শুধু পুলিশি অভিযানে সন্ত্রাসবাদ দূর হবে না

মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ
মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ

হোলি আর্টিজানে হামলার আগে জঙ্গিদের হাতে ব্লগাররা খুন হয়েছেন, ফলে এই হামলা হঠাৎ করে ঘটেনি। তবে এই হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গি হামলায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। মানে, তারা এমন একটি নিরাপদ এলাকায় হামলা করল, যে এলাকাটি ঢাকা শহরের একদম কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। আবার এই ধরনের হামলার সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। তাদের টার্গেট সিলেকশনও (লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ) আমাদের ঝাঁকুনি দিয়েছিল। এই হামলায় কিছু নতুন বিষয় দেখা গেছে। আমরা জানতে পারলাম, শুধু মাদ্রাসাশিক্ষিত তরুণ নয়, সমাজের উচ্চ–মধ্যবিত্ত ও বিদেশে পড়াশোনা করা তরুণেরাও জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ, আমরা বুঝতে পারি, তারা অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সরকার অস্বীকার করলেও এই হামলার সঙ্গে যে আইএসের যোগসাজশ ছিল, তা আমরা বুঝতে পেরেছি। এরপর ঘটনাটি যেভাবে মোকাবিলা করা হলো, তাতে কিছু দুর্বলতা ধরা পড়ল। আমাদের এত সময় ব্যয় করা ঠিক হয়নি। আরও আগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা যাদের প্রশিক্ষিত করেছিলাম, তাদের ভূমিকা দেখতে পাইনি। সেনাবাহিনীকে তো অনেক পরের পর্যায়ে ডাকা হয়। পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াটের এ কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা তাদের ভূমিকা দেখতে পাইনি। এ ছাড়া সেখান থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও আমরা দুর্বলতা দেখেছি। সমন্বয়ের মধ্যেও দুর্বলতা দেখেছি।

আমরা আশা করেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-এর হামলার পর যে ধরনের কমিশন গঠিত হয়েছিল, সে ধরনের কমিশন গঠন করা হবে। এ ধরনের কমিশন গঠন করা হলে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারতাম। বুঝতে পারতাম আমাদের কোথায় দুর্বলতা ছিল, কী করা উচিত। কারও যদি গাফিলতি থাকে, সেটাও চিহ্নিত করা যেত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই কমিশন গঠন করার পর কমিশন থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে তারা বেশ কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এনেছিল। বিশেষ করে, তারা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনেছিল। একটা বিষয় তো পরিষ্কার, ঢাকা শহরের ভেতর জঙ্গিরা এ ধরনের হামলা চালাল কিন্তু তার তথ্য আমাদের হাতে ছিল না। আমাদের করদাতাদের টাকায় সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ হচ্ছে, ফলে তার একটা জবাবদিহি থাকা দরকার। এ ছাড়া দেখা দরকার, আমরা এখান থেকে কী কী শিক্ষা নিতে পারতাম বা পারি, যা আমাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

হামলার পর সরকারের তৎপরতা বেড়েছে। কিন্তু আমাদের বিশ্লেষণে দেখতে পাচ্ছি, এসব তৎপরতা কৌশলগত পর্যায়ে ঘটছে। এতে সাময়িকভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম স্তিমিত করা যায়, কিন্তু স্থায়ী সমাধান পাওয়া যায় না। ফলে আমাদের জাতীয়ভাবে সন্ত্রাসবাদবিরোধী কৌশল (কাউন্টার টেররিজম স্ট্র্যাটেজি) প্রণয়ন করতে হবে। এর বিভিন্ন দিক রয়েছে, যার একটি হচ্ছে গোয়েন্দা তৎপরতা ও পুলিশি কার্যক্রম। খুব বড় একটা পরিবর্তন আসতে হবে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে। সবাইকে তো ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা যাবে না। একজনের জায়গায় আরেকজন চলেই আসে। আবার এই প্রক্রিয়া যদি আইনের শাসন না মেনে করা হয়, তাহলে এসব ঘটনাকে তারা আরও লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে লাগাতে পারে। তাই এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সময় আইনের শাসন অবশ্যই মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছু কিছু দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি।

