নমরুদ পারে নাই, আর তো গাপ্পি!

নমরুদ বুঝেছিল মশা কী জিনিস! তার হাতিশালের হাতি, ঘোড়াশালের ঘোড়া, লোক-লস্কর, সেপাই-সান্ত্রী, পেয়াদা-বরকন্দাজ, চৌকিদার-দফাদারের দফারফা করে ছেড়েছিল আবাবিলের ঝাঁকের মতো ছুটে আসা মশক বাহিনী। একটা ল্যাংড়া মশা টুক করে ঢুকে পড়েছিল নমরুদের নাকে। নাক বেয়ে মাথায়। মাথায় মানে মগজে। মগজে মানে ঘিলুতে। ঘিলুতে মানে বুদ্ধির গোডাউনে। মানে হার্ডডিস্কে। সেখানে পাতিয়ালা ঘরানায় আহির ভৈরবী রাগে সেই মশা পন পন করে গান ধরেছিল। সেই গান থামাতে চব্বিশ ঘণ্টা নমরুদের মাথায় খড়মের বাড়ি মারতে হয়েছিল। গানের চোটে বুদ্ধিশুদ্ধি আগেই গিয়েছিল। এবার বাড়ির চোটে চির জনমের মতো স্লিপ মুডে চলে গেল সে।
নমরুদেরও আগে মশা ছিল। এখনো আছে। আকাশে আছে। মাটিতে আছে। জলে আছে। স্থলে আছে। ধর্মগ্রন্থ থেকে পুরাণ, কবিতা থেকে উপন্যাস, যাত্রা থেকে থিয়েটার, হোয়াইট হাউস থেকে বঙ্গভবন; নিউইয়র্ক থেকে ভূতের গলি; আগরতলা থেকে খাটের তলা—কোথায় নেই সে?
মশার বিনাশ নেই। সে মৃন্ময়। সে চিন্ময়। সে অজর অমর অক্ষয়। সে অব্যয়! সে মানব, দানব, দেবতার ভয়।
সেই মশা নমরুদের পর এবার সবচেয়ে যার পিছে লেগেছে, তার নাম ঢাকা শহর। রাজধানীবাসীকে একের পর এক নিত্যনতুন তোহ্ফা দিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর পর এবার সাপ্লাই করছে চিকুনগুনিয়া। শরীরের প্রতিটি জয়েন্টের প্রতিটি পয়েন্টে যখন ‘অনেক জমানো ব্যথা-বেদনা’ চিক্কুর পাড়ে, তখন অবলা নগরবাসী যাকে শাপশাপান্ত করে, তার নাম সিটি করপোরেশন। এক নগরের দুই করপোরেশনের দুই নগরপিতা তাতে এখন ভস্মীভূতপ্রায়।
এ অবস্থায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কেমিক্যাল থিউরির ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এবার সে ইকো-ফ্রেন্ডলি কায়দায় মশা মোকাবিলায় নামছে। সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা আর কি!
ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন, তাঁর এলাকায় মশার প্রকোপ কমাতে ৪৫০ কিলোমিটার নর্দমায় গাপ্পি মাছের পোনা ছাড়া হবে। সোমবার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধবিষয়ক সচেতনতামূলক সেমিনারে সাঈদ খোকন এই মারাত্মক ঘোষণা দেন। এই সেমিনারে ঐকিক নিয়মে অঙ্ক কষে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, এইবার আর মশারা পার পাবে না। সেখানে বলা হয়, একটি গাপ্পি মাছ দিনে গড়ে ৫০টি মশার লার্ভা ধ্বংস করতে পারে। আর নর্দমায় ছাড়া হবে ১৫ লাখ গাপ্পি।
১৫ লাখকে ৫০ দিয়ে গুণ করতে গিয়ে ফিরে এসেছি। কারণ, ঢাকা শহরে কয় কোটি মশা আছে, আর প্রতিদিন তারা কয় কোটি বালবাচ্চা পয়দা করছে, সেই হিসাব মেয়র মহোদয় দেননি। তিনি খালি ঘোষণাই দেননি, নিজে বিশ্ববিদ্যালয়টির সুইমিংপুলে প্রতীকী গাপ্পি মাছের পোনা অবমুক্তও করেছেন।
এত দিন অ্যাকুরিয়ামেই পোয়েসিলা রেটিকুলাটা প্রজাতির এই গাপ্পি মাছ দেখেছি। পয়সা খরচ করে কাঁটাবন মার্কেট থেকে বাহারি এই মাছ কিনতে হয়। রাজধানীবাসীর কী বিরাট কপাল! সেই মাছ এখন ঝাঁকে ঝাঁকে নর্দমায় দেখা যাবে। তারা কিলবিল করে নগরবাসীর মনোরঞ্জন করবে। টপাস টপাস করে লার্ভা খাবে। আরও যা যা খাবে তার দুর্গন্ধযুক্ত দৃশ্যকল্প বড় জোর মনে আনা যায়; লেখা যায় না।
এই গাপ্পি প্রকল্পের আরেকটি মহান দিক হলো পুষ্টি। এই মাছের চাষ রাজধানীবাসীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রাখতে পারে। পত্রিকায় খবর এসেছে, সিটি করপোরেশনের মশক নিধনে যে ওষুধ দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয় না। শুধু ধোঁয়া ছড়িয়েই কোটি কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে মশক নিধনে ডিএসসিসির বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এবার রাখা হয়েছে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এতে মশা না মরলেও ধোঁয়ার পরিমাণ দ্বিগুণ হবে সন্দেহ নেই। সেই ধোঁয়ায় কিছু লোক দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। কিছু লোক জন্মগত এবং কিছু লোক স্বভাবগত রাতকানা। মলা-ঢ্যালা পরিবারভুক্ত এই গাপ্পি মাছ নর্দমা থেকে ধরে তাদের খাওয়ালে তারা দৃষ্টির পাশাপাশি দিব্যদৃষ্টিও ফিরে পেতে পারে।
মশক নিধনের সংগ্রামে ডিএনসিসির মেয়র আনিসুল হকও কম যাননি। তিনি সম্প্রতি মশক নিধন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এবার মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য ২০ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা প্রতিবছরই মশক নিধনের জন্য কার্যক্রম বাড়াচ্ছি। মশক নিধনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে যন্ত্রপাতি ওষুধ ক্রয় এবং জলাশয়ের কচুরিপানা পরিষ্কার করা হয়েছে।’ বরাদ্দ বাড়াতে অবিলম্বে আনিসুল হককেও এই গাপ্পি মাছের গপ্পো শোনানো হবে আশা করছি।
কিন্তু উপলব্ধির অন্তর্লোক থেকে একটি প্রশ্ন কিন্তু উঁকি দিয়েই যাচ্ছে: গাপ্পি মাছ লার্ভা খাওয়ার আগে বড় বড় ‘মশা’র খপ্পর থেকে বাঁচতে পারবে তো সিটি করপোরেশন? তার নাকে তো আগেই ঢুকে পড়েছে তারা। নাক বেয়ে মাথায়। মাথায় মানে মগজে। মগজে মানে ঘিলুতে। ঘিলুতে মানে বুদ্ধির গোডাউনে। মানে নৈতিক চিন্তার হার্ডডিস্কে। সেখানে পাতিয়ালা ঘরানায় এখন আহির ভৈরবী রাগে সেই মশা পন পন করে গান ধরেছে। এই মাথায় এখন খড়মের বাড়ি দেওয়া যাবে না। অপারেশন দরকার।