সেলফির নেশা কি আমাদের বিবেকহীন বানাচ্ছে?

সেলফির নামে আত্মপ্রচারটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। ছবিটি প্রতীকী
সেলফির নামে আত্মপ্রচারটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে। ছবিটি প্রতীকী

আসাদুজ্জামান রনি ছিলেন এক বাপের এক ছেলে। বাবা সরকারি চাকরি করেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া সরকারি হাসপাতালের হিসাবরক্ষক। আদর-আহ্লাদে বড় হওয়া রনি বেড়াতে গিয়েছিলেন বরগুনার তালতলী। সেখানে আছে ইকোপার্ক। ঘুরতে ঘুরতে রনি পৌঁছান কুমির প্রজননকেন্দ্রের সামনে। হঠাৎ তাঁর মনে হয়, কুমিরের সঙ্গে একটি সেলফি তুলে নিলে কেমন হয়! ভালো ‘লাইক’ পাওয়া যাবে। বন্ধু মহলে নিজেকে আলাদা করার এই তো মওকা। 

সেলফি তোলার রোমাঞ্চ পেয়ে বসে রনিকে। ক্ষণিকের তরে ভালোমন্দের কথা ভুলে যান তিনি। নিরাপত্তাকর্মীদের নজর এড়িয়ে নিরাপত্তা পাঁচিল টপকে চলে যান কুমিরের একেবারে কাছে। কুমির যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, এ নিয়ে বিন্দুমাত্র শঙ্কা কাজ করেনি তাঁর ভেতর। ফলে যা হওয়ার তাই! রনি পকেট থেকে ফোনটি যেই বের করতে যাবেন, অমনি ক্ষুধার্ত কুমিরটি তাঁকে খপ করে কামড়ে ধরে টেনে নিয়ে যায় মাঝ পুকুরে। তাঁকে কামড়ে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। রনি তলিয়ে যান পানিতে। দুই ঘণ্টা পর বন বিভাগের লোকজন নিথর রনিকে তুলে আনেন।
এ গল্প আমরা কেউ জানি, কেউ জানি না। রনি এখন মা-বাবার শূন্য বুকে সারা জীবনের কষ্টের স্মৃতি। জনমভর দুজন মাথা কুটে মরলেও আর পুত্রের দেখা পাবেন না। হায়, সেলফি!
এবার ঘটনা আরেকটি। ঢাকার গেন্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়। সন্ধ্যাবেলা। মোটরসাইকেলে তিন যুবক। স্পিড ব্রেকার পার হওয়ার সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারান। মোটরসাইকেলটি গিয়ে ধাক্কা মারে রিকশাকে। পড়ে যান বয়স্ক দম্পতি, ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছিলেন তাঁরা। আর এক চাকা বেঁকে কাত রিকশাটি। পথচারীদের কেউ কেউ তাঁদের ধরে ওঠানোর চেষ্টা করেন। এঁদের মধ্যে একজন হঠাৎ ব্যাকগ্রাউন্ডে ভাঙা রিকশা, বয়স্ক দম্পতিকে রেখে টপাটপ কয়েকটা সেলফি তুলে নেয়। ছেলেটির এহেন আচরণে বিমূঢ় পথচারী মানুষ। কিন্তু কেউ কিছু বলেনি তাঁকে।
অন্তর্জাল সূত্রে পাওয়া একটি ছবি আছে আমার কাছে। এতে দেখতে পাচ্ছি, অপারেশন থিয়েটারে এক রোগী। দেখে মনে হচ্ছে রক্তমাখা শরীর। তাঁকে ঘিরে কয়েকজন তরুণ চিকিৎসক হাসিমুখে সেলফি তুলছেন। তবে এ ঘটনাটি (যদি সত্যি হয়ে থাকে) বাংলাদেশের, না ভারতের, না অন্য কোনো দেশের, তা অবশ্য বোঝা যায়নি।
এই মুহূর্তে আরেকটি আলোচিত সেলফির কথা মাথায় আসছে। ছাত্রলীগ নেতা বদরুলের কোপ খেয়ে ঢাকার হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার। তাঁকে দেখতে গেছেন ক্ষমতাসীন দলের নারী এমপি। খোঁজখবর নেওয়া যেমন হলো, সঙ্গে সামান্য একটা সেলফি হলে দোষ কী! তাই হলো।
কোথায় নেই সেলফি? আজকাল তীর্থস্থানে গিয়ে যেমন সেলফি তোলা হচ্ছে, তেমনি তোলা হচ্ছে প্রার্থনায় বসেও। এমনও শুনছি, মৃতদেহের সৎকারের সময়ও থেমে নেই সেলফি তোলা। মানবিকতার কী ভয়াবহ বিপর্যয়!
