হোলি আর্টিজানের শোক ও শক্তি...

শোকের পরের কথা হলো শক্তি
শোকের পরের কথা হলো শক্তি

তীব্র শোকের পাঁচটা পর্যায় আছে—অস্বীকার, রাগ, দর-কষাকষি, বিষণ্নতা, মেনে নেওয়া।

১৯৬৯ সালে এলিজাবেথ কুবলার রস ডেথ অ্যান্ড ডায়িং নামের একটা বই লেখেন। তাতে তিনি মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের ওপর গবেষণা করে তীব্র শোকের এই পাঁচ পর্যায়ের কথা লেখেন।

২০১৬ সালের মধ্য আষাঢ়ের সেই সন্ধ্যাটা ছিল অন্য কোনো আষাঢ়ের সন্ধ্যার মতোই। রমজান মাস, সামনে ঈদ, ইফতারি, তারাবি, কেনাকাটা—এসবই চলছিল। কিন্তু রাত বাড়তে থাকলে প্রথমে পুরো দেশ, পরে পুরো পৃথিবীর নজর কেন্দ্রীভূত হয় গুলশানের ৭৯ নম্বর রাস্তায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে।

আর আমাদের প্রতিক্রিয়া কুবলার রসসূত্র মেনেই চলছিল।

আমরা প্রথমে অস্বীকার করছিলাম। এই ঘটনা ঘটবে বাংলাদেশে? চিরশান্তির দেশ, যেখানে হাত বাড়ালেই বন্ধু জোটে, পা বাড়ালেই ঘর, সেখানে কে কাকে কেন মারবে? এই দেশ তো এই রকম নয়। তাই হচ্ছিল রাগ। আমাদের দেশেই কেন? আমার শহরেই কেন? এরপর বারগেনিং, দর-কষাকষি। আহা, আমরা যদি আগে থেকে প্রস্তুত থাকতাম! আহা, আমাদের ছেলেটা যদি তখন ওখানে না থাকত! ইশ্‌, ওরা নাকি আগে আরেকটা রেস্টুরেন্টে রেকি করতে ঢুকেছিল, তখনই যদি টের পেয়ে ওদের বাধা দেওয়া যেত! এরপর আমরা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হই, হিমালয় পাহাড়ের সমস্ত বরফ আমাদের বোধের ওপরে এসে চেপে বসে। এত বিষণ্নতা এই দেশে খুব কমই এসেছে। আর কী তার প্রতিক্রিয়া! স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। রেস্তোরাঁগুলো খাঁ খাঁ করতে থাকে। শপিং মলে হামলা হবে, গুজব ছড়াতে থাকে একেক দিন।

অবশেষে আমরা মেনে নিই যে বাংলাদেশে জঙ্গি আছে। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা আছে। তবে আশার কথা হলো, তারা সংখ্যায় কম আর সমাজে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। হারিয়ে যাওয়া মানুষদের তালিকা প্রস্তুত করা হয় এবং প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হয়। স্কুলে-কলেজে জঙ্গিবাদবিরোধী সভা-সমাবেশ হতে থাকে।

এবং এরপর আমাদের সামনে আসে আশা।

আমরা মৃত্যুকে নয়, জীবনকেই উদ্‌যাপন করার সূত্র খুঁজে পাই এবং সেসব আঁকড়ে ধরি। আমরা বাঁচার অবলম্বন পাই, লাইফ ভেসেলের মতো, তাতে আমরা আশ্রয় পাই। আমরা লাভ করি উজ্জ্বল উদ্ধার।

কী ভয়াবহ ছিল সেই দিনটার প্রেক্ষাপটও। একের পর এক ব্লগার খুন হচ্ছেন। খুন হচ্ছেন ভিন্নমতাবলম্বী মানুষ, প্রকাশক, লেখক। খুন হচ্ছেন পুরোহিত, খাদেম, বিদেশি। তারপর সেই আর্টিজান বিভীষিকা। ইতালীয়রা মারা গেলেন, জাপানিরা মারা গেলেন।

আমার কবিবন্ধু তারিক সুজাত একটা কবিতা লিখেছেন গুলশান হত্যাকাণ্ডে নিহত ইতালীয় নাগরিক অন্তঃসত্ত্বা নারী সিমোনা মনটির অনাগত শিশু মাইকেলেঞ্জেলো স্মরণে। তারিক লিখেছেন:

আমার প্রথম নিশ্বাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল

একটুও বিষাক্ত করেনি

শেষ নিশ্বাসই এ পৃথিবীর কাছ থেকে পাওয়া

আমার প্রথম উপহার!

