সড়কের শোভাবর্ধন

জলজ্যান্ত গাছ কেটে আমদানি করা বনসাই-ধাঁচের গাছ দিয়ে বিমানবন্দর সড়কের শোভাবর্ধনের নামে তুঘলকি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ সম্পর্কে কোনো আগাম ধ্যান-ধারণা কি জনসমক্ষে পেশ করা হয়েছিল? তা কি পর্যালোচনা করা হয়েছিল? এ সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে নেওয়া হয়? আরবান বোটানিস্ট আছেন কি? ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট ছিলেন কি?
পুরো বিমানবন্দর সড়কটাই এক উদ্ভট সৌন্দর্যবর্ধনের স্কিমে নেওয়া হয়েছে, লাগানো হচ্ছে বনসাই। গাছের বনসাই একটা জটিল পদ্ধতি। বহু যত্ন করে বনসাইগাছ তৈরি করা হয়। আরও যত্ন করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এখানে শুধু ব্যয়ের ব্যাপার বড় নয়, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। তার থেকে বড় কথা, বনসাইগাছ লাগানোর স্থান নির্ধারণের যথোপযুক্ততা। বিশেষ আয়োজন ও গড়ন বলেই বনসাইগাছ স্থান পায় বিশেষ বিশেষ জায়গায়, যেমন চীনা বা জাপানি বাড়ির অন্দরে, আঙিনায় বা আনুষ্ঠানিক উঠোনে।
পৃথিবীর কোনো শহরে মহাসড়কের দুই ধার অলংকৃত করা হয়েছে বনসাই দিয়ে, এ রকম আমরা দেখিনি। পুরো ব্যাপারটাই একটা অর্থনৈতিক তাণ্ডব। এক একটা গাছের মূল্য এক লাখ টাকার বেশি। শোনা যায় শুধু গাছ লাগানোর জন্য ব্যয় হবে তিন কোটি টাকা। কী করে এটা মেনে নিই। এক সারি কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া বা নাগেশ্বরগাছ লাগালে পুরো বিমানবন্দর সড়কের পরিবেশ হতো আরও যথাযথ ও সুন্দর। একটা ছোটখাটো গাছের দাম হতো হাজার দুই টাকা।
ভাবছি তিন কোটি টাকা দিয়ে কী কী করা যেত। মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যেসব পথচারী বিমানবন্দর সড়ক পার হন, তাঁদের জন্য হয়তো ছয়টা পদচারী-সেতু তৈরি করা যেত। বিমানবন্দরে ঢোকার চত্বরটি পথচারীবান্ধব করা যেত। যাত্রীদের নিকটজনের জন্য একটা আধুনিক অপেক্ষাগার তৈরি করা যেত। বাস থামানোর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যেত।
কৃষ্ণচূড়া, নাগেশ্বর বা সে রকম জাতের কোনো গাছ যদি লাগানো হতো, তা হতো সাংস্কৃতিক ও ইকোলজিক্যাল উভয় দিক দিয়ে যথাযথ—এ রকম কথাই বললেন ল্যান্ডস্কেপ আর্কিটেক্ট খন্দকার হাসিবুল কবির। এ রকম গাছ আমরা বুঝি। কারণ, সেগুলো আমাদের সমষ্টিগত চিন্তা-ভাবনায় স্থান নিয়ে আছে। তা ছাড়া সে গাছগুলোর স্বভাব আমরা জানি, আরও জানি তার পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের নিয়মকানুন। বনসাই কী, সেটাই আমরা ঠিক করে জানি না, তারপর বটগাছের বনসাই! ৫ বছর, ১০ বছর পর গাছগুলোর কী হবে? গাছগুলো ঠিক ফুটপাতের ওপর মহাসড়কের গা ঘেঁষে। এগুলোর শিকড় যদি বাড়তে শুরু করে তাহলে সড়কের কী হবে?
