কয়লা নিয়ে জেদাজেদির রাজনীতি

সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে

বাগেরহাট জেলার রামপালে বাংলাদেশ সরকার একটা কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রস্তুতিমূলক কাজও এগিয়ে গেছে অনেক দূর। শুরু থেকেই এই প্রকল্পের সমালোচনা হচ্ছে। সমালোচকদের মধ্যে আছে পরিবেশবাদী কয়েকটি এনজিও, বেশ কয়েকটি নাগরিক সংগঠন এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল। সমালোচনা শুধু টক শো আর বিবৃতির মধ্যে থেমে নেই। তাঁরা রাস্তায় নেমে আন্দোলনও করছেন। এ বিষয়ে যাঁরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত কিংবা দাবি করেন, তাঁদের অনেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সরব, কেউ কেউ এর সমর্থক এবং চেনাজানা অনেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। বিষয়টা যেন জেদাজেদির পর্যায়ে চলে গেছে। আর পরস্পরবিরোধী তত্ত্ব ও দাবির মাঝখানে পড়ে আমজনতা খাবি খাচ্ছে।
সমালোচনা এবং বিরোধিতা যদি নাগরিক সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে হয়তোবা সমাধানে পৌঁছানোর একটা সম্ভাবনা ছিল। অতীতেও এমনটি হয়েছে। নাগরিকদের কণ্ঠে প্রতিবাদ উচ্চারিত হওয়ায় সিদ্ধান্তে পরিবর্তন এসেছে। উদাহরণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের প্রস্তাবিত স্থান পরিবর্তনের কথা বলা যেতে পারে। কিন্তু রামপালে হঠাৎ করেই বিএনপি ঢুকে পড়েছে। ফলে সমীকরণটা একটু পাল্টে গেছে।
বিএনপি যে পরিবেশ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়, তা বলা যাবে না। বুঝতে হবে, পরিবেশবাদীদের এবং সংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজের এ নিয়ে মাথাব্যথা এবং শঙ্কা থাকলেও বিএনপির কারণে বিষয়টিতে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই, সরকার পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে যদি সরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা নিঃসন্দেহে নাগরিকদের সাধুবাদ পাবে। কিন্তু বিএনপি তখনই মহাসমারোহে ‘সুন্দরবন বিজয়’ উৎসব পালন করে বলবে, ‘আমাদের ন্যায্য দাবির কাছে এই অনির্বাচিত সরকার মাথা হেঁট করেছে। এদের আর ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই।’ আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এটা হজম করা প্রায় অসম্ভব। পরিবেশবাদীদের দাবি যতই ন্যায্য এবং যৌক্তিক হোক না কেন, বিএনপির ‘সমর্থন’ তাদের বিপদে ফেলে দিয়েছে। আমার জানামতে, রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতাকারীদের বেশির ভাগই বিএনপির রাজনীতির বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। তারপরও তাঁদের শুনতে হচ্ছে যে তাঁরা ‘বিএনপি-জামায়াতের তল্পিবাহক এবং দেশের উন্নয়ন চান না।’
প্রচার-প্রচারণায় আন্দোলনকারীরাও কম যান না। সরকার দেশ বেচে দিচ্ছে, ভারত এই প্রকল্প চাপিয়ে দিয়েছে এবং শেখ হাসিনা স্বয়ং সুন্দরবন ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছেন—এ ধরনের কথাবার্তা এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে।
স্কুলে আমাদের একজন শিক্ষক দিনিয়াত পড়াতেন। ক্লাসে দুষ্টুমি করলে শুধু কানমলা দিতেন না, সুর করে বলতেন—কয়লার ময়লা যায় না ধুলে, স্বভাব যায় না মরলে। তখন এতটা বুঝতাম না। কয়লার আবার ময়লা কী? এখন কিছুটা হলেও বুঝি যে কয়লা যতই ধোয়া যায়, তা থেকে কালো রং বের হবে, অর্থাৎ কয়লার গুঁড়া মেশানো পানি দেখা যাবে। কয়লার দূষণ নিয়েই এই কথা।
কয়লাকে বলা হয় ‘ভার্টি ফুয়েল’, জলবিদ্যুৎ ছাড়া আর অন্য যেকোনো ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্পে দূষণের আশঙ্কা থাকে। কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে থাকে সবচেয়ে বেশি। প্রকল্পের স্থান সুন্দরবনের খুব কাছে। আমরা যুক্তি শুনছি, প্রকল্প এক জায়গায় না হলে আরেক জায়গায় করা যেতে পারে। কিন্তু সুন্দরবন তো একটাই। ওটা খোয়া গেলে তো আরেকটা পাওয়া যাবে না। সুন্দরবন নিয়ে এ দেশের মানুষের আবেগ অপরিসীম। সুন্দরবন ধ্বংস করে একটা ১৩২০ মেগাওয়াটের প্ল্যান্ট হোক, এটা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। আন্দোলনকারীরা সবাই নির্বোধ, এটাও ভাবা যায় না। সরকার ইচ্ছে করে সুন্দরবন ধ্বংস করে দেবে, এটাও তো বিশ্বাস হয় না। তাহলে গোল বাধল কোথায়?
