মূসক বাড়ানোর দরকার নেই

সরকার আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন মূসক আইন চালু করতে চায়। নতুন আইনে ৪ হাজার ৮০০ পণ্যে ১৫ শতাংশ মূসক আরোপিত হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে একমত হতে পারেননি। তাঁরা চান, ৭ থেকে ১০ শতাংশ মূসক আরোপ করা হোক। এ ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা প্যাকেজ মূসক চান। যদিও এনবিআর বলছে, আইনে সেই সুযোগ নেই। আগামী অর্থবছরে সরকার যে প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে চায়, তার সিংহভাগ জোগান দেবে এনবিআর। তার ভিত্তিতেই সরকার এত বড় বাজেট দেওয়ার সাহস করছে।

একদিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন স্কেল দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ শুরু হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সরকার অবশ্যই কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু এভাবে গয়রহভাবে সবকিছুর ওপর ১৫ শতাংশ মূসক চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ, এতে সবকিছুর দাম আরেক দফা বাড়বে। নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের যাপিত জীবন আরও কষ্টকর হয়ে পড়বে। আমাদের দেশের করকাঠামোয় এমনিতেই প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি। নতুন মূসক আইনের কারণে সেটা আরও বাড়বে, যেটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় মোটেও কাম্য নয়।

অন্যদিকে, সিলিন্ডার ও পাইপের গ্যাসের দাম সমন্বয়ের কথা বলে সরকার দফায় দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। মূসকের পরিমাণ বাড়লে গ্যাসের দাম আরও বাড়বে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন বছরে তেলের দাম অনেক কমলেও সরকার তেলের দাম যৎসামান্য কমিয়েছে। ফলে বিপিসি এখন প্রচুর মুনাফা করছে। সরকার বছরের পর বছর ধরে লোকসানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তহবিল দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে লোপাট হওয়া টাকা উদ্ধারে তৎপর না হয়ে সরকার বাজেট থেকে এসব ব্যাংককে তহবিল জোগাচ্ছে। লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাঁচিয়ে রাখতেও সরকার টাকা দিচ্ছে। গত কয়েক বছরে সরকার বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স ফি অনেক বাড়িয়েছে, যার বোঝাটা চাপছে মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর। এসব থেকে বোঝা যায়, সরকার নানাভাবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে চাইছে। কিন্তু সেই বোঝাটা শুধু আমজনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে যে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ মাত্র ৫৪ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ শতকরা হিসাবে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যেটা কিছুদিন আগে ছিল ৩০ শতাংশের মতো। অথচ এনবিআরই বলছে, অনুক্রমিক করব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ অন্তত ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। দেশে বর্তমানে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে এই হার ২০ থেকে ৩২ শতাংশ। এতে বোঝা যায়, কর দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে এখনো জোরালো নয়। এতে বাজেটঘাটতি বেড়ে যায়। গত বছরের বাজেট পেশের সময় অর্থমন্ত্রী ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর পাশাপাশি ২০২০-২১ সালের মধ্যে প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ ৫০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঘোষণা করেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর পদ্ধতি তো আমরা দেখছি না, উপরন্তু পরোক্ষ কর বাড়ানোর নানা তোড়জোড় চলছে।

প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়ার অর্থ হচ্ছে, মানুষ আয়ের ওপর বেশি বেশি কর দিচ্ছে। অর্থাৎ যাঁর আয় যত বেশি, তিনি তত বেশি হারে কর দিচ্ছেন। পরোক্ষ কর সবাইকে একই হারে দিতে হয়। এখানে ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। ধনীদের ভোগব্যয় অনেক বেশি হলেও গরিব, নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে বলা যায়, পরোক্ষ করের সিংহভাগ এরাই জোগান দেয়। কর আদায়ের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, মধ্যবিত্ত ও কিছুটা সচ্ছল ব্যক্তিরা কর দিতে বেশি আগ্রহী। আয়কর মেলার সময় এটি দৃশ্যমান হয়। আর যে দেশের শীর্ষ করদাতা একজন জর্দা ব্যবসায়ী, সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যক্তিরা যে কর ফাঁকি দেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। শীর্ষ করদাতার ১০ জনের তালিকায় দেশের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিরা নেই। সত্যিই সেলুকাস! দেশের আইনও এই ধনীদের পক্ষে। রাজস্ব আইনে এত ফাঁকফোকর আছে যে এঁরা সহজেই কর ফাঁকি দিতে পারেন। আবার দেশে কোম্পানি করের হার অনেক বেশি হলেও মোট রাজস্বে তার অনুপাত খুব বেশি নয়।

এনবিআরের কর্মকর্তাদের অসততার কারণেও রাজস্ব আদায় ব্যাহত হচ্ছে। এখানে আইন মেনে কাজ করতে গেলে উল্টো বিপদে পড়তে হয়৷ একবার লেখকের এক বাল্যবন্ধু আয়ের ওপর যথাযথ হারে কর দিতে গিয়ে বিপত্তির মুখে পড়েন৷ রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীরা তাঁকে বলেন, ‘এত টাকা কেন কর দেবেন৷ আমাদের কিছু দেন, আমরা আপনার করের পরিমাণ অর্ধেক করে দেব৷’ কিন্তু প্রকৃত কর দিতে নাছোড়বান্দা হওয়ায় নানা ঘাট ঘুরে তাঁকে জুতার তলা ক্ষয় করতে হয়।

অন্যদিকে, এমন অভিযোগও আছে, শহরের বড় রেস্তোরাঁ ও কাপড়ের দোকান ক্রেতাদের কাছ থেকে মূসক আদায় করলেও সরকারের কোষাগারে তা জমা দিচ্ছে না। ঢাকার অনেক বাড়িওয়ালার টিআইএন নেই। একবার বাড়িভাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধের কথা উঠলেও তার খবর নেই। চিকিৎসক, কনসালট্যান্টসহ বিভিন্ন উচ্চ আয়ের মানুষও ঠিকঠাক কর দেন না বলে অভিযোগ আছে।

অন্যদিকে, প্যাকেজ মূসক উঠিয়ে দেওয়া হলে মূসক আদায় আরও কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের মতো জায়গায় ব্যবসায়ীরা সাধারণত পূর্ণাঙ্গ হিসাব রাখেন না। প্যাকেজ মূসক থাকায় তাঁরা বছর শেষে একটা থোক টাকা দিয়ে দিতেন। তাঁদের আশঙ্কা, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত হলে বেচাকেনা কমে যাবে। আর হিসাবের ঝামেলা তো আছেই। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, এতে এনবিআরের কর্মকর্তাদের পকেট ভারী হবে। তবে এই ব্যবসায়ীদেরও প্রকৃত হিসাব রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। কারণ, আজ হোক বা কাল, উদ্যোগ আরও বিকশিত করতে তাঁদের এই সক্ষমতা অর্জন করতেই হবে।

সরকারের বাজেটঘাটতি কমানোর জন্য অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয় বাড়াতে হবে। সে জন্য মূসক বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল কি না, তা আবারও ভেবে দেখা উচিত। এতে যদি অর্থনীতির গতি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটা বুমেরাং হবে। অপচয় রোধ করে অর্থনীতির গতি বাড়ানো এবং যথাযথভাবে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা গেলে হয়তো মূসক বাড়ানোর দরকার হতো না। বিষয়টি আরেকবার ভেবে দেখা যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারের বোঝা উচিত, আমাদের দেশের মানুষের ১৫ শতাংশ মূসক দেওয়ার সামর্থ্য এখনো হয়নি।