ঠিক-বেঠিকের রাজনীতি

বিশ্বের সব দেশেই কোনো নির্বাচন হলে সাধারণত প্রথম বছরটি নবনির্বাচিত সরকারের মধুচন্দ্রিমার সময় বলে বিবেচিত হয়। সংবাদমাধ্যম শুরুতেই নতুন সরকারের ভুল-ত্রুটিকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। কথায় কথায় সমালোচনায় মুখর হয় না। আর জবাবদিহির জন্য পাল্টা চ্যালেঞ্জের তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এবারে এর ব্যতিক্রম ঘটছে যুক্তরাষ্ট্রে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই শত্রু বানিয়েছেন গণমাধ্যমকে। সাংবাদিকদেরও নিকৃষ্ট জীব হিসেবে অভিহিত করেছেন। কিন্তু শুধু সাংবাদিকদের মুণ্ডুপাতে সীমাবদ্ধ থাকলে তাঁর তেমন একটা রাজনৈতিক সমস্যা হতো না। কিন্তু তিনি দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠানকেই যাচ্ছেতাইভাবে হেয় করছেন। বিচারক, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, বিরোধী দল, ভিন্নধর্মের অনুসারী, অভিবাসী, উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী, হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী—এঁদের কেউই বাদ যাচ্ছেন না। তবে রাজনৈতিকভাবে তাঁকে সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলেছে যে বেফাঁস কথাটি সেটি হচ্ছে, তাঁর পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরুদ্ধে।

প্রেসিডেন্ট ওবামার স্বাস্থ্যসেবা নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানটি ছিল নির্বাচনী কর্মসূচি বা অঙ্গীকারের অংশ। সুতরাং ওবামাকেয়ার নিয়ে তাঁর সমালোচনা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটছে নির্বাচনের সময় তাঁর ঘরে ওবামা আড়ি পেতেছিলেন বলে অভিযোগ। এই অভিযোগের প্রমাণ চাইলেও দুই সপ্তাহ ধরে তিনি এর কোনো জবাব দেননি। যুক্তরাষ্ট্রের আইনে অভিযোগটি খুবই গুরুতর। এ ধরনের অপরাধের জন্য এর আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে সরে যেতে হয়েছে। সুতরাং ওবামাকে কলঙ্কিত করতে হলে প্রমাণ চাই। এই প্রমাণ যে শুধু ডেমোক্র্যাটরা চাইছেন, তা নয়। তাঁর রিপাবলিকান দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও চাইছেন। গোয়েন্দা কার্যক্রম বিষয়ে সিনেটের কমিটিও আজ সোমবার এ বিষয়ে শুনানির আয়োজন করেছে। এফবিআইপ্রধানকে সেখানে বলতে হবে যে াঁদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য আছে কি না। এফবিআইয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন গণমাধ্যমকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই।

এদিকে, একটি ভিত্তিহীন বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি ইতিমধ্যে দুটো দেশের (ব্রিটেন ও জার্মানি) সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে অস্বস্তির জন্ম দিয়েছেন। তাঁর মুখপাত্র আড়ি পাতার কাজটি ব্রিটেনের গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান জিসিএইচকিউর ঘাড়ে চাপানোতে স্পষ্টতই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে ব্রিটিশ সরকার। আর, অাঙ্গেলা ম্যার্কেল বিব্রত হয়েছেন ওবামা প্রশাসনের আড়ি পাতার শিকার হিসেবে তাঁকেও একই কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টায়। সুতরাং পূর্বসূরি ওবামার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর রাজনৈতিক চাপ যে আরও বাড়বে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা ছাড়া, নির্বাচনে রাশিয়ার কারসাজির চেষ্টা ছিল বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তাতে ট্রাম্পের উপদেষ্টা বা সহযোগীদের সঙ্গে মস্কোর যোগসূত্রের বিতর্ক তো রয়েছেই।

২.