রামপালে বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট হলে তার প্রভাবে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে কি না, এ নিয়েই মতভেদ। ক্ষতি হবে—এটা কি ভয় না বাস্তবতা? এই আশঙ্কা কি হাইপোথেটিক্যাল না প্রমাণিত? সরকারের কর্তারা বলছেন, সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। প্রধানমন্ত্রীও একই কথা বলছেন। আবার অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ক্ষতি হবে, তবে আমরা এটা করব।’ বোঝা যাচ্ছে, সরকারের মধ্যেও ভিন্ন মত আছে।
এটা ঠিক যে রামপালের কয়লায় সুন্দরবনে যে আঘাত আসবে, তা ভবিষ্যতের জন্য একটা অনুমান। এই অনুমানের পেছনে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত আছে বলে আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন। কিন্তু অতীত ও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, রামপালে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র না হলে কি সুন্দরবন চিরকাল টিকে থাকবে? এই গ্যারান্টি কে দিল?
গত কয়েক দশকে সুন্দরবন আক্রান্ত হয়েছে নানাভাবে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে উজান থেকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার ফলে। এখানে প্রধান খলনায়ক হলো ফারাক্কা বাঁধ। এ নিয়ে অতীতে অনেক আলোচনা ও লেখাজোকা হয়েছে। এখন বিষয়টা নিয়ে কেউ আর তেমন মাথা ঘামান না। শুকনো মৌসুমে উজানের পানি ভারত আটকে দেওয়ায় পদ্মার পানি দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকছে না। ঢোকার প্রধান পথ গড়াই নদের মুখ শুকিয়ে গেছে। ফলে সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এতে চিংড়িচাষিদের পোয়াবারো হলেও সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন চলতে থাকলে সুন্দরবন হয়তো বড়জোর আর ৫০ বছর টিকে থাকবে, এমনটা বলে থাকেন কেউ কেউ। এর সঙ্গে যদি রামপাল যোগ হয়, তাহলে সুন্দরবনের আয়ু হয়তো কমে ৪০ বছরে দাঁড়াবে। অর্থাৎ, সুন্দরবন আর বাঁচানো যাবে না, ১০ বছর আগে হোক কিংবা পরে। এই সময়ে আমরা না হয় কিছু বিদ্যুৎ পেলাম, এই যা লাভ। আমি বিশেষজ্ঞ নই। তবে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন বলে আশা রাখি।
আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে আমার ধারণা বেশ ইতিবাচক। তাঁদের মধ্যে দু-একজন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাঁরা নিঃস্বার্থভাবেই এই দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে তাঁদের সঙ্গে বসন্তের কোকিলও আছেন কেউ কেউ। সুযোগ পেলেই বিবৃতিতে সই দিয়ে তাঁরা সংবাদ শিরোনাম হতে চান।
এই আন্দোলনে আমি দুটো কৌশলগত ত্রুটি লক্ষ করেছি। তাঁরা বলছেন, প্রকল্পটি রামপাল থেকে সরিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হোক। আমার প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে তো কোনো তেপান্তরের মাঠ নেই। সরিয়ে কোথায় নেওয়া হবে? সব জায়গায় তো মানবশিশু আছে, গাছ আছে, মাছ আছে। কয়লা তো আর দূষণমুক্ত হবে না? ধরা যাক, বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট রামপাল থেকে সরিয়ে নেত্রকোনায় নিয়ে যাওয়া হলো। তখন কি নেত্রকোনায় এর দূষণ হবে না? সেখানকার মানুষ কি ক্ষতির মুখে পড়বেন না? সমস্যা কি রামপাল, না কয়লা? বলা হয়, সুন্দরবন তো একটাই, ওটা ধ্বংস হয়ে গেলে আরেকটা সুন্দরবন তৈরি হবে না। যুক্তি অকাট্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু নেত্রকোনায় আমার সন্তান যদি কয়লার দূষণে হাঁপানি বা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, তার দায়িত্ব কে নেবে? আমার একটা সন্তান গেলে আরেকটা আমি কোথায় পাব? আমি মনে করি, কয়লার ব্যবহার নিয়ে আমাদের একটা রাষ্ট্রীয় নীতি থাকা খুবই জরুরি।
