মায়েরা কি মেয়েদের কথা শুনছেন?

আট বছর ধরে এক মেয়েকে ধর্ষণ করে আসছিলেন তাঁর সৎবাবা। একপর্যায়ে মেয়েটির আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে তাঁর এক বন্ধুকেও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এমন অভিযোগ করে সৎবাবার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন বর্তমানে ২০ বছর বয়সী ওই মেয়ে। সম্প্রতি ঘটা এই ঘটনা আমাদের অনেকের মনেই ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। কীভাবে সম্ভব, এত পশু কেমন করে হয় মানুষ, এমন অনেক কথাই শুনতে পাচ্ছি।

মেয়েটির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সৎবাবার এই নির্যাতনের কথা মেয়েটির মা জানলেও কিছুই করতে পারেননি। দু-একবার চেষ্টা করলেও তাঁকে নানাভাবে হুমকি দিতেন ওই ব্যক্তি। এই বিষয়টিই বেশি কষ্ট দিচ্ছে আমাদের। একটি সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান তার মা, তার বাবা। ছোটবেলা থেকেই মা তাঁর মেয়েদের বলেন, বাবা ও ভাই ছাড়া কাউকে বিশ্বাস করবে না। অথচ অভাগা মেয়ে শিশুগুলো কোনো কোনো সময় সেই মায়ের কাছেও আশ্রয় পায় না।

আমার এক বান্ধবী তার নিজের জীবনের ভয়াবহ একটি গল্প আমাকে বলেছিল, যা তাকে সারা জীবন কষ্ট দিয়ে আসছে। ছোটবেলায় এক মামা তাঁকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করত। যখনই সে নানাবাড়িতে বেড়াতে গেছে, তখনই ওই মামার নির্যাতনের শিকার হয়েছে সে। প্রথমে বিষয়টি বুঝতেই পারত না সাত-আট বছরের ছোট্ট মেয়েটি। অথচ তীব্র একটা খারাপ লাগা থেকে মাকে বিষয়টি জানায় সে, মা খুবই বিরক্ত হয়ে তিরস্কার করেছিল। বলেছিল, ‘মামা তো তোমাকে আদর করে, এসব খারাপ কথা বলবে না। তুমি খারাপ হয়ে যাচ্ছ।’

এমনটা শুধু যে আমার বান্ধবীর ক্ষেত্রে ঘটেছে তা নয়, আমাদের দেশে ছোটবেলায় যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া শিশুদের অনেকের অতীতই এমন। নিকট কোনো আত্মীয় তাঁর সন্তানকে প্রচণ্ড কষ্ট দিচ্ছে, বিষয়টি অনেক সময় কানেই তুলতে চান না মায়ের। এমন নির্মম সত্য মায়েরা কেন যেন মানতে চান না। এসব ক্ষেত্রে মাকে যে সব দোষ দেওয়া যায়, তা–ও নয়। ভাই, স্বামী, সন্তান বা এত দিনের আপনজন—তারাও যে এমনটা করতে পারে, কোন মানুষই বা কল্পনায় আনতে পারে। ন্যূনতম কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাস ভেঙে গেলে তো সমাজ-সংসারই মিথ্যা হয়ে যায়। ফলে যৌন নিগৃহীত হওয়ার পর অবিশ্বাস করে বা কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আরও বেশি কষ্ট দেন মেয়েটিকে। অনেক সময় ঘটনার জন্য মেয়েটির ওপরই দোষারোপ করেন।

আরেকটি ছোট্ট মেয়ের গল্প বলি। ছোটবেলায় বাড়িতে পড়াতে আসা হুজুর ছোট ওই মেয়েকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করত। বিষয়টি সে যখন পরিবারকে জানায়, পরিবারের লোকজন ওই লোককে বাসা থেকে বের করে দেয়। তবে সেই সঙ্গে মেয়েটির সঙ্গেও কিছুটা নির্মম আচরণ করে। মেয়েটিকে মারধর করে। কেন প্রথমেই মেয়েটি বাবা-মাকে কথাটা বলেনি, তাই ওকে বকাঝকা করেন। কথা বন্ধ করে দেন পরিবারের সবাই। অথচ মেয়েটি এর আগে এই বিষয়টি বুঝতই না কিছু। জানতই না এমন ধরনের কোনো কিছু কখনো হয়। মেয়েটি অনেক কষ্ট পায়। সেই কষ্ট তার হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে। এই ধরনের কোনো বিপদে সে পরিবারের সমর্থন পাবে না, এমন একটি ধারণা তার মনে গেড়ে বসে।

চাচাতো ভাইয়ের দ্বারা যৌন নিগ্রহের কথা পরিবারের কথা কাউকে বোঝাতে না পারে প্রতিবেশী এক মেয়েকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় মানসিক রোগী হয়ে যেতে দেখেছি। পরে পরিবারের মানুষেরা বিষয়টি বুঝতে পারে, তবে সে তখন অসুস্থ।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১২ সালে ৮৫ জন, ২০১৩ সালে ১৫০ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ চিত্র থেকেই স্পষ্ট, প্রতিবছরই শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬১২টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন ধরনের যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

সংখ্যাটা দেখুন, দিন দিন বাড়ছে। যুগ আধুনিক হচ্ছে, সমাজ পাল্টাচ্ছে। অথচ মেয়েশিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা যেন বন্ধই করা যাচ্ছে না। এর একটি অন্যতম কারণ পরিবার। পরিবার বলতে, বাবা, মা, ভাই ও বোন মিলে যে পরিবার তাকেই বোঝাচ্ছি। নিজের সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে মা না বুঝলে, আর কে বুঝবে? মা যদি মেয়ের কষ্টটা বুঝে রুখে না দাঁড়াতে পারেন, তাহলে এই নৃশংসতা থেকে কীভাবে মুক্তি মিলবে।

মেয়েটি যেন আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে, সেটা নিশ্চিত করুন। আপনার মেয়ে যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে সেই মানুষের কোনো বিকৃত আচরণের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন। যত বাধাই আসুক না কেন, সন্তানের জীবনের চেয়ে পৃথিবীর অন্য কাউকে প্রাধান্য দেবেন না। তাকে বিশ্বাস করে কষ্টের কথাটা শুনুন। তিরস্কার করবেন না।

শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার। সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের। অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, আর বুঝলেও প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করতে পারে না। করার সাহসও অনেক সময় সঞ্চয় করে উঠতে পারে না। শিশুর সবচেয়ে আপন হয়ে মাকেই বিষয়টি বুঝতে হয়। দ্বিধা ঝেড়ে যদি সন্তান মাকে বিষয়টি জানায়, মাকে তা বিশ্বাস করতে হবে।

এমন একটা কথা প্রচলিত আছে যে শিশুরা সব সময় সত্য বলে। আসলে বিষয়টি হলো, শিশুরা তাদের সামনে যা ঘটে বা তাদের সঙ্গে যা ঘটে, তারা তা নিজের মতো করে ভাবে বা বুঝে নেয়। হয়তো অপরিণত শিশুটির প্রকাশের ভাষাটা স্পষ্ট হয় না। এ ক্ষেত্রে একজন মা-ই পারেন স্নেহ দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে, সময় দিয়ে তার কথাটা শুনতে। মাকে বুঝতে হবে, কেন তাঁর সন্তান আপন কাউকে নিয়ে এমন কথা বলছে। মাকে সত্য খুঁজতে হবে। আর সত্য সামনে এলে মাকেই হয়ে উঠতে হবে শিশুটির রক্ষাকর্তা।