মা,

তুমিই আমার খেলাঘর, আমার স্কুল, আমার কফিন

আমার চোখ ফোটেনি তবু আমি দেখেছি

জল্লাদের ধারালো নখে ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার নাভি

আমার কান তৈরি হলো না

তবু আমি শুনলাম স্কুলের ছুটির ঘণ্টা,

ওই অচেনা শব্দ গির্জা, মন্দির আর মসজিদের মিনারে

প্রতিধ্বনি তুলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

আমার প্রথম শয্যাই আমার শেষ শয্যা

মাতৃগর্ভই আমার অদেখা পৃথিবীর একমাত্র গৃহকোণ।

কী অসাধারণ কবিতা লিখেছেন তারিক সুজাত। যে শিশু মাতৃগর্ভে, তার ধর্ম কী, দেশ কী? শেষ নিশ্বাসই পৃথিবীর কাছ থেকে পাওয়া তার একমাত্র উপহার। তার নাড়িটিও ছিঁড়ে ফেলা হলো।

মারা গেলেন ইশরাত, অবিন্তা, তারিশি আর ফারাজ।

ইশরাত ছিলেন একজন অপরূপ মানবী। ছবি ভালোবাসতেন। ছবি আঁকার গ্যালারি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান ক্রিয়েটিভস। বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি। বন্ধুদের বাসায় নেমন্তন্ন করে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতেন। মানুষকে ভালোবাসতেন। মানুষের জন্য কিছু করার চেষ্টা করতেন। আহা, নৃশংসভাবে ছুরি চালানো হয়েছে তাঁর ওপর।

অবিন্তা (১৯) পড়তেন আমেরিকায়। আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর স্বপ্ন ছিল শিশুদের জন্য কাজ করবেন। একটা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমেরিকা থেকে দেশে এসেছিলেন তিনি।

তারিশির (১৮) মা-বাবা ভারতীয়। তিনি স্কুল পড়েছেন ঢাকায়। তারপর গেছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলেতে পড়তে। সেখানে একটা সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আছে। সুবীর চৌধুরী আর মালিনি চৌধুরীর নামে। এই বাংলাদেশি দম্পতি বড় অঙ্কের টাকা অনুদান দিয়ে বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করার জন্য এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে তারিশি একটা তহবিল পান বাংলাদেশে আসার জন্য। বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করার জন্য গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি বাংলাদেশে আসেন।

ফারাজ ভালোবাসতেন খেলাধুলা। নিজে ভলিবল খেলতেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাগলপারা ভক্ত ছিলেন। ম্যানইউয়ের জার্সি, ম্যানউইয়ের ব্যাগ, কলম, নানা রকমের স্যুভেনিরে তাঁর ঘর ছিল ভরা। আমেরিকার আটলান্টার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। ফারাজ ছিলেন ক্লাসের প্রেসিডেন্ট, ভলিবল দলের অধিনায়ক।

১ জুলাই ২০১৬ হোলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন অবিন্তা, তারিশি ও ফারাজ। জঙ্গিরা আক্রমণ করে বসে তাঁদের। ফারাজকে তারা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ফারাজ তাঁর দুই বন্ধু তারিশি আর অবিন্তাকে ছেড়ে আসতে অস্বীকৃতি জানান। কুড়ি বছরের তরুণ জীবনের চরম সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিলেন। তিনি বন্ধুদের সঙ্গে থেকে যান। ঘাতকের ছোরা এফোঁড়-ওফোঁড় করে তাঁর ছোট্ট শরীরটা।

ইতালির ওই মায়ের অনাগত সন্তানের না ফোটা ক্রন্দনের কাছে আমাদের যে বড় অপরাধ রয়ে গেছে। যে জাপানিরা বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে, তাঁদের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে? ফারাজের আত্মত্যাগ, সাহস আর মূল্যবোধ মানবতার ওপরই আমাদের আস্থাকে পুনঃস্থাপিত করল। আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় লিখেছিল: অতিমানবিক। বন্ধুত্বের জন্য ফারাজের এই আত্মত্যাগ দেশ-বিদেশের সব মানুষের কাছে উজ্জ্বল প্রেরণার এক অবিনশ্বর উৎস হয়ে রইল।