আমি আরেকটা বিষয় লক্ষ করেছি। সুন্দরবনের প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী হলেন বৃহত্তর খুলনা জেলার মানুষেরা। সুন্দরবন একটা প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধক। এটা না থাকলে ঘূর্ণিঝড়ে ওই এলাকা অনেক আগেই বিরান হয়ে যেত। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছি, আন্দোলন হচ্ছে ঢাকার শাহবাগে। রামপালের নাকের ডগায় বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরায় কোনো আন্দোলন নেই। সম্প্রতি স্কুলের বন্ধুদের এক আড্ডায় অধ্যাপক বদরুল ইমামের সঙ্গে দেখা। তিনি এই আন্দোলনের একজন গোঁড়া সমর্থক।
আমি এ বিষয়টা তাঁর কাছে তুললাম। বললাম, স্থানীয় মানুষেরা নেতৃত্ব দিলে বা অংশগ্রহণ করলে আন্দোলন সফল হয়। কানসাট ও ফুলবাড়ী তার বড় প্রমাণ। বেঁচে থাকার তাগিদে এবং রুটি-রুজির নিরাপত্তার জন্য ওই সব এলাকায় স্থানীয় কৃষকেরা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা থেকে সুশীলরা পরে তাতে যোগ দিয়েছেন, সমর্থন করেছেন। রামপাল নিয়ে স্থানীয় মানুষেরা এত নিস্পৃহ কেন? বদরুল বললেন, ‘আমরা ইচ্ছে করলেই ওখানে লাখো মানুষের সমাবেশ ঘটাতে পারি।’ আমি বললাম, তাহলে তা করছেন না কেন?
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, শুধু অ্যাকটিভিস্ট দিয়ে আন্দোলন সফল করা যায় না। এ জন্য দরকার জনসমর্থন এবং তাদের সচেতন অংশগ্রহণ। সাধারণ মানুষ সুপার ক্রিটিক্যাল আর আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি বোঝে না। মানুষকে বোঝাতে হবে, ক্ষতিটা কোথায় এবং কী প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে চাই। এ দেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ শিরোনামে একটা পোস্টার বের করল, নিমেষেই যেন দৃশ্যপট পাল্টে গেল পুরোপুরি। সাধারণ মানুষের ভাষায় তাদের মনের কথাটি বলতে পারার মধ্যেই সাফল্য আসে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ভূমিধস বিজয় পেয়েছিল, এই পোস্টার ছিল তার একটা বড় অস্ত্র। সাধারণ মানুষ অত তত্ত্বকথা বোঝে না, এটাও আমাদের বুঝতে হবে।
শেখ হাসিনার সরকার সুন্দরবন ধ্বংস করে ফেলবে, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। কারণ, এতে শেখ হাসিনার কী লাভ? একই সঙ্গে আমি মনে করি, যাঁরা সুন্দরবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তাঁরাও দেশপ্রেমিক। তাঁদের ঢালাওভাবে বিদেশি কোনো শক্তির দালাল বলার মতো রুচিহীনতা কেন দেখাব?
যুক্তির ঝুলি শূন্য হয়ে গেলে প্রতিপক্ষকে গালাগাল দেওয়া যেন আমাদের খাসলত। তারপরও কথা থাকে। বিদ্যুৎ প্রকল্পটি রামপালেই কেন করতে হবে? আমরা যদি ৩০-৪০ হাজার মেগাওয়াটের উৎপাদন ক্ষমতায় পৌঁছানোর চিন্তা করি, তাহলে সামান্য ১৩২০ মেগাওয়াট নিয়ে কেন এই জেদাজেদি?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক।
[email protected]