হাওরপারের মানুষকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে

>

গত ২৯ এপ্রিল ২০১৭, প্রথম আলোর আয়োজনে ‘হাওরে ফসলহানি: করণীয় কী’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে এই ক্রোড়পত্রে ছাপা হলো

সুনামগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার হলে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘হাওরে ফসলহানি: করণীয় কী’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা
সুনামগঞ্জের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার হলে গত ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ‘হাওরে ফসলহানি: করণীয় কী’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অতিথিরা

আলোচনায় সুপারিশ

*  প্রতিটি হাওরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তাই পরিকল্পনা করতে হবে মাঠে এসে, হাওরপারের মানুষকে নিয়ে। না হলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না

*  হাওরের মানুষকে অর্থনীতির মূলধারায় নিয়ে আসতে হবে

*  হাওর এলাকার শিশুদের শিক্ষায় আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে

*  হাওরের বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে

*  হাওরের ফসল রক্ষায় হাওর অঞ্চলের মানুষকে যুক্ত করতে হবে

*  নদীতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে

আলোচনা

সোহরাব হাসান

হাওর শুধু সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়, হাওরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। হাওর দেশের অন্যতম প্রাকৃতিক, মৎস্য ও ধানসম্পদে সমৃদ্ধ এলাকা। আজ হাওরে যে দুর্যোগ চলছে, সেই দুর্গত মানুষের পাশে সরকার দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই দাঁড়ানো যথেষ্ট নয়। এই যথেষ্ট নয় কথাটি আমরা জানাতে চাই। হাওরবাসী আজ বিপন্ন। অনেকেই বলছেন, এই দুর্যোগ মানবসৃষ্ট। যদি এটা হয়ে থাকে তাহলে সেটি খুবই উদ্বেগের বিষয়।

লাজ্জাত এনাব মহছি

আমরা আপনাদের মাধ্যমে হাওরবাসীর দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরতে চাই। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে হবে। এই পরিকল্পনা কী হতে পারে, হাওরবাসীই তা বলবেন।

হুমায়ুন মনজুর চৌধুরী
হুমায়ুন মনজুর চৌধুরী

হুমায়ুন মনজুর চৌধুরী
হাওরের এই কৃষকদের টাকায় আমরা বাড়ি-গাড়ি করি। তাই তাঁদের দুর্দিনে আমরা চোখ-মুখ বুজে বসে থাকতে পারি না, আইনজীবীরা বসে থাকতে পারেন না। আমরা দুর্নীতির বিচার চাই। আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ সভা করে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করারও প্রস্তুতি চলছে।
হাওরে ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। ১২টি বাঁধের কাজ শুরুই হয়নি। আমি বলব অন্য যেগুলো হয়েছে সেগুলোয়ও প্রকৃত অর্থে কোনো কাজ হয়নি। স্থানীয়  ভাষায় বলতে হয়, উড়া উড়া মাটি ফেলা হয়েছে। এ অবস্থার বিহিত না হলে ভবিষ্যতে এ রকম মহাদুর্যোগ আরও হবে।

পরিমল কান্তি দে
পরিমল কান্তি দে

পরিমল কান্তি দে
দুর্যোগ হয়েছে, আমরা দুর্গত হয়েছি। এখন ত্রাণ আসছে। যা বরাদ্দ আসছে, সেটি যেন প্রকৃত কৃষকেরা পান। তাতে যেন স্বচ্ছতা থাকে। এখানে যেন দুর্নীতি না হয়। আমাদের লক্ষ রাখতে হবে, হাওর এলাকার শিক্ষার ক্ষেত্রে এই দুর্যোগ যেন প্রভাব ফেলতে না পারে। শিক্ষার্থীরা যেন ঝরে না পড়ে। কারণ, গরিব অভিভাবকেরা অভাবের কারণে সন্তানদের এখন কাজে দিয়ে দেবেন। এটা যেন না হয়।
এ জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের আগামী এক বছরের জন্য বেতন মওকুফ করা, সবাইকে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসা এবং প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিডডে মিল চালু করতে হবে। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলে তারা স্কুলে আসতে ও থাকতে উৎসাহ পাবে। একইভাবে হাওর এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় খাবার না পাওয়ায় মানুষের পুষ্টিগত সমস্যা হবে। নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেবে।

বজলুল মজিদ চৌধুরী
বজলুল মজিদ চৌধুরী

বজলুল মজিদ চৌধুরী
আমরা ‘হাওর বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ নামে একটা সংগঠন করেছি। অনেকেই আমাদের জিজ্ঞেস করেন আমরা হাওর বাঁচানোর কথা কেন বলছি। আসলে হাওরকে একটা কোরামিন দিয়ে রাখা হয়েছে। লাইফ সেভিং ড্রাগ দিয়ে রাখা হযেছে। হাওর এখন লাইফ সাপোর্টে আছে। হাওর প্রকৃতপক্ষে মরে যাচ্ছে।
হাওর উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা হয়, কথা হয়, কিন্তু কাজ হয় না। প্রতিবছর হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার ও পিআইসি লুটপাট করে। এবারও বাঁধ নির্মাণকাজে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। সুনামগঞ্জে নদী ও হাওরের নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। নদী ও হাওরের পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। কিন্তু নদী খননের কোনো পরিকল্পনা নেই। নদী খনন না করলে ফসল বাঁচানো যাবে না।

