এত সাহস কোথা থেকে আসে?

আমরা আমাদের সমাজকে এখনো তৈরি করতে পারিনি নারীর উপযুক্ত করে। বনানীর ধর্ষণের ঘটনার পর তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করে অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ‘কিছুই হবে না’—এমন আত্মবিশ্বাস তাদের মধ্যে দেখা যায়। পুরোই বিপরীত ঘটনা দেখা যায় ভিকটিমের ক্ষেত্রে। কোনো অপরাধের কারণে মেয়েটির কুণ্ঠিত হওয়ার কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে তাকে লুকিয়ে থাকতে হয়। কিশোরী, এমনকি শিশু বয়সেও অনেক মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তারা মুখ খোলে না, কারণ তার পরিবার, তার বন্ধুবান্ধব সবাইকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে চারপাশের মানুষ।

ধর্ষণের মতো ভয়ানক একটা শারীরিক ও মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর আবার যখন তাকে প্রতিদিন ‘সামাজিক ট্রমা’ নিতে হয়, সেই আতঙ্কে তারা কিছু বলে না। থানা-পুলিশের কাছে গেলেও ১০০টা বিব্রতকর কথা শুনতে হয়। ওই অভিজ্ঞতা ধর্ষণের ঘটনার থেকে কম কিছু নয়। বাড়িতে জানলেও বলা হয়, চেপে যাও। যে মেয়েটি চেপে যায়, তার অন্তরের অপমান, কান্না কেউ দেখতে পায় না। কেউ কেউ যখন অভিযোগ করেন, হোক সেটা এক মাস, দুই মাস বা এক বছর পরে, সেটাই থানাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। দেরি হলেও ভিকটিম যে বলছে, সেই সাহসকে সম্মান জানাতে হবে। আমরা যেহেতু তা করতে পারি না, তাই বনানীর ধর্ষণের ঘটনার অপরাধীর মতো অন্য অপরাধীরাও মনে করে, তাদের কিছু হবে না। কেউ জানলেও তাদের কিছু হবে না—এই সাহস তারা কোথা থেকে পায়। কে দেয় তাদের এমন সাহস?

সাধারণ বুদ্ধি থাকলে বুঝতে অসুবিধা থাকে না, পরিবার ধনী ও তার ওপর যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে তো ষোলোকলা পূর্ণ। কোনো কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমাদের আইন আছে, কিন্তু থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা থেকে পুরো আইনি প্রক্রিয়া যদি নারীবান্ধব হতো, তাহলে হয়তো মেয়েরা থানায় যাওয়ার আগে দুবার ভাবত না। রাস্তায় কারও গাড়িকে যখন আরেকটি যানবাহন এসে ধাক্কা দেয়, তখন কিন্তু দুই মিনিটও কেউ ভাবি না। রাস্তায় সার্জেন্টকে ডাকা বা থানায় গিয়ে হোক অভিযোগ করে আসি। পুলিশও বেশ তৎপর থাকে। গাড়ির থেকে নারীর জীবন নিশ্চয় কিছুটা মূল্যবান। নারীরাও ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিকার চাইতেই পারে।

যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের পরিবারের বা কাছের কোনো মানুষের বিপদ না ঘটে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভাবি না। মনে করি, আমার তো কিছু হয়নি। ওদের সমস্যা ওরা মেটাবে। আর যদি ধর্ষণের ঘটনার কথা জানি, সবার আগে প্রচলিত ভাবনা হলো, নিশ্চয় মেয়েটির কোনো দোষ ছিল। হয় তার পোশাকের সমস্যার কথা বলা হবে, না হয় মেয়েটি স্বাধীনচেতা—সেটাকে দোষ হিসেবে ধরা হবে। আর ছেলেবন্ধু থাকলে তো কথাই নেই। আমরা তখন নিজেরাই প্রাথমিক বিচারকার্য করে রায় দিয়ে ফেলি। চারিত্রিক ভালোমন্দের মানদণ্ডটাও সমাজ ঠিক করে দেয়। বলা হয়, ভদ্র পরিবারের ‘ভালো মেয়ে’দের কখনো তো এমন ঘটনা ঘটে না। এমন যুক্তির আড়ালে কত নির্যাতিত নারীকে ‘খারাপ’ বলে তাদের ফরিয়াদ চাপা দেওয়া চলতে থাকে!

‘দুই ছাত্রী বোন, তোমাদের অভিবাদন’—এই শিরোনামে প্রথম আলোর অনলাইনে একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলোর ফেসবুকে পাতায় যে মন্তব্যগুলো দেখেছি, তা সত্যিই হতাশাজনক। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, বেশির ভাগ পুরুষই এমন কী করে ভাবে।

তারা বনানীর ঘটনার সূত্রে বলেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে, কেন মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে পার্টি করতে যাবে। আরেকজন লিখেছে, ‘তোমাদের বোন বলতে পারছি না, কেন তোমরা অত রাতে পার্টি করতে গেছ।’

‘আপন জুয়েলার্সের ছেলে দেখে মাথা ঠিক থাকে না। এক মাস পর গেছে নালিশ করতে।’ এ ধরনের মন্তব্যগুলো পড়ার পর সমাজের একশ্রেণির মানুষের রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। আমরা এ কোন সমাজে আছি?

মানুষ হিসেবে যতখানি অধিকার নিয়ে একজন পুরুষের বাঁচার অধিকার আছে, একজন নারীরও তা আছে। সে কোন পোশাক পরল, কীভাবে চলল, সেটা কোনো আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে না। পুরুষেরা অন্যায় করে সমাজের চোখে পার পেয়ে যাচ্ছে, আর নারীরা অন্যায়ের শিকার হয়ে গুহাবাসী হয়ে থাকবে, তা মেনে নিলে সমাজ আর সমাজ থাকে না। হয়ে পড়ে মানসিক কারাগার।
তৌহিদা শিরোপা: সাংবাদিক