পুলিশ যদি ধর্ষণ মামলা সহজে নিত!

পুরুষ ধর্ষণ করে ক্ষমতার জোরে। দৈহিক ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতার জোরে। ধর্ষণ সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা যেকোনো ধরনের ক্ষমতা হোক। আমি নেতা হলাম, প্রশাসনে কেউকেটা হলাম, চেয়ারম্যান কিংবা ইউপি সদস্য হলাম অথবা অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর হলাম; এসব ক্ষমতার জোরে আমি নির্যাতন করলাম এবং তা চাপা দিতে চাইলাম। ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতার যে সম্পর্ক, তার সঙ্গে এভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থাও জড়িত। থানায় গেলে পুলিশ মামলা নিতে টালবাহানা করে, নির্যাতনের শিকার নারীকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করে। পুলিশ যেভাবে ধর্ষিণের শিকার নারীর প্রতি ব্যবহার করে, সেটা ভয়ানক অন্যায়।

এটা আজকের কথা না, আমাদের মতো দেশে আবহমানকাল ধরে এটাই চলে আসছে। স্রেফ পুলিশ মামলা নিলেই কিন্তু ধর্ষণ অনেক কমে যেত। গুলশানের ঘটনা তো বটেই, সাম্প্রতিক বেশির ভাগ ঘটনাতেই পুলিশের মামলা নিতে গড়িমসি, টালবাহানা করেছে। থানায় আসার আগেই অনেকে ভয় পেয়ে থেমে গেছে। সরকারের কাছে আবেদন, যে-কেউ মামলা করতে এলে সেটা নথিবদ্ধ করার নিশ্চয়তা দিতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্য মামলা না নিলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, সেটার প্রতিকার করতে হবে। অর্থাৎ পুলিশকে এ বিষয়ে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে হবে। সব পুলিশ অবশ্যই এক প্রকৃতির নয়। তাহলেও বনানীর ঘটনায় দেখলাম, ধর্ষকের দৃপ্ত বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের বক্তব্য প্রায় মিলে যাচ্ছিল। পুলিশের উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্য, গরিব ও দুর্বলের ওপরই বেশি হয়।

দ্বিতীয়ত, স্কুল-কলেজ, কর্মস্থান, সব জায়গাতে মেয়েদের জানাতে হবে, তাঁরা যেন সাহস না হারিয়ে ফেলেন। ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত সব প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বিধিমালা প্রণয়ন এবং নিপীড়নবিরোধী অভিযোগ সেল গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা বাস্তবায়িত হলে মেয়েদের নিরাপত্তা আপেক্ষিকভাবে বাড়ত এবং সম্ভাব্য নির্যাতকেরাও হুঁশিয়ার হয়ে যেত। তাঁদের বলতে হবে, আমি যদি ধর্ষণের শিকার হই, এটা তো আমার অপরাধ না। এক নারীর জন্য আরেক নারী বোনকে প্রতিবাদ করতে হবে, ভাই-বন্ধু, নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

এত দিন পরে আমাদের বীরাঙ্গনারা মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি পেলেন। তাঁদের প্রতিই-বা আমাদের ব্যবহার কী ছিল? আমরা কি তাঁদের সম্মান দিয়েছি? অনেক পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাও তাঁদের সম্মান দেন না। সিরাজগঞ্জের এক বীরাঙ্গনাকে গালি দিয়ে তাঁর ভাতা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা শুনেছি।

তৃতীয়ত, সংবাদপত্রকে প্রতিটি ঘটনা নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। একবার সংবাদ করে ভুলে গেলে চলবে না। বনানীর ঘটনায় এখন যে উচ্চবাচ্য হচ্ছে, তা থামানো চলবে না। মানবাধিকার কমিশন রেইনট্রি হোটেল পরিদর্শন করে যে প্রতিবেদন করেছে, তার জন্য সাধুবাদ জানাই। পুলিশ ঠিকমতো কাজ করছে কি না, সে বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব রয়েছে।

পুলিশি হেফাজতে কিছু ঘটলে কীভাবে তার মোকাবিলা করা হবে? পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের শাস্তি আইনে আছে—যাবজ্জীবন অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা। এটা তো কিছু হলো না। এক লাখ টাকা দিয়ে পার পাওয়ার সুযোগ রাখায় এ আইনের ভয় সবাই পাবে না।

জনসাধারণের মনমানসিকতাও বদলাতে হবে। যে মেয়েরা প্রতিবাদ করেছেন, তাঁরা সাহসী, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এই মেয়ে আমারও মেয়ে হতে পারে। আমার লজ্জা হবে না যে আমার মেয়ের জীবনে এটা হয়েছে। বরং আমি ভাবব, তাঁর প্রতিবাদ আমারই প্রতিবাদ। তাঁর পাশে থাকা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। আজকের ছাত্ররা কেন এগিয়ে আসছে না? কারও যদি বিপদ হয়, সেখানে ছুটে যেতে হবে। এই ঐতিহ্য তো আমাদের ছিল। আমাদের শিক্ষিত মানুষও কিন্তু এ ব্যাপারে পথ দেখাতে পারছেন, তা নয়। দেশবাসীকেও ভাবতে হবে, নির্যাতনের শিকার যে নারীরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা হলেন দিশারি। নির্যাতনের কথা বলতে পারাই সাহস; সেই সাহসে সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং নাগরিক আন্দোলনের নেতা।