জাতীয় পর্যায়ে আমাদের স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল নেই। তাই এখন পর্যন্ত আমরা উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদ প্রতিহতকরণ কৌশল (কাউন্টার র‍্যাডিক্যালাইজেশন স্ট্র্যাটেজি) দেখতে পাচ্ছি না। ইতিমধ্যে অনেকে ওই পথে চলে গেছে। তাদের আমরা কী করব। এখন তাদেরকে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। এই কাজ শিগগিরই আমাদের হাতে নিতে হবে। যারা জঙ্গি তৎপরতা চালাতে গিয়ে আটক হয়ে কারাগারে গিয়েছে, তাদের অবস্থা কী, তা বোঝার জন্য আমরা একটি সমীক্ষা করেছিলাম। দেখা যাচ্ছে, তারা জঙ্গি সংগঠনের কর্মী হয়ে কারাগারে গিয়ে নেতা হয়ে ফিরে আসছে। এমনকি তাদের মাধ্যমে সাধারণ কয়েদিরাও জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হতে পারে এবং আমরা দেখতে পেয়েছি যে তেমন প্রক্রিয়া কার্যকর আছে।

গত কয়েক মাসে অনেক জঙ্গি জামিন পেয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে তারা আবারও জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এটা আটকানোর পথ আমাদের নেই। তারা যাতে আবার সমাজে ও পরিবারে ফিরে যেতে পারে, তার পথ আমরা সুগম করে রাখিনি। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর সমাজ ও পুলিশ তার সঙ্গে যে আচরণ করে বা যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে আমরা তাদের দেখি, তাতে পরিবারও তাকে সহজভাবে গ্রহণ করে না। কিছু ক্ষেত্রে তখন পুরোনো সহযোগীদের কাছে ফিরে যাওয়াই তার বেঁচে থাকার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ, এখানে জঙ্গিবাদে অংশগ্রহণের একটা চক্র আমরা রেখে দিচ্ছি। আমরা বুঝে বা না বুঝে এই চক্র তৈরি করে রেখেছি। কারণ হলো, সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের প্রায়োগিক (টেকনিক্যাল) ব্যাপারগুলো আমরা অনুধাবন করতে পারিনি। আমাদের জঙ্গিবিরোধী অভিযানের প্রধান দিক হলো পুলিশি অভিযান, অর্থাৎ জঙ্গিদের মেরে ফেলা বা জেলে পোরা। এখানে বীরত্ব দেখানোর এক ঝোঁক আছে। কিন্তু এই পথ আমাদের বিপদ থেকে চূড়ান্ত মুক্তি দেবে না। মূল কথা হলো, আমাদের একটা রাজনৈতিক ঐক্যে আসতে হবে। সন্ত্রাসবাদ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি—এ ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক মতৈক্যে আসতে হবে। কিন্তু এখন দেশে পারস্পরিক দোষারোপের রাজনীতি হচ্ছে। এতে সন্ত্রাসীরাই লাভবান হচ্ছে।

তবে এটা মানতে হবে যে পুলিশি অভিযানে তাদের কার্যক্রম অনেকটাই স্তিমিত হয়েছে। এর আগেও আমরা দেখেছি, ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত তারা কিছুটা ঝিমিয়ে ছিল। এরপর তারা মারাত্মকরূপে ফিরে এসেছে। নেতাদের মেরে সংগঠন ধ্বংস করা যায় না। এক নেতা মারা গেলে আরেক নেতা চলে আসে। এগুলো আদর্শিক সংগঠন, একই আদর্শে বিশ্বাসী মানুষেরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে।

