আসন ও আবাসন দেওয়ার মালিকেরা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি আবাসিক হলের আসন বরাদ্দ, দখল ও প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে হলগুলোর প্রকৃত পরিস্থিতি কী, তা নিয়ে আবার আলোচনা শুরু হয়েছে। বিজয় একাত্তর ও রোকেয়া হলে দুটি ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে, এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো চালায় মূলত ছাত্রলীগ। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের সমন্বয়ে যে প্রশাসনিক কাঠামো রয়েছে, বর্তমানে তার ভূমিকা কী? উত্তরে বলা যায়, এই প্রশাসনিক কাঠামোর অন্যতম কাজ ছাত্রলীগের এই ছদ্ম প্রশাসনের বৈধতা দেওয়া। সেটা কী রকম, লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে তা দেখা যাক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে প্রায় বিনা পয়সায় বসবাস করা যায়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার দশেক টাকায় ভদ্রস্থ একটা বাসাও পাওয়া যায়। বলছি বিভিন্ন হলে হাউস টিউটরদের বাসাগুলোর কথা। লোকেশন হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা নেই, শহরের একেবারে কেন্দ্রে এর অবস্থান। এতটা খোলামেলা জায়গা, এত গাছপালা-সবুজ, এত নিরাপত্তা ঢাকা শহরের কোথাও নেই বললেই চলে। যারা মফস্বল থেকে আগত, যারা ঢাকায় নতুন, সেই শিক্ষার্থীমাত্র হলে থাকতে চাইবে, সেই শিক্ষকমাত্র হাউস টিউটর হতে চাইবেন। অবশ্য এ জন্য তাঁদের কিছুটা ত্যাগ শিকার করতে হবে। শিক্ষার্থীকে ছাত্রলীগের দ্বারস্থ হতে হবে এবং শিক্ষককে নীল দল করতে হবে।

ফলে আবাসন-সংকটে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা আজকাল সবাই যথাক্রমে ছাত্রলীগ করে ও নীল দল করেন। মধুর ক্যানটিন চত্বরে প্রায়ই দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রলীগের প্রচুর কর্মীকে দেখা যায়। আর নীল দলের সভা যে লাউঞ্জে হয়, সেখানে স্থান সংকুলান হয় না। বলা যায়,ÿ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি টিকে থাকে হলের এই আসনগুলোর কারণে আর শিক্ষকদের রাজনীতিও টিকে থাকে হাউস টিউটরশিপের বরাতে। এর বাইরেও কিছু ব্যাপার আছে, তবে এটাই হলো মূল কারণ। ফলে জনবহুল ও ব্যয়বহুল রাজধানী শহরে আসন ও আবাসন নিয়ে চলছে মূলধারার ছাত্র ও শিক্ষকদের রাজনীতি।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ২০১১ সালের দিকে বাইরে বাসাভাড়া গুনতে গিয়ে আমার নাকাল দশা। পরিবার থেকেও চাপ, সবাই বাসা পায়, আমি পাই না, যেন ব্যর্থ এক ব্যক্তি আমি। উপাচার্য মহোদয় আমার বিভাগের। উনি কোনো প্রভোস্টকে বলে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আমি দেখা করে বললাম, স্যার, হাউস টিউটর হতে চাই। উনি বললেন, প্রভোস্টদের বলো। কিন্তু আমি বেশি প্রভোস্টকে চিনি না, খুব কম প্রভোস্টই আমাকে চেনেন। হাসিখুশি সজ্জন দেখে একজন প্রভোস্টকে নিবেদন জানালাম। তিনি বললেন, তোমাকে নিতে পারলে তো ভালোই হতো, কিন্তু এই দফা হচ্ছে না। পরের সার্কুলারে আবার অ্যাপ্লাই করলাম। এবার এগিয়ে এলেন ওই হলের এক হাউস টিউটর। সেই শুভাকাঙ্ক্ষী বললেন, একটু আমাদের সভায় আসেন, একসাথে চা-টা খাই, বোঝেনই তো...। সভায় গেলাম। নীল দলের সভায় আমাকে দেখে প্রভোস্ট মহোদয়ের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এর অর্থ হলো, এবার তিনি আমায় নিতে পারবেন। আমি সহকারী হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ পেলাম।

