্য আচরিত বাস্তব। স্যাটেলাইটে যখন কোনো সংকেত পাঠানো হয়, তার সময়ধারা আর পৃথিবীর সময়ধারা যে এক নয়, এটা হিসাব কষেই সেসব পাঠানো হয়। যে সময় চলে যায়, তা আর ফিরে আসবে কি না, আমরা ঠিক জানি না। তবু ২০১৬-কে বিদায় জানাই। স্বাগত জানাই ২০১৭, তোমাকে। আর বলি, ২০১৬-তে আমরা যে বেদনা পেয়েছি, তা যেন ২০১৭–তে না পাই। জানি, সময়ের কাছে চাইবার কিছু নেই। যা কিছু প্রার্থনীয়, তা অর্জন করে নিতে হয়। ২০১৬–তে তা যে আমরা করতে পারিনি, সেই ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো।
কবি নাজিম হিকমতের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। তঁার কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি চিঠি লিখেছিলেন জেলখানা থেকে। আমরাও যেন এক জেলখানাতে বন্দী। আন্তর্জাতিকতাময় এক জেলখানা, রাষ্ট্র নামের এক জেলখানা, বিশ্বব্যবস্থা নামের এক জেলখানার বন্দী আমরা। তবু নাজিম হিকমতের মতোই আমাদের আশাবাদী কণ্ঠে বলতে হবে, বারবার করে—

দুঃসময় থেকে সুসময়ে
মানুষ পৌঁছে দেবে মানুষকে
আমাদের ছেলেটা নিরাময় হয়ে উঠবে
তার বাপ খালাস পাবে জেল থেকে
তোমার সোনালি চোখে উপচে পড়বে হাসি
আমার আর আমাদের এই পৃথিবী একই সূচ্যগ্রে দাঁড়িয়ে!

যে সমুদ্র সব থেকে সুন্দর
তা আজও আমরা দেখিনি।
সব থেকে সুন্দর শিশু
আজও বেড়ে ওঠেনি
আমাদের সব থেকে সুন্দর দিনগুলো
আজও আমরা পাইনি।
মধুরতম যে-কথা আমি বলতে চাই।
সে কথা আজও আমি বলিনি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।