আমাদের দেশে নির্বাচনে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ নিয়ে নানা সময়ে নানা ধরনের অভিযোগ শুনে আমরা অভ্যস্ত। জাতীয়তাবাদী চেতনায় বলীয়ান হিসেবে আমাদের সার্বভৌমত্বের ধারণাটাও বেশ টনটনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার পরামর্শকে তাই অনেকটা হেলাফেলার দৃষ্টিতে নাকচ করে দিয়ে বর্তমান সরকার তার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি দিয়ে শাসনকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে—সেসব বিষয়ে বিদেশিদের নাক না গলানোর জন্য হুঁশিয়ারিও আমরা দিয়ে রেখেছি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁর দলের পরাজয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের ভূমিকার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হারাতে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) ও যুক্তরাষ্ট্র এক জোট হয়েছিল। তিনি বলেছেন যে তিনি গ্যাস দেননি। (অবশ্য বিএনপিও যে নির্বাচিত হয়ে ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করেছে তাও নয়।)প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বিএনপি নাকচ করে দিয়েছে এবং দলটির এক নেতা বলেছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের মান-অভিমান চলছে। সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেছেন, এ ধরনের কোনো সংবেদনশীল বিষয়ে জনসমক্ষে বলার সময় যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত দিয়ে উপস্থাপন করলে লোকজনের সুবিধা হয়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই না যে প্রধানমন্ত্রী কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কথা বলেন। আর বিএনপির নেতার দাবি অনুযায়ী মান-অভিমানের বশে এমন কথা প্রধানমন্ত্রী বলবেন, এমনটি মেনে নেওয়া কঠিন।

এদিকে, বিবিসির সাবেক একজন সাংবাদিক ভারতের সুবীর ভৌমিক সাউথ এশিয়া মনিটরে এক নিবন্ধে ২০০১ সালের নির্বাচন বিষয়ে যে ভাষ্য লিখেছেন, তাতেও তিনি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশের কথা বলেছেন। (তিনি ২০০১ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র এবং ঢাকায় র-এর প্রতিনিধির ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা বলেছেন। তিনি আরও লিখেছেন, ২০১৪ সালে ঢাকায় কর্মরত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে ছিলেন না। এসব দাবির বস্তুনিষ্ঠতা মোটেও প্রশ্নাতীত নয়।) ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে একই রকম ভাষ্য প্রকাশিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ঘিরে যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেগুলো কি আর উপেক্ষা করা চলে? প্রশ্ন উঠছে, ২০০১ সালের নির্বাচনে তাহলে কি গণরায়ের প্রতিফলন ঘটেনি, কারসাজি হয়েছে? কারসাজিতে জড়িত ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত, বিশেষ করে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’? প্রধানমন্ত্রী তাহলে গত আট বছরে এই কারসাজির তদন্ত করলেন না কেন? কারসাজির সুবিধাভোগীদের (বিএনপি-জামায়াত জোট) কি তাহলে তিনি দায়মুক্তি দিলেন? বিএনপির পাল্টা অভিযোগ যে ২০০৮ সালেভারতই তাঁর দলকে নির্বাচনী সাফল্য এনে দিয়েছে, সেটা কি তাহলে বিশ্বাস করতে হবে? বিদেশিদের কারসাজি যদি একবার সফল হয়ে থাকে তাহলে অন্য সময়ে তা কাজে না লাগার তো কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই।

তবে হ্যাঁ, নিরপেক্ষ তদন্ত অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করলে বিষয়টির একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া সম্ভব হতে পারে। এ ধরনের তদন্ত আরও যে কারণে প্রয়োজন তা হলো, নির্বাচনী ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এভাবে নষ্ট করা হলে ভোটাররা নিজেদের ক্ষমতাহীন ভাবতে শুরু করবেন এবং গণতন্ত্র আরও দুর্বল হবে। তা ছাড়া, ভোটের ফল পাল্টে দিতে পারে অথবা নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে, এমন শক্তিগুলোকে আগামী নির্বাচনেও নিশ্চয়ই নিষ্ক্রিয় করা প্রয়োজন। তবে এসব নাগরিক ভাবনায় রাজনীতিকদের কিছু আসে-যায় কি না, সেটা একেবারেই ভিন্ন প্রশ্ন।

৩.