অন্যদিকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে উগ্রপন্থা বা জঙ্গিবাদী ভাবাদর্শ প্রসার (সাইবার র‍্যাডিক্যালাইজেশন) বন্ধের লক্ষ্যে সরকারের তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। শুধু কতকগুলো ওয়েবসাইট বন্ধ করে এটা করা সম্ভব নয়। এটা খুবই জটিল ও সংবেদনশীল ব্যাপার, কিন্তু সরকার এসব মাথায় নিয়ে কাজ করছে বলে মনে হয় না। সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, জঙ্গি ভাবাদর্শকে ভাবাদর্শগতভাবে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের পাল্টা ভাষ্য বা কাউন্টার ন্যারেটিভ নেই। জঙ্গিরা তো তাদের দলভুক্তকরণের জন্য একটা ভাষ্য হাজির করছে, তারা সেটা নানা মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটা বড় মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। এই পরিসরে তারা একতরফা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আমরা কিছু বিচ্ছিন্ন পাল্টা ভাষ্য পাচ্ছি। সরকার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে একটি পাল্টা ভাষ্য হাজির করিয়েছিল। কিন্তু যে মাধ্যমে সরকার এটা প্রচার করার চেষ্টা করেছিল, তা ছিল ভ্রান্তিমূলক। যে ব্যক্তিকে দিয়ে এটা করার চেষ্টা করা হয়েছে, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এটার ফল বরং হয়েছে উল্টো। সন্ত্রাসীরা অভিযোগ করেছে, সরকার ধর্মেও হাত দিয়েছে। ইদানীং র‍্যাব একটি পাল্টা ভাষ্য দিয়েছে। কিন্তু র‍্যাব কখনো এই পাল্টা ভাষ্যের সূত্র হতে পারে না। তারা তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তা ছাড়া রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা আছে। কাঠামোগত ধারণা না থাকায় দেখা যায়, তারা যার যার কাজ করতে ব্যস্ত। এতে তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়।

অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ সরকারের একার কাজ নয়। এখানে যেমন রাষ্ট্রের অংশগ্রহণ থাকতে হবে, তেমনি সমাজের অংশগ্রহণও থাকতে হবে। বিশেষ করে নাগরিক সমাজের বড় ধরনের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। সন্ত্রাসীরা তো সমাজেরই মানুষ। তাই সমাজের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন এটা বন্ধ করা যাবে না। ১০টি পুলিশ বাহিনী দিয়েও এটা করা যাবে না। সমাজের সবাইকেই এই কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

যা হোক, আইএস সিরিয়া ও ইরাকে মার খাওয়ার কারণে এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ফিলিপাইনে তারা কিছু অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। এ ধরনের চেষ্টা অন্য জায়গায়ও হবে। আমাদের দেশের যারা সেসব দেশে আছে, তারাও এখানে ফিরে আসবে। তারাও নানা কিছুতে জড়িয়ে পড়বে। এটা একটা বড় ভয়। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী হারাকা আল ইয়াকিনের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভালো। তাদের টাকা আসছে সৌদি আরব থেকে। ফলে এই দেশে রোহিঙ্গাদের আগমনের ফলে আমাদের বিপদ হতে পারে। দেশে আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনা আমরা দেখেছি। এই প্রবণতা আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে। আবার যেসব বিস্ফোরক উদ্ধার করা হচ্ছে, তাতে আশঙ্কা হয়, এসব দিয়ে গাড়িবোমা হামলার মতো কিছু ঘটতে পারে। আবার বাংলাদেশসহ নানা দেশে জীবাণু হামলার আশঙ্কা আছে। আইএস ফতোয়া দিয়েছে, বিস্ফোরক হামলা প্রচলিত হয়ে গেছে, তাই এটা ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে হবে। নতুন নতুন পন্থায় যাওয়ার কথা বলেছে তারা, যার মধ্যে গাড়ি হামলাও অন্যতম।

হুমকির নানা মাত্রাই আছে। এসব মোকাবিলা করতে হলে আমাদের সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সমাজে যাতে এর বিস্তার না হয়, তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান: সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।