ফারুক চৌধুরীর কাছে আমাদের ঋণ

ফারুক চৌধুরী
ফারুক চৌধুরী

ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয় তাঁর চাকরিসূত্রে নয়। লেখার সূত্রে। তিনি সাপ্তাহিক যায়যায়দিন-এ ‘প্রিয় ফারজানা’ নামে একটি চমৎকার ধারাবাহিক রচনা লিখেছিলেন। সেটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কন্যাকে লেখা চিঠির মতো করে ফারুক চৌধুরী নিজের কূটনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির হালহকিকত জানাতেন পাঠককে। অনেকটা কন্যা ইন্দিরাকে লেখা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর চিঠির মতো। পরে ফারুক চৌধুরীর সেসব লেখা বই আকারেও প্রকাশিত হয়।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির সময় ফারুক চৌধুরী ছিলেন লন্ডনে ডেপুটি হাইকমিশনার। তার আগে বাংলাদেশের প্রথম চিফ অব প্রোটোকল হিসেবে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। ওই সময় যুক্তরাজ্যে হাইকমিশনার ছিলেন সৈয়দ আবদুস সুলতান। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন। আর ফারুক চৌধুরী ছিলেন পেশাদার কূটনীতিক। কিন্তু সেদিন দুজনের ভূমিকায় কত বৈপরীত্য ছিল। সৈয়দ আবদুস সুলতান প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে আওয়ামী লীগবিরোধীদের সঙ্গে দ্রুত হাত মেলান। একদল উচ্ছৃঙ্খল বাঙালি হাইকমিশন ভবনে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর ছবি ভাঙচুর করে। সেই ঘটনা ফারুক চৌধুরীকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অসহায়।

১৯৯৬ সালে সংবাদ-এ ফারুক চৌধুরী সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলে কথাশিল্পী শওকত ওসমান তাঁকে সৈয়দ আবদুস সুলতান ভেবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন। শওকত ভাইয়ের বয়স তখন ৭৯ বছর। ফলে স্মৃতি প্রতারণা করা অসম্ভব নয়। কিন্তু ফারুক চৌধুরী তাঁর লেখার কোনো জবাব না দিয়ে ‘প্রিয় ফারজানা’ বইটি তাঁকে পাঠিয়েছিলেন। এরপর শওকত ওসমান তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন।

মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত ‘স্মরণে বঙ্গবন্ধু’ বইয়ে ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে তাঁর স্মৃতিকে এই দেশ থেকে অবলুপ্ত করার, আমাদের জাতির ইতিহাসের রোমাঞ্চকর বিবর্তনে তাঁর অতুলনীয় অবদানকে অস্বীকার করার, তাঁর স্বপ্ন সাধনার মাহাত্ম্যকে খর্ব করার এবং তাঁর সংগ্রাম আর সাফল্যের অমোঘ সত্যের অপলাপ করার যে দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা চলেছে, ইতিহাসে তা নজিরবিহীন।’

সংবাদ-এর লেখার সূত্রে ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এরপর প্রথম আলোয় এলে সেই পরিচয় আরও গাঢ় হয়। এবং কূটনৈতিক জগতের উজ্জ্বলতম মানুষটি আরও অনেকের মতো আমারও প্রিয় ফারুক ভাই হয়ে গেলেন। মাঝেমধ্যে তাঁর বাসায় যেতাম। তাঁর শৈশব-কৈশোরের এবং কূটনৈতিক জীবনের গল্প শুনতাম। সেসব গল্পের কথা আছে তাঁর ‘জীবনের বালুকা বেলায়’ বইয়ে। ২০১৪ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটি প্রকাশিত হলে পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে অভিনন্দিত হয়। পরে বইটি আইএফআইসি ব্যাংক পুরস্কারও পায়।

অনেক দিন দেখা না হলে ফারুক ভাই নিজেই টেলিফোন করে খবর নিতেন। লেখা পড়ে মন্তব্য করতেন। কিন্তু সেই টেলিফোন আর আসবে না। আজ বুধবার ভোররাতে তিনি স্কয়ার হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালে শেষবার ভর্তি হওয়ার আগেও একবার তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। সেদিন তাঁকে অতটা অসুস্থ মনে হয়নি। কিছুক্ষণ গল্প হলো। এরপর আরও একদিন ৩২ নম্বরে (বঙ্গবন্ধু ভবনের দুটি বাড়ি পরই তাঁর বাসা) গিয়ে টেলিফোন করি। তিনি তখন কোনো কাজে বাইরে যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘আরেক দিন এসো।’ সেই আরেক দিন আর এল না। হাসপাতালে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। তাঁর অনুজ ইনাম আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি নিজেও একজন কৃতী মানুষ, কয়েক দিন আগে দেখা হয়েছিল একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে। ফারুক ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, তাঁর শরীরটা ভালো নয়। এরপর শুনলাম তিনি আইসিউতে আছেন। সেটাই যে তাঁর শেষ যাত্রার প্রস্তুতিপর্ব ছিল, বুঝতে পারিনি।