কয়েক দিন আগে আমার চোখে পড়েছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার একটি নতুন বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি একটি নতুন কোর্স চালুর কথা ঘোষণা করেছে। কোর্সটির নাম হচ্ছে ‘কলিং বুলশিট’। আসল আর নকলের ফারাক বোঝার কৌশল শেখাতে এ মাসেই এই কোর্সটি শুরু হচ্ছে। প্রফেসর কার্ল বার্জস্ট্রম এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর জেভিন ওয়েস্ট গত জানুয়ারিতে ১০ সপ্তাহের এই কোর্সটির সিলেবাস প্রকাশ করলে তা ইন্টারনেটে রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায়। প্রফেসর বার্জস্ট্রম রিকোড নামের একটি অনলাইন পোর্টালকে এই শিক্ষাক্রম চালুর কারণ সম্পর্কে যা বলেছেন তা অনেকটা এ রকম: বিভিন্ন পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত ব্যবহারে নানা ধরনের অসংগতি ঘটছে। ছোট ও সীমিত আকারের জরিপের পরিসংখ্যান ব্যবহার করে বৃহদাকারের জরিপের তথ্য-উপাত্ত নাকচ করার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে, যা যথার্থ নয়। সব ক্ষেত্রেই এখন নীতি বা কৌশল উদ্ভাবনে তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। সেই সব বহুল উচ্চারিত তথ্য-উপাত্ত (Big data) প্রয়োগে সতর্কতা অনুসরণের জন্য ভালো-মন্দ বাছাইয়ে দক্ষতা বৃদ্ধিই হচ্ছে এই কোর্সের উদ্দেশ্য। এর পাশাপাশি ভুয়া খবরের (Fake news) সমস্যা মোকাবিলার কৌশল শেখার কথাও কোর্সের সিলেবাসে রয়েছে।

ভুয়া খবর প্রসঙ্গে সিলেবাসে তাঁরা (কোর্স পরিচালনাকারীরা) বলছেন: ১৫ বছর আগে নবজাত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো গণমাধ্যমের আরও গণতন্ত্রায়ণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছিল। সম্প্রচারের বিকেন্দ্রীকরণ এবং বিজ্ঞাপনের আয়ের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে প্রকাশনাকে মুক্ত করার মাধ্যমে সেই গণতন্ত্রায়ণের পথ উন্মোচিত হয়েছিল। কিন্তু তার বদলে আমরা পেয়েছি বিভিন্ন গোষ্ঠীর দেয়ালঘেরা প্রকোষ্ঠ, যেখানে নিজেদের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়। আর অতিসম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত সত্যের ওপর আঘাত। ভুয়া খবর যে শুধু ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ওপর প্রভাব ফেলেছে তা-ই নয়, একটি ভুয়া খবরের কারণে টুইটার মারফত পরমাণু হামলার হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। (গত ২৪ ডিসেম্বর ইসরায়েল পাকিস্তানে পরমাণু অস্ত্র হামলার হুমকি দিয়েছে বলে একটি অনলাইন পোর্টালের খবরের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ টুইট করেন এই বলে যে, ইসরায়েল ভুলে গেছে পাকিস্তান একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস)। এরপর যে পাঠ্যতালিকা দেওয়া হয়েছে, আগ্রহীরা তা খুঁজে নিতে পারেন কলিংবুলশিট. ওআরজি/সিলেবাস ওয়েব ঠিকানায়।

বাংলাদেশে অবশ্য একাডেমিক নিষ্ঠা নিয়ে এ ধরনের কোনো কোর্স কেউ চালু করবেন তেমন সম্ভাবনা আপাতত নেই। তবে সে রকম কিছু চালু হলে বোধ হয় মন্দ হতো না!

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।