তবে, সেলফি তোলা কোনো দোষের না। মানুষ সবচেয়ে ভালোবাসে নিজেকে। দার্শনিকদের এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে নিজেকে প্রকাশ করতে চাওয়ার মধ্যে অন্যায় নেই। এটা জীবনেরই আনন্দ। একটি নির্মল পারিবারিক সেলফি অবশ্যই একটি ভালো বিনোদন। অথবা বন্ধুদের কোনো সেলফি, যাকে বলা হচ্ছে উইফি, তা তো সম্পর্ক গাঢ় করারই প্রচেষ্টা। জনপ্রিয়তার কারণেই ২০১৩ সালে অক্সফোর্ড অভিধানে এরই মধ্যে জায়গা পেয়েছে সেলফি শব্দটি। তাই সেলফি থাকবে। সেলফি নিয়ে চলবে নানা আয়োজনও। এমনকি পণ্য কিনলে সেলফি স্টিকও ফ্রি-তে মিলবে।
কিন্তু সমস্যা বাঁধছে তখন, যখন সেলফির নামে আত্মপ্রচারটা মাত্রাতিরিক্ত হচ্ছে আর ব্যক্তি হারিয়ে ফেলছে হিতাহিত জ্ঞান, যাকে বলা হচ্ছে নার্সিসিজম। তখন কোন অ্যাঙ্গেলে ছবি তুললে নাকটা আরও উন্নত দেখায়, চোখ আরও টানা টানা দেখায়, কীভাবে মুখশ্রীতে আনা যায় আরও লাবণ্য, সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে অবিরাম। একের পর এক ছবি উঠতে থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। চাই আরও লাইক, আরও কমেন্ট, আরও শেয়ার। আরও আলোচনা। তারপর? তারপর কেবল আমি আর আমিত্ব। এ থেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আর স্বার্থপরতা। এভাবেই তরুণদের নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাওয়া। মূল্যবান জীবনীশক্তির নিদারুণ অপচয়!
২০১৪ সালে সেলফি তুলতে গিয়ে সারা বিশ্বে ৩৩ হাজার মানুষ দুর্ঘটনায় পড়েছেন। লোকেশন যত ঝুঁকিপূর্ণ, সেলফির মজা যেন তত বেশি। ২০১৬ সালে সেলফি তুলতে গিয়ে বিশ্বব্যাপী যত লোক মারা গেছেন, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ভারতে। গত ১৩ এপ্রিল চলন্ত ট্রেনে সেলফি তুলতে গিয়ে কলকাতা শহরের কাছে লিলুয়া স্টেশনে চার বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে। কিছুটা স্বস্তির কথা হলো, আমাদের বাংলাদেশে বিষয়টি এখনো শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছায়নি হয়তো।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি কথা হচ্ছিল, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমের সঙ্গে, যিনি মুঠোফোনের নানা অপব্যবহার যেমন রাস্তা পার হওয়ার সময় মুঠোফোনে কথা বলা, রাস্তা পার হওয়ার সময় হেডফোনের ব্যবহার করার বিষয়ে সচেতনতামূলক কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। তারানা হালিম বললেন, সেলফির নেশা কারও কারও ক্ষেত্রে অসুস্থতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। রাস্তায় একটা ছেলেকে পেটাচ্ছে, তখন তাকে রক্ষা না করে অনেকেই সেখানে সেলফি তুলছেন, ছবি তুলছেন। তাঁর মতে, এটাকে অসুস্থতাই বলা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে তা বিকৃত আত্মপ্রচার হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আবার কোনো কোনো সময় দলের কর্মীরা নেতাদের সঙ্গে সেলফি তোলেন, পরে কোনো বিতর্কিত ঘটনায় কর্মীরা জড়িত হয়ে গেলে নেতারা সমালোচিত হন। তারানা হালিমের ভাষায়, কর্মীরা চাইলে তো আর নেতারা না করতে পারেন না। তাই এ ক্ষেত্রে সচেতনতা সব মহলে দরকার।
একটি আবেদন: এ দেশের চার কোটি তরুণের কাছে একটি আবেদন রাখব, আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। পশু কোরবানির মাধ্যমে হিংসা, অহংবোধকে কোরবানি দেবেন লাখো মানুষ। দয়া করে কেউ জবাই করা পশুর সঙ্গে সেলফি তুলবেন না। আর ফেসবুক বা কোনো ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তা শেয়ার করবেন না।
এ ধরনের আবেদন রাখা কি অন্যায্য হবে?

কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক
ই-মেইল: alimkzaman@gmail. com

আরও পড়ুন...