সালেহ আহমদ
সালেহ আহমদ

সালেহ আহমদ
দুই বছর আগে বাঁধের কাজ চলার সময় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে দেখেছিলাম। বাঁধের যে কাজ হয়নি সেটা ভিডিও করে এনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের কাছে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা বিষয়টি আমলে নেননি। এই বাঁধ না হওয়ার জন্য কারা দায়ী চিহ্নিত করতে হবে। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।
সুনামগঞ্জ বাঁচাও, হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নামে যেটা হচ্ছে, সেটা করছে সুনামগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও সুশীল সমাজের    লোকজন। কোনো রাজনৈতিক দল মানুষের পক্ষে প্রকাশ্যে আন্দোলনে আসে না। তবে জাতীয় পার্টি একটা সমাবেশ করেছে।

আলী হায়দার
আলী হায়দার

আলী হায়দার
প্রথম কথা হলো এখন ফসলহারা কৃষককে বাঁচাতে হবে। তাদের পাশে সবাইকে দাঁড়াতে হবে। এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পর দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করতে হবে, কীভাবে হাওরের ফসল রক্ষা করা যায়।
বারবার ফসলহানির পর এ অঞ্চলের মানুষ কৃষির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অনেকেই পেশা বদলে ফেলছে। অথচ এই বোরো ফসলই আমাদের ভরসা।
আপাতত এর কোনো বিকল্প আমাদের সামনে নেই। ফসলহারা কৃষকদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আগামী বোরো মৌসুমে তাদের প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ বিনা মূল্যে দিতে হবে।
সব ধরনের ঋণ মওকুফ করতে হবে। এসব শুধু কথায় নয়, কাজে করে দেখাতে হবে। কৃষকেরা          যেন বিশ্বাস করেন, আস্থা ফিরে পান সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

পাহাড়ি ঢল প্রতিবছরই আসে। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম পাহাড়ি ছড়া হয়ে ঢল এসে নদীতে পড়ত। এসব ঢলের পানি হাওরে ঢুকত না। নদী গভীর ছিল, এ কারণে সহজেই পানি ভাটিতে চলে যেত। এখন নদী, খাল, ছড়া—সব ভরাট হয়ে একাকার।

শামীমা শাহরিয়ার
শামীমা শাহরিয়ার

শামীমা শাহরিয়ার
পানি উন্নয়ন বোর্ডের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের নীতিমালা সম্পূর্ণভাবে বদলাতে হবে। প্রতিবছরই ফসল যায়, আমরা আন্দোলন করি। কৃষকদের পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে আমি মামলার শিকার হয়েছি। এক জায়গার লোককে অন্য জায়গার পিআইসির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাহলে কেন দুর্নীতি হবে না। এই দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
আমি চার মাস আগে হাওর ঘুরে দেখেছি, বাঁধের কাজ হচ্ছে না। পাউবো, জেলা প্রশাসক, সাংবাদিক সবাইকে জানিয়েছি। তারপরও সময়মতো কাজ শুরু হয়নি। হাওরে আমাদের একটাই ফসল। এই ফসল রক্ষায় আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে।
আমরা কোনো কিছু বললে পাউবোর কর্মকর্তারা এক্সপার্ট ওপেনিয়নের কথা বলেন। আমরা বলি, এক্সপার্ট ওপেনিয়নের জন্য আপনাদের মতো সুশিক্ষিত হতে হবে না। হাওরের মানুষের কাছে যান। তাঁরা যে মতবাদ দেবেন, সেভাবে কাজ করেন। হাওরের কৃষকেরা আপনাদের চেয়ে ভালো জানেন। কোথায়-কখন বাঁধ দিতে হবে, কোন হাওর কীভাবে রক্ষা করতে হবে—সবই কৃষকেরা জানেন। কারণ, তাঁরাই প্রতিনিয়ত হাওরে থেকে লড়াই করছেন।

পঙ্কজ কান্তি দে
পঙ্কজ কান্তি দে

পঙ্কজ কান্তি দে
সুনামগঞ্জে এত বড় দুর্যোগ সামনে আসছে, বাঁধের কাজ হচ্ছে না। রাজনৈতিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন কেউই জোরালোভাবে আগে বিষয়টি উপস্থাপন করতে পারেনি। যখন রাজনৈতিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন ভূমিকা রাখতে পারেনি, তখন হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও সংগঠন করে মুক্তিযোদ্ধা, আইনজীবী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমকর্মীরা মাঠে নেমেছেন। সোচ্চার হয়েছেন। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সংগঠন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার মানুষ অতীতে কখনো এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের জন্য এবার ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতির প্রোগ্রামে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী বলেছেন ১৭