একটা দুর্ঘটনা কত মানবিক গল্পের সৃষ্টি করে। কত অতিমানবিক চরিত্রকে সামনে তুলে আনে। গল্পগুলো তো আগে থেকেই ছিল, আমরা জানতাম না, আলোচনা করতাম না। যেমন কী অসাধারণ একটা চরিত্র সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল করিম। রবিউল ছুটে গিয়েছিলেন ১ জুলাই, হোলি আর্টিজানে। মানুষকে বাঁচানোর কর্তব্য পালন করতে। জঙ্গিদের ছোড়া বোমায় নিহত হন তিনি। তখন তাঁর স্ত্রীর গর্ভে সন্তান। রবিউলের মৃত্যুর এক মাস পর পৃথিবীতে আসে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান রায়না। রায়নার বয়স এখন ১১ মাস। তাঁদের বড় ছেলে সামির বয়স এবার ৭ বছর হচ্ছে। রবিউল মানিকগঞ্জে চালাতেন একটা সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রতিষ্ঠান, ব্লুমস। মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগেও গ্রামে গিয়ে গরিব শিশুদের ঈদের জামা দিয়ে এসেছিলেন তিনি।

হোলি আর্টিজানের এই হামলা কেবল ব্যক্তিমানুষের জীবনে ট্র্যাজেডি নিয়ে আসেনি, বাংলাদেশের ওপর অনেক বড় এক আঘাত হয়ে এসেছে। আমেরিকানরা তাদের পরিবার-পরিজন ফিরিয়ে নিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী থমকে গেছেন। মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, বিশ্বাসহীনতা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে চিরায়ত জীবনচর্যা অব্যাহত রাখা যাবে কি না, এই নিয়ে সংশয় দেখা গেছে।

কিন্তু সংকট সব সময় খাদে ফেলে না, সংকট মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, নতুন উপায় উদ্ভাবিত হয়। হোলি আর্টিজানের পর পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি আমরা। সরকার কঠোর হয়, প্রশাসন সক্রিয় হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিদ্রাহীন তৎপরতা শুরু করে। হোলি আর্টিজানের পরপরই শোলাকিয়ার ঈদ জামাতে হামলার চেষ্টা হয়। সে চেষ্টা পুলিশ প্রতিহত করে। এরপর একের পর এক জঙ্গি-নিবাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়। অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে, নিহত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে, জাতি হিসেবে এবং সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে এই দেশের নরম পলিমাটিতে জঙ্গিবাদের কোনো জায়গা নেই।

আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে জঙ্গিবাদকে সীমায়িত করা হবে মারাত্মক ভুল। অন্ধকারের বিরুদ্ধে তরবারি ঘুরিয়ে কোনো লাভ নেই। অন্ধকার তাড়ানোর উপায় হলো আলো জ্বালানো। সেই আলো জ্বালানোর কাজটা করতে হবে। ডি-র‍্যাডিক্যালাইজেশন নামে একটা কথা প্রচলিত আছে। তরুণেরা যাতে জঙ্গিবাদের মোহে পড়ে না যায়, তাদের যাতে অন্ধ করে ফেলা না যায়, সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সরকারিভাবে সে ব্যাপারে কোনো টেকসই কর্মসূচি দেখা যায় না। সরকারি দল আর জোট কিছু মিছিল করেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু পুরো দেশের ও সমাজের র‍্যাডিক্যালাইজেশন বন্ধে যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি দরকার, সে প্রয়োজন সরকার বোধ করে বলে মনে হয় না।

অন্যদিকে দরকার সব রকমের মত প্রকাশের স্বাধীনতা। বৈচিত্র্যকে ধারণ করার পরিবেশ। মানুষ অনেক রকম। একেক মানুষ একেক রঙের, একেক মতের, একেক বিশ্বাসের, একেক আচরণের। সবাই এক ¯স্রষ্টার সৃষ্টি। সবার অধিকার সমান। সবার জন্যই বৃষ্টি হয়, রোদ ওঠে। আমাদের দেশে এই সরল কথাটাও বুঝিয়ে বলতে হয়, বোঝালেও যে আমরা বুঝি, তা-ও নয়। গণতান্ত্রিক পরিসর খুব দরকার। আর দরকার বাংলা মাধ্যম, আলিয়া মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যম—সব ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিত  এবং শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের জীবন-জীবিকা গড়ার সুযোগ, পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, নানান বরন গাভি রে ভাই একই বরন দুধ, জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।

কুবলার রসসূত্র যে তীব্র শোকের কথা বলে, তা কোনো প্রাণসংহারী রোগে আক্রান্ত মৃত্যুপথচারী মানুষ কিংবা কোনো মৃতের ঘনিষ্ঠ জনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু একটা জাতির জন্য শোকের পরের কথা হলো শক্তি। জেগে ওঠা। প্রতিরোধ এবং এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ সব সময় দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জঙ্গিবাদের বিপদ থেকেও বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারছে ও পারবে।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক  সাংবাদিক