ফারুক চৌধুরীর কূটনৈতিক জীবন অর্ধশতকেরও বেশি। অবসর নেওয়ার পরও তিনি আন্তর্জাতিক বিষয় ছাড়াও নানা বিষয়ে ভাবতেন, লিখতেন, বলতেন। কেউ পরামর্শ চাইলে নির্দ্বিধায় দিতেন। আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেন না। রাজনীতি নিয়ে তাঁর দুঃখবোধ ছিল। তিনি মনে করতেন, রাজনীতিটা সুস্থ হলে দেশটি যেভাবে চলছে, তার চেয়ে আরেকটু ভালোভাবে চলতে পারত।

ফারুক চৌধুরীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো তিনি একাত্তরের আগে অবিভক্ত পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে কাজ করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সঙ্গেও কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা হয়েছেন। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূতের পদে থাকা ছাড়াও পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যখন সার্কের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, তিনি ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সেই সূত্রে তিনি ওই সম্মেলনের মহাসচিব হয়েছিলেন।

ক্ষমতার অন্দরমহলে থেকেও ফারুক চৌধুরী নিজের পেশাগত স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলতেন। যার যেটুকু অবদান স্বীকার করেছেন, যার যেটুকু সম্মান প্রাপ্য, সেটুকু দিয়েছেন। কারও সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, মনে পড়ে না। কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনকালে তিনি সবার ওপরে দেশের স্বার্থ দেখেছেন। এ কারণেই তিনি দলমত-নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কুড়িয়েছেন।

ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম আলোর সম্পর্ক ছিল আত্মার আত্মীয়ের মতো। তিনি যখনই কোনো বিষয়ে কিছু ভাবতেন, প্রথম আলোতে লিখতেন। কেবল কূটনীতি নয়, বিচিত্র বিষয়ের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। মিয়ানমারের গণতন্ত্রীপন্থী নেত্রী অং সান সু চির প্রেম বিষয়ে কিংবা মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে তিনি যে হৃদয়কাড়া লেখা লিখেছেন, তা বহুদিন পাঠকের মনে থাকবে।

চাকরিসূত্রে তিনি যেমন বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন, তেমনি এসেছেন খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্যে। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রনায়ক ইয়াসির আরাফাত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী (১৯৮৭), চীনের প্রেসিডেন্ট ওয়েন জিয়াবাও (২০০৩), ভুটানের রাজা জিগমে খেসার ওয়াংচুক, চীনের সর্বশেষ সম্রাট পু ই, বক্সার মোহাম্মদ আলী, আণবিক বিজ্ঞানী কাদির খান প্রমুখ।

প্রথম আলোতে তিনি সর্বশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর। সেই সাক্ষাৎকারে এমন কিছু বলেছেন, যা আজও প্রাসঙ্গিক। সময়টা ছিল দশম নির্বাচনের আগ মুহূর্ত। সামনে আরেকটি নির্বাচনের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। ওই সাক্ষাৎকারে ফারুক চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমি তো মনে করি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যে অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, এতটা নিচে আর কখনো নামেনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৮২ এবং ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত আমি কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য দেশের বাইরে ছিলাম। বিদেশে বসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ওঠানামা লক্ষ করেছি। অনেকটা শ্রাবণের মেঘের মতো। কিন্তু এবার যা হলো, সম্ভবত আর কখনোই তা হয়নি।’

এবার বলতে তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কথা বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৮ বা ২০১৯ সালে কী হবে?

ওই সাক্ষাৎকারে ফারুক চৌধুরী আরও বলেছিলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছিল এক বিস্ময়। আমাদের স্বাধীনতার দুটি মাইলফলক ঘটনা আছে—২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। পৃথিবীর আর কোনো দেশের বিজয় দিবস নেই। অর্থাৎ, আমরা একটি দখলদার বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি। সেই দ্বিমেরু বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম বিশ্বসম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল। ভারত বা তৎকালীন সোভিয়েত শিবির তো আমাদের সাহায্য করেছেই, কিন্তু যে পশ্চিমা বিশ্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমর্থন করেনি, সেসব দেশের জনগণও নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে।

জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নেওয়া প্রস্তাব সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘এটি তাদের চরম নির্বুদ্ধিতা। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের বলার কিছু নেই। এর মাধ্যমে পাকিস্তান আবারও প্রমাণ করল, তারা একাত্তরের দৃষ্টিভঙ্গিতেই আচ্ছন্ন। কাদের মোল্লাকে তারা তাদের লোক বলে দাবি করেছে। এটাই হলো পাকিস্তানি মানসিকতা। আর ইমরান খানের রাজনীতি হলো তালেবানি রাজনীতি।’

গত সাতই মার্চ উপলক্ষে ফারুক ভাই প্রথম আলোর সম্পাদকীয় পাতায় একটি কবিতা লিখেছিলেন। সেটিই ছিল সম্ভবত তাঁর শেষ লেখা। ইনাম ভাই জানালেন, ফারুক ভাইয়ের ওই কবিতার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে খোঁজ নিয়েছিলেন কোনো একজন। কেন নিয়েছিলেন জানি না। তবে এটুকু জানি, এই তদবির-তালাশের যুগে ফারুক চৌধুরীর মতো গুণী মানুষেরা যথাযোগ্য সম্মান পান না। কত অখ্যাত লোকই তো নানা রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন। কিন্তু জীবিত থাকতে ফারুক চৌধুরী কোনো রাষ্ট্রীয় পদক পাননি।

এ লেখা ঋণ শোধের জন্য নয়, স্বীকারের জন্য। ফারুক ভাই, আপনি ভালো থাকুন।