নারায়ণগঞ্জে নিষিদ্ধ রাব্বি ও রবীন্দ্রনাথ!

ত্বকী হত্যা
ত্বকী হত্যা

নারায়ণগঞ্জে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদ আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে। তবে কাজটি কোনো মৌলবাদী সংগঠন করেনি। করেছে স্বাধীনতার চেতনা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘অতন্দ্রপ্রহরী’ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখা কেবল অনুষ্ঠান পণ্ড করেই ক্ষান্ত হয়নি, উন্মেষের সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে আহত করে নিজেদের বিক্রম জাহির করেছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গতকাল বুধবার বিকেলে চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে চেয়ার বসানো ও শব্দযন্ত্র লাগানোর কাজ চলছিল। বিকেল সোয়া চারটার দিকে মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান ওরফে রিয়াদের নেতৃত্বে সংগঠনের শতাধিক নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল বের করেন। এ সময় তাঁরা চাষাঢ়া বিজয় স্তম্ভের সামনে মাইকে নিহত ত্বকীর বাবা ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনারে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান। এ সময় তাঁরা প্লাস্টিকের চেয়ার ও শব্দযন্ত্র ভাঙচুর করেন এবং এগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেন।

এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও রিকশায় মাইক নিয়ে শহীদ মিনার দখল করে রাখেন। এ কারণে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদ রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান করতে পারেনি।

আয়োজক সংগঠনের সভাপতি প্রদীপ ঘোষ জানান, রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে খুলনার কৃতী ব্যক্তিত্ব শিক্ষাবিদ অসিত বরণ ঘোষকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের হামলার কারণে সেটি পণ্ড হয়েছে। অর্থাৎ নারায়ণগঞ্জে ছাত্রলীগ রবীন্দ্রনাথের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। ছাত্রলীগের যোগ্য কাজই বটে। প্রদীপ ঘোষ বলেছেন, রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের জন্য তাঁরা সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়েছেন এবং জেলা পুলিশ সুপারকেও লিখিতভাবে জানিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জানা নেই যে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেওয়া কিংবা পুলিশ সুপারকে লিখিত জানানোই যথেষ্ট নয়। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোথায় অনুষ্ঠান হবে, কারা অনুষ্ঠান করবে, সেটি এখন আর পুলিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় না। সিদ্ধান্ত নেয় ছাত্রলীগ। এমনকি সেই অনুষ্ঠানে কে আসবেন আর কে আসবেন না, তাও ছাত্রলীগ ঠিক করে দেবে।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান অবশ্য উন্মেষ আয়োজিত অনুষ্ঠান পণ্ড করার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেছেন, ‘রফিউর রাব্বি শহীদ মিনারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এসে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। একটি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে গালাগালি ও বিভিন্নভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। আমরা বিক্ষোভ মিছিল করেছি। রফিউর রাব্বির কুশপুত্তলিকা দাহ করেছি। তাঁকে কোনোভাবেই শহীদ মিনারে উঠতে দেওয়া হবে না।’

বিষয়টি লক্ষ করুন। রফিউর রাব্বি ওই অনুষ্ঠানে কোনো কথা বলেননি। ‘বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য’ দেন বলে ছাত্রলীগ তাঁকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। রফিউর রাব্বি যদি বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে ছাত্রলীগের প্রথম কর্তব্য ছিল আইনের আশ্রয় নেওয়া। কিন্তু সেই সাহস তাদের নেই। রফিউর রাব্বির কথিত বিভ্রান্তিকর বক্তব্য নিয়ে তারা আইনের আশ্রয় নিলে আসল রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে। রফিউর রাব্বির কিশোর পুত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে কারা খুন করেছে, সে তথ্য এখন আর অজানা নয়। আটক আসামিরাই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারপরও অজ্ঞাত কারণে মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। ত্বকী নিহত হয় নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনারও অনেক আগে। সে ঘটনায় নিম্ন আদালতে বিচার হয়েছে এবং আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে। আর ত্বকী হত্যা মামলা এখনো বাক্সবন্দী। তাহলে কি ত্বকীর ঘাতকেরা সাত খুনের ঘাতকদের চেয়েও শক্তিশালী?

রফিউর রাব্বি বলেছেন, তিনি যাতে পুত্রহত্যার বিচার চাওয়া থেকে বিরত থাকেন, সেই উদ্দেশ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে স্বার্থান্বেষী মহল তৎপরতা চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী ছাত্রলীগ কেন সেই স্বার্থান্বেষী মহলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে? রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের সঙ্গে মৌলবাদী ছাত্রশিবির বা অনুরূপ কোনো সংগঠনের সঙ্গে বিরোধ থাকতে পারে। ছাত্রলীগের কেন বিরোধী থাকবে?

নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে গিয়ে বলেছেন, শহীদ মিনারে অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো পক্ষ তাদের জানায়নি। উন্মেষের নেতা-কর্মীরা আসার আগেই ছাত্রলীগের কর্মীরা শহীদ মিনারে অবস্থান নেন। তাহলে রফিউর রাব্বির কুশপুত্তলিকা কারা পোড়াল? কারাই-বা তাঁকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল? দুর্বৃত্তরা তাঁর সন্তানকে হত্যা করেছে। এখন ছাত্রলীগ তাঁকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে তাঁর মুখ বন্ধ করতে চাইছে। এর মাধ্যমে কি সংগঠনটি সেই হত্যার দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিল না? এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের জবাব জানার অপেক্ষায় রইলাম।