ফারাজ: যে মৃত্যু জীবনের অধিক

ফারাজ আইয়াজ হোসেন
ফারাজ আইয়াজ হোসেন

ঘাতকেরা ওকে মুক্তি দিয়েছিল। তাকে ওরা চলে যেতে দিয়েছিল হত্যামঞ্চ থেকে।

হোলি আর্টিজানের ঘরটার পরে কয়েক কদম ঘাসের চত্বর, তারপরই জীবন। চলেই আসতে পারত সে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে জীবনের দিকে। পৃথিবীর কেউ তাকে দোষ দিত না। কিন্তু সে জীবনের বদলে মৃত্যুর দিকেই থেকে গিয়েছিল। কিসের জন্য?
তরুণটির নাম ফারাজ। ফারাজ আইয়াজ হোসেন। বয়স মাত্র বিশ।
ঘাতকেরা তাকে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলেছিল। বলেছিল, নিজের জীবন নিয়ে পালাও। কিন্ত সে পালায়নি। সেও ঘাতকদের দিয়েছিল পাল্টা বিকল্প: বাঁচলে একসঙ্গে বাঁচব, নইলে মরব একসঙ্গে।
বিদেশি দুই বন্ধু ছিল তার সঙ্গে। আর বিদেশিদের হত্যা করতেই তো এসেছিল ঘাতকেরা। বন্ধুরাও আমেরিকায় পড়ে; একজন বাংলাদেশি, আরেকজন ভারতীয়। বিদেশি ও ভিন্নধর্মীয় হওয়ায় তাদের বাঁচার যোগ্য মনে করেনি ঘাতকেরা। কিন্তু হত্যার এই বিভাজিত তালিকা মানেনি ওই তরুণ। মহাপ্রাণ ছেলেটি বন্ধুদের ভাগ্য থেকে নিজেকে আলাদা করতে চায়নি। বলা যায়, ও প্রাণ দিয়েছে স্বেচ্ছায়, মানবতায়।
বাংলাদেশ তার দেশ। বিদেশি বন্ধুদের প্রতি বাংলাদেশি হিসেবে দায়িত্ব রয়েছে তার; হয়তো ভেবেছিল সে। হোক তারা ভিন্নধর্মী, বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে রেখে পালাতে হয়তো ঘৃণা হচ্ছিল তার। তাই প্রাণভিক্ষা নেয়নি।
সকালে একসঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল তিন বন্ধুকে: রক্তাক্ত, নিষ্প্রাণ, নিরপরাধ।
তাকে দেখেছিলাম প্রথম আলোর অফিসে। ওই বছরের সেই রমজানেই ইফতারের জমায়েতে এসেছিল। নিষ্পাপ কিশোর-প্রায় মুখ। বিনয়ী ও লাজুক। সবাইকে সালাম দিচ্ছে। বয়সীজন দেখলেই উঠে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। বিদেশে পড়তে গেলেও পরিবারের অন্য সন্তানদের মতো ওরও স্থায়ী ঠিকানা ছিল বাংলাদেশ। লক্ষ্য ছিল পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে কাজ করা।
ফারাজ সেই অন্য সব ধনিক সন্তানের মতো ছিল না। ও ছিল সবুজ প্রজন্মের সেই অংশের ঘরানায়, ছোট প্রাণে বড় ব্যথা বড় আবেগ বড় ভালোবাসা যাদের আকুল করে। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের ‘মাই লস্ট ইয়ুথ’ কবিতায় একটা লোকগানের কথা আছে, ‘আ বয়’জ উইল ইজ উইন্ডস উইল,/ অ্যান্ড দ্য থটস অব ইয়ুথ আর লং, লং থটস।’ তরুণের মন বাতাসের ইচ্ছার মতো স্বাধীন। আর তার চিন্তা দিগন্তবিস্তারী। ফারাজের মন ওই চরম মুহূর্তে মানবীয় সীমাবদ্ধতা ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল। এবং আশ্চর্য এক কাজ করেছিল সে, মৃত্যু দিয়ে সে জীবনের পক্ষ নিয়েছিল।
