ধর্ষকের গর্তে এত সাপ ছিল!

.
.

একেই বলে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের করে ফেলার ঘটনা! ধর্ষকের অবৈধ আনন্দের কেঁচোর গর্ত থেকে বড় বড় সাপ বের হচ্ছে। প্রথমে বের হলো ধনীর দুলাল যুবকদের বদখায়েশের বিবরণ। তার লেজ ধরে এগোতেই পাওয়া গেল তাদের বাবাদের কীর্তিকারখানা। পাওয়া গেল নাঈম আশরাফ নামের এক ‘সফল’ যুবকের মডেল; যে ভেবেছিল ভোল পাল্টে, নাম পাল্টে একের পর এক জোচ্চুরি করে করে পৌঁছে যাবে সমাজের উচ্চকোটিতে। তারপর কোনো ক্ষমতাবানের মেয়েকে বিয়ে করে ঢাকা দেবে সব পাপের চিহ্ন। ‘ভিআইপি’ তকমা গায়ে দিয়ে চালিয়ে যাবে টাকা ও ক্ষমতা কামানোর কারবার। কিন্তু হলো না। দুই নারীর সাহসিক প্রতিবাদে শামিল হলো হাজারো মানুষ। টনক নড়াতে হলো পুলিশের।
উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকে নব্য জমিদার বীরকৃষ্ণ দায়ের খুব দুঃখ, আপন পুত্রধন তাঁকে খোঁচা দিয়ে বলেছে, সমাজে তাঁর এত প্রতিষ্ঠা অথচ রক্ষিতা মাত্র তিনটি! সেটা ছিল উনিশ শতকের কথা। এই যুগে আপন জুয়েলার্সের সোনার ছেলেটি হোটেল ভাড়া করে ধর্ষণ টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। তাঁর বাবাও এসব ব্যাপারে কম যান না বলে দাবি করেন! তাঁর ভান্ডারের সোনাদানার ঠিকঠিকানা নেই। ধর্ষণের তদন্তে জুয়েলারি ব্যবসার অন্ধকার দিকে আলো পড়ল।
কুকর্মের আস্তানা রেইনট্রি হোটেলের জমির মালিক বি এইচ হারুন একজন ‘পূতপবিত্র’ সাংসদ বলেই এলাকায় পরিচিত ছিলেন। কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভাঙার পর জানা গেল, পুরো পরিবারটাই প্রশ্নবিদ্ধ অর্থনৈতিক ও অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িত। প্রতারণা, দুর্নীতি, ভণ্ডামি—সব ব্যাপারেই দশে দশ পাওয়ার যোগ্য। সাংসদ এলাকায় গড়েছেন ইসলামী কমপ্লেক্স, আর রাজধানীতে চালাচ্ছেন ভোগ-লালসার দোকান। পাঁচ বছরে ধর্মীয় ইমেজ গড়া এই সাংসদ যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তা আইনত ও ধর্মত কতটা বৈধ? অথচ নামের আগে ব্যবহার করেন ‘আলহাজ আল্লামা’ উপাধি, উপরন্তু তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি!