শহর ও রাস্তাঘাট সাজানোর ব্যাপারে বোঝা প্রয়োজন আমরা রাস্তার পাশে কেন গাছ লাগাই। পথের পাশে এমন গাছ লাগানো দরকার, যা পথে চলাচলকারীকে ছায়া ও প্রশান্তি দেবে, শহরকে শীতল রাখবে, শুধু চোখে চমক লাগাবে না। চলাচলকারী বলতে পথচারী বা গাড়ির আরোহী উভয়কে বোঝায়। তবে প্রাধান্য পাওয়া উচিত পথচারীর, যা সব সভ্য শহরেই বিদ্যমান। শুধু আমাদের দেশেই প্রাধান্য পায় যানবাহন চলাচল।
রাস্তা চওড়া করার নামে ফুটপাত ছোট করছি। ফুটপাত তৈরি করার নামে শুধু নর্দমার ঢাকনা বানাচ্ছি। ফুটপাতের ব্যাপারে ন্যূনতম ধারণা ছাড়াই ফুটপাত বানাচ্ছি। জায়গায় জায়গায় ফুটপাত রাস্তা থেকে এত উঁচু যে সিঁড়ি তৈরি করতে হয়। বুড়ো মানুষ কেন, যে কারও পক্ষে ওঠানামা করতে শারীরিক কসরত করতে হয়। বিমানবন্দর সড়কের পাশে ২০ ফুটের বেশি জায়গা থাকতেও ফুটপাত করা হয়েছে ৪-৫ ফুট চওড়া।
অদ্ভুত গাছ লাগানো ছাড়া আছে দেয়াল তৈরি। বিমানবন্দর সড়কে চলাচলের সময় দুই ধারে খোলামেলা পরিবেশ আর মাঝেমধ্যেই সবুজের সমারোহে এখনো চোখ জুড়ায়। কোনো নিষ্ঠুর পরিকল্পক কোন উদ্ভট যুক্তি দিয়ে পুরো রাস্তাটা দেয়ালের বেষ্টনী তৈরি করে ফেলেছেন। জাতীয় জাদুঘরের এক উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের পুরো ব্যাপারকে ক্রিমিনাল কারবার বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন, অন্য যেকোনো দেশে এটার জন্য কারও না কারও ঠিকই শাস্তি পেতে হতো।
দেয়াল তৈরি করার প্রীতি ঢাকা শহরে আরেক নেশা। ব্যক্তিগত জায়গা হোক, সরকারি এলাকা হোক, প্রথম কাজটাই হলো একটা দমবদ্ধ করা দেয়াল নির্মাণ। প্রাচীর তো হতে পারে লোহার রডের খোলামেলা, তা না করে আমরা ইট-কংক্রিটের অভেদ্য প্রাচীর তৈরি করি, যার সিভিক মূল্য শূন্য। আমরা একটা হিসাব করছিলাম, গুলশান এলাকার সব প্লটের দেয়াল যদি সারিবদ্ধ করা যেত, তা দৈর্ঘ্যে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে যেত। বিমানবন্দর সড়কে দেয়াল দেওয়ার পেছনে রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের এ রকমই চিন্তা ছিল কি না, কে জানে। আরও আছে অবান্তর, বেমানান বাগান নামের গাছগাছালি ও পাথর-শিকলের সমারোহ। আছে যত্রতত্র শিশুসুলভ স্থাপনা, যেগুলোর অর্থবহতা শুধু রোডস অ্যান্ড হাইওয়েজের লোকেরাই জানেন।
বনসাইয়ে আবার ফিরে আসি। তিন কোটির অধিক টাকা দিয়ে বনসাই নামের তুঘলকি কারবার মাথা থেকে যাচ্ছে না। চুপ করে বসে থাকা যায় না। যতবারই বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে যাই আর এই বনসাই নামের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে ফুটপাত আর গাছ কর্তন দেখি, তখন ভাবি, ইশ্! ঢাকাবাসীর যদি বনসাই করা যেত। তাহলে শহরে মানুষের ঘনত্ব কম দেখাত, মানুষগুলো পিপীলিকা হয়ে যেত, গাড়িগুলো আরও সাঁই সাঁই করে এদিক-সেদিক চলাফেরা করতে পারত। বিদেশি অতিথি যাঁরা আসবেন আর বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে শহর অভিমুখী হবেন, তাঁরা আমাদের কাজকর্মকে নির্বুদ্ধিতা না ভেবে বাহবা দেবেন।
এই ভ্রান্ত ও মোটামুটি অপরাধের শামিল আয়োজনের তথ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হওয়া দরকার। তিনি একজন পরিবেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। নিশ্চয়ই তিনি একটা বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত নেবেন আর শহরবাসীকে এ ধরনের উদ্ভট উপদ্রব থেকে পরিত্রাণ দেবেন।
কাজী খালিদ আশরাফ: স্থপতি, নগরবিদ ও লেখক এবং বেঙ্গল ইনস্টিটিউট ফর আর্কিটেকচার, ল্যান্ডস্কেপস অ্যান্ড সেটেলমেন্টসের মহাপরিচালক।