কিন্তু যে জন্য এত কিছু, সেই বাসাই তো নেই। হাউস টিউটরশিপ শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু আগের লোকজন বাসা ছাড়েননি। ফুলার রোডের বড় বাসায় গেলে পুরো হাউস রেন্ট কাটা যাবে। নানান অছিলায় তাঁরা এখানেই কম ভাড়ায় থেকে যেতে চান (তখন হাউস টিউটরদের ভাড়া কাটা হতো মাত্র ৬ হাজার টাকা)। এসব ক্ষেত্রে প্রভোস্টকে উদ্যোগ নিতে হয়, কঠোর পদ‌ক্ষেপ নিতে হয়, তিনি নেন না। পাশেই ব্যাচেলরস কোয়ার্টারে (নামেই কেবল, এগুলোতে শিক্ষক পরিবারই থাকে) বাসা খালি হলো। হলের বাসা খালি নাই, হলের কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে অসুবিধা হচ্ছে, এই বাসাটি আমাকে দেওয়া হোক—এই মর্মে একটা চিঠি সরাসরি উপাচার্যকে লিখলাম। প্রভোস্টের সম্মতিসহই এই আবেদনপত্র লিখলাম। উপাচার্য মহোদয় পুনরায় বললেন, প্রভোস্টকে বলো। প্রভোস্ট বললেন, এ বিষয়ে আমার কী করার আছে? আমি বুঝলাম, এ হওয়ার নয়। আমি পদত্যাগ করলাম।

আমি পদত্যাগ করি ২০১৩ সালে। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১৮ মাস, হল প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ আমি। আমাদের প্রভোস্ট প্রশাসক হিসেবে ভালোই ছিলেন। গুছিয়ে কাজ করেন তিনি। একেক ব্লকের দায়িত্ব একেক শিক্ষককে দিয়ে দেন। কে কোন রুমে থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের তেমন ছিল না। আমাদের দায়িত্ব ছিল, যে যেখানে আছে, তাদের বৈধ করা। আমরা ছাত্রদের ফরম দিতাম, অনুরোধ করতাম, বিনা পয়সায় তো থাকা ঠিক না। ফরমটা পূরণ করে ব্যাংকে সামান্য টাকাটা দিয়ে বৈধ হয়ে যাও বাবা! কে জানে, রেইড-টেইড হলে বিপদে পড়বা। তারা ‘জি স্যার, অবশ্যই’ বলে ফরম নিত, কিন্তু এক-দুজন ছাড়া বৈধ হতো না। এরপর আমরা ছাত্রলীগের হল সভাপতি ও হল সেক্রেটারিকে বলতাম যে ওরা তো বৈধ হচ্ছে না, তোমরা একটু বলে দাও। ওই দুই ছাত্রনেতা সব সময়ই ভদ্র আচরণ করত। বলত ‘জি স্যার, অবশ্যই’। কিন্তু এর কোনো ফল দেখা যেত না। এদিকে প্রভোস্ট চাপ দিতেন, কই, কার কী আপডেট? যারা একটু নরম স্বভাবের, তাদের বকাও দিতেন, কাজের অগ্রগতি নেই দেখে। অগ্রগতি থাকবে কী করে? বৈধকরণ তো দূরের কথা, একেক রাউন্ডে কোন রুমে কে আছে, তার নাম টুকে আসতাম। পরেরবার গিয়ে দেখি, সেই ব্যক্তি আর ওখানে নেই। এ রকম গতিশীল আবাসন পরিস্থিতিতে, রেজিস্টার বুক হাতে আমরা ছিলাম অসহায়। আমার ব্লকে কোনো গণরুম ছিল না। কিন্তু অন্য ব্লকের গণরুমগুলো ছিল অধিক গতিশীল। অন্য হাউস টিউটরের মুখে শুনতাম নিত্যনতুন মুখের আত্মপ্রকাশের কাহিনি। অর্থাৎ কোন রুমে কে থাকবে, কে থাকবে না, কত দিন থাকবে—এ সবকিছুই ছিল ছাত্রলীগের হাতে। আমাদের কোনো ভূমিকাই কাজে দিত না। আমার পদত্যাগের পরে গত চার বছরে পরিস্থিতি বিশেষ পাল্টায়নি বলেই আমার ধারণা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো কীভাবে প্রশাসিত হয়, আমি তার একটা চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রও এর কাছাকাছি হবে। তবে আসন ও আবাসনের মূল্য ঢাকার মতো এতটা চড়া নয় বলে সেসব স্থানের চিত্র আরেকটু সহনীয় হওয়ার কথা।

পরিশেষে বলতে হয়, সরকারে অধিষ্ঠিত দলের ছাত্রসংগঠনের ছায়া প্রশাসনের বৈধতা দেওয়াই যাদের কাজ, তাদের কী নামে ডাকা হবে, কী পদে রাখা হবে, সেসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

ফাহমিদুল হক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।