ওদিকে ঈশ্বরদীতে সন্ত্রাস চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন ভূমিমন্ত্রীর ‘বীর’ পুত্র। শহরটি মন্ত্রীপুত্র বনাম মন্ত্রীজামাইয়ের দাপটের কাছে জিম্মি। দেশে যখন বিরোধীদের পায়ের নিচে জ্বলন্ত কড়াই, তখন সরকারদলীয় নেতাদের রেষারেষিই আঞ্চলিক রাজনীতির মূল ঘটনা। তাঁদের কারণে সরকারি দলের অবস্থাও জেরবার। আজকের খবর : আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ নেতারা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসব সাংসদের নামে নালিশ করতে যাচ্ছেন (ডেইলি স্টার, ২০ মে, ২০১৭)।
ইংরেজরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে সারা বাংলায় জমিদার শ্রেণি তৈরি করেছিল। তাদের জালের বাইরে কারও যাওয়ার ক্ষমতা তখন ছিল না। তাঁদের অনেকেরই উপাধি ছিল ‘রাজা’। অতএব তাঁদের পুত্ররা চলতেন রাজপুত্রের চালে। কলকাতা শহর ছিল তাঁদের ভোগ-বিলাস-মাতলামোর তীর্থ। শাহাজাদাদের মতো তাঁদেরও বাগানবাড়ি থাকত, থাকত রক্ষিতা। শিকারের জন্য বন থাকত, চাষাভুষাদের চাবকানোর জন্য লেঠেল থাকত। মান্ধাতার আমলে ঘোড়ায় চড়া রাজার যদি এত সব থাকতে পারে, তাহলে আধুনিক যুগে কোটি টাকার গাড়ি-চড়া রাজপুত্রদের তো আরও বেশি কিছু চাই। সাবেক কালের রাজারা দুই লাখ টাকায় হাজারটা হাতি কিনতে পারতেন। আর আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের গুণধর ছেলের দৈনিক হাতখরচই নাকি দুই লাখ টাকা! আগেকার যুগে কেউ লাখ টাকার মালিক হলেই বাঁশের ডগায় হারিকেন ঝুলিয়ে লাখের বাতি জ্বালিয়ে জানান দিতেন। এখনকার রাজাদের নাম পানামা পেপারসে আসে, বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় আসে, ধনীদের পত্রিকা ফোর্বস–এ তাঁদের ছবি ছাপা হয়। মাঝে মাঝে দেশি গণমাধ্যমজুড়ে থাকে তাঁদের কীর্তিকলাপ।
তাঁদের স্থায়ী ঠিকানা আর দেশ নয়। কলকাতার জমিদারেরা খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য গ্রামদেশে বাড়ি রাখতেন। অবৈধ পথে টাকা পাচারের হিড়িক বলছে, দেশটা বুঝি সম্পদ বানানোর জমিদারি এলাকামাত্র; যেসব টাকার মূল গন্তব্য বিদেশ—হয়তো সেটাই তাঁদের আসল ঠিকানা। অবস্থাদৃষ্টে এ–ও মনে হতে পারে, দেশটাকে ৩০০ রাজকীয় ‘আসনে’ ভাগ করে একেক জমিদারের জিম্মায় দেওয়া আছে। তাঁরা প্রতাপশালী আর তাঁদের পুত্রধনেরা একেবারে তেজস্ক্রিয়। তবে কিনা বেশির ভাগ এলাকায় সংসদীয় ‘রাজতন্ত্র’ কায়েমের আলামত খুবই প্রকট। ভালো জমিদার পরিবার আগেও ছিল, এখনো আছে। কিন্তু গুণ নয়, দোষই সংক্রামক।
রাজতন্ত্রের মূলে থাকে রাজকীয় পরিবার। নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবার, ঈশ্বরদীতে ভূমিমন্ত্রীর পরিবার, কক্সবাজারে সাংসদ বদির পরিবার, টাঙ্গাইলে সাংসদ আমানুরের পরিবার—এ রকম অনেক ক্ষমতাবান পরিবারের জাল এলাকায় এলাকায় পাতা। এই জালের আওতায় থেকে তাঁদের বিরুদ্ধাচরণ করা কঠিন। এসব নব্য জমিদারের কেউ কেউ বাইরে ধার্মিক লেবাসধারী হলেও কাজকর্মে ভোগান্ধ রোমান সম্রাট কালিগুলার মতো। ইতিহাস সাক্ষী, পতনের আগে সব দেশেই ভোগবাদের বাড়াবাড়ি চলে।
বনানীর ঘটনা এভাবে বাংলাদেশের নব্য ধনী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের উত্থানের অন্ধকার ইতিহাস হয়ে উঠেছে। লুটেরা পুঁজি গঠনের ইতিহাস, রাজনীতিতে আধিপত্য খাটিয়ে রাষ্ট্রটাকে কবজা করার ইতিহাস, আইন-নীতি-মানবতাকে পরিহাসের ইতিহাস। এটা ব্যতিক্রম নয়, এটাই যেন নিয়ম এখন।