নিয়তি নিষ্ঠুর। ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল প্রায় ওরই বয়সী কিছু ঘাতক তরুণের। হোলি আর্টিজান বেকারিতে, শুক্রবার রাতে।
ঘৃণা সেখানে জয় চেয়েছিল জীবনের ওপর। কিন্তু ফারাজ ওদের হারিয়ে দিয়েছিল নৈতিকতার জোরে, ভালোবাসার জোরে। গুলশান বিভীষিকার মধ্যে মানবতার এই মুহূর্তটি, বন্ধুদের ছেড়ে একা প্রাণ বাঁচানোর সুযোগ বাতিল করার মুহূর্ত, অন্ধকারের মধ্যে মানবতার জ্বলে ওঠার এক মুহূর্ত।
অসম্ভব সাহস যার অসম্ভব বেদনার সন্তান সে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অলৌকিক আনন্দের/ ভার বিধাতা যাহারে দেয়, তাহার বক্ষে বেদনা অপার!’ কিন্তু ওর এই বীরত্ব, ওর এই মহাপ্রাণ সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে পারি কি?
শুধু ফারাজ কেন, ওখানে যারই বাঁচার সুযোগ ও সম্ভাবনা আসত, তার কাছেই আমাদের প্রত্যাশা থাকত, ‘বেঁচে আসো’। এমনকি বিনা বিচারে ঘাতকের প্রাণহরণও আমরা আশা করতে পারি না। কেননা, প্রাণ ফিরে আসে না। যে যায় সে একা যায় না। সে নিয়ে যায় স্বজনদের প্রাণের একেকটি অংশ। প্রতিটি মৃত্যুতে তাই মৃতের স্বজনের জীবনের অনেকটা ভাগ ফাঁকা হয়ে যায়। তাদের জীবন আর কখনোই স্বাভাবিক হওয়ার নয়। কিন্তু ফারাজ হয়তো ভেবেছিল, একজন বিশ্বাসী মুসলমান হিসেবে তার প্রাণের বিনিময়ে ঘাতকেরা বন্ধুদের ছেড়ে দেবে। হয়তো ভেবেছিল, ও যদি তাদের সঙ্গে থাকে, তাহলে হয়তো তাদের ওরা মারবে না!
কিন্তু খুনিরা তো আর মানুষ ছিল না। আর ফারাজও তো আমাদের মতো না। সে বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘সোফি’জ চয়েস’-এর সোফির মতোও ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘাতক নাৎসি অফিসার সোফি নামের এক বন্দী মায়ের সামনে দুটি বিকল্প দিয়ে চ্যালেঞ্জ করে। সোফির দুই সন্তানের একজন বাঁচবে, আরেকজনকে পুড়তে হবে গ্যাসচুল্লিতে। কোন সন্তান বাঁচবে, তা সেই মা সোফিকেই বেছে নিতে হবে। সোফির ভাবার বা পালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। নিজে আত্মহত্যা করলেও যে সন্তান দুটি বাঁচতে পারবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। এ অবস্থায় কী করবে সোফি?
ফায়াজের সামনেও ছিল এমন দুটি বিকল্প: হয় একসঙ্গে মরো, নয়তো একাই বাঁচো। বন্ধুদের ছেড়ে এসে একা বাঁচার পথে গেলে তাকে দোষারোপ করার কোনো নৈতিক বা দার্শনিক সুযোগ কারোরই থাকত না। ওই অবস্থায় কাউকেই ফারাজ বাঁচাতে পারত না। আর হত্যাকারীদের কৃতকর্মের কোনো দায় জিম্মিদের ওপর বর্তানোর সুযোগও ছিল শূন্য। তাই নিজের প্রাণ বাঁচানো তার জন্য যৌক্তিক, নৈতিক ও বাস্তবিকই হতো। কারণ, কেউ না বাঁচার চেয়ে একজন বাঁচা ভালো। কারণ, প্রতিটি প্রাণই অমূল্য। একজনও যদি বাঁচে, তাহলে একটি পরিবার অন্তত শোকের অসহ্য ভার থেকে রক্ষা পায়।
কিন্তু ফারাজ আমাদের মতো নয়। কিংবা ওই মুহূর্তে তার মনে জেগে উঠেছিল মানবতার অপ্রতিরোধ্য শক্তি। সেই শক্তির সামনে ঘাতকদের নৃশংস হুমকি হয়তো তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। এভাবেই স্বেচ্ছায় মৃত্যু বেছে নিয়ে ‘আত্মঘাতী’ হামলাকারীদের দম্ভকে হারিয়ে দিয়েছিল সে।
মা সোফি বাধ্য হয়ে সাত বছরের মেয়েটিকে জল্লাদের হাতে তুলে দিয়ে ১০ বছরের ছেলেটির প্রাণ বাঁচিয়েছিল। ফারাজ দুই বন্ধুকে বাঁচাতে না পেরে নিজে তাদের সঙ্গে থেকে যায়। সোফির বেছে নেওয়ার কোনো ক্ষমতা আসলে ছিল না। কে বাঁচবে, তা জানার উপায় সোফির ছিল না। তার শুধু বেছে নিতে হতো। সে শুধু জানত, এর ফলে কোনো এক সন্তান অন্তত বাঁচবে। কিন্তু ফারাজের সামনে সুযোগ ছিল সিদ্ধান্তের। নিজ দেশে, নিজের বাড়ির কাছে, আপন বন্ধুদের নিজের কাছ থেকে নিয়ে হত্যা করা হবে, এটা সে মানতে পারছিল না।
গোয়েন্দারা খুব ছোট্ট কিছু থেকে বিরাট রহস্য ভেদ করতে পারে। এক ফোঁটা পানি বাঁচাতে পারে জীবন। গুলশানে যখন মৃত্যুর রাজত্ব, তখন মহাপ্রাণ হয়ে আলো দিচ্ছে ফারাজের শেষ সিদ্ধান্তটি। এত মৃত্যু, এত হতাশার মধ্যে সেই আলোটাই বাঁচিয়ে দিল আমাদের। কারও জীবন বাঁচাতে না পারলেও আরও বড় কিছু বাঁচিয়েছিল ছেলেটি। তার নাম মানবতা, তার নাম ভালোবাসা, তার নাম সৎ সাহস। আর তাতেই আমরা জানলাম, বাংলাদেশ এমন তরুণের জন্ম দেয়, যাদের উত্থান আমরা দেখেছি জাতির উত্থানের কোনো কোনো ঐতিহাসিক মুহূর্তে। যে দেশটাকে এ ধরনের কোমলপ্রাণ কিন্তু শক্তিমান তরুণেরা ভালোবাসে, সেই দেশের আশা কোনোভাবেই শেষ হওয়ার নয়।
সকাল হলেও সেদিন অন্ধকার কাটেনি বাংলাদেশের ওপর থেকে। সেই অন্ধকারেও ফারাজ মানবতার শহীদ হিসেবে উজ্জ্বল। আমাদের কিশোর-তরুণদের কারও কারও মনে যখন জঙ্গিবাদী ঘৃণার আবাদ করছে কোনো অপশক্তি; তখন ভরসা ফারাজের মতো কোমলহৃদয় কিন্তু অসম্ভব সাহসী তরুণেরা। যে অদম্য বাংলাদেশ হতাশার জলরাশিতে শুশুকের মতো সহসা মুখ দেখায়, ফারাজের মধ্যে সেই বাংলাদেশের মুখই আমরা দেখতে পাচ্ছি।