একটি ঘটনায় ধর্ষণ, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পরিবারতন্ত্রের যে গোমর ফাঁস হলো, এটাই বাংলাদেশে লুটেরা পুঁজির উত্থানের কাহিনি। এদের জাল এখন দেশ ছাড়িয়ে বিদেশ পর্যন্ত ছড়ানো। এই জালের দড়ি বিতর্কিত উপায়ে নির্বাচিত সাংসদ এবং মন্ত্রী ও নেতাদের অনেকের হাতে। বাংলা সিনেমার একটা গান মনে পড়ে যায়, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে।’
এই জালের কথা প্রথম বলা হয়েছিল ‘দ্য নেট’ নামের এক গবেষণায়। ১৯৭৯ সালে সাহায্য সংস্থা ব্র্যাকের কর্মীরা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে জরুরি ত্রাণ দিতে গিয়ে দেখেন, সরকারি সাহায্য, খাসজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সহায়-সম্পত্তি দুর্নীতির মাধ্যমে বেহাত হচ্ছে। গ্রামের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে দারুণ এক জাল তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে আছেন একদল সুবিধাভোগী গ্রামবাসী ও মাস্তান। নিজেদের মধ্যে আপসে তাঁরা গরিবদের প্রাপ্য সম্পদ ও সুবিধাগুলো তছরুপ করেন। দরকারে অনুগতদের দিয়ে অপরাধও করিয়ে নেন। পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তারাও এই জালের সদস্য। ভূমি দখল ও জনগণের প্রাপ্য সরকারি সুবিধা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল এই জালের আসল কাজ। এক কথায় এটা ছিল টাকা বানানোর জাল।
সাড়ে তিন দশক পর ব্র্যাক থেকেই আরেকটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন তিন গবেষক : হাসান মনজুর, মুহাম্মদ জাকারিয়া ও জোনাথন রোজ। ‘দ্য রিয়েল পলিটিকস অব বাংলাদেশ’ নামে ২০১৫ সালে প্রকাশিত বইটিতে জানাচ্ছে, সাতটি বিভাগে প্রধান অপরাধ হলো ভূমি দখল, মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি অথবা চুরি। জড়িত ব্যক্তিদের সারির প্রথমে আছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-সাংসদ, দ্বিতীয়তে যুবনেতা এবং তৃতীয়তে পুলিশ অথবা সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি বরাদ্দের সুবিধাভোগীও এই তিন ধরনের লোক। সাতটি বিভাগেই অপরাধীদের ৫৬ থেকে ৮৯ শতাংশ রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাশালী পদ আলো করে আছেন।
এই গবেষণা দেখাচ্ছে, রাজনীতি এখন দ্রুত বড়লোক হওয়ার মাধ্যম। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সাংসদদের সম্পদ ও আয় বেড়েছে ৩২৪ শতাংশ। এটা যদিও প্রকৃত আয় নয়, তবু পাঁচ বছরে প্রদর্শিত আয় তিন গুণ বাড়া দিয়েই বোঝা যায়, লুকানো আয় কত বেশি হতে পারে! উল্লেখ্য, এই সময়ে তাঁদের প্রদর্শিত ভূসম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধির হার: প্রায় ২ হাজার ৮০০ গুণ!
জেলা পর্যায়ের সরকারি ক্ষমতা থাকে মূলত সাংসদদের হাতে। তাঁরাই সেখানকার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার চাবিকাঠি। হত্যা-ধর্ষণসহ ফৌজদারি অপরাধে জড়িত মাস্তানদের ৭৩ থেকে ৯০ শতাংশই তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পায়। বিরল ব্যক্তিদের বাদ দিলে প্রায় সব নেতাই ব্যবসায়ী। সংসদেও তাঁরাই দলে ভারী।
পাঠক, এবার হিসাব–নিকাশহীন সোনাদানার ব্যবসায়ী দিলদার আহমেদ ও তাঁর ছেলে এবং বি এইচ হারুন ও তাঁর ছেলে এবং নাঈম আশরাফ নামের বহুরূপী জোচ্চোরের সঙ্গে ক্ষমতাকাঠামোর আঁতাতের সম্পর্ক মিলিয়ে দেখুন। জালটা স্পষ্ট হচ্ছে কি? দৃশ্যত, টাকার জাল আর ক্ষমতার জাল নিজেদের আলাদা দেখাতে চায়। কিন্তু কোনো কোনো অপরাধের বিন্দুতে পুরো সিন্ধুটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বনানীর জোড়া ধর্ষণের ঘটনা তেমনই এক উন্মোচনকারী মুহূর্ত, যার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার এক্স-রে ছবি দেখা গেল।

ফারুক ওয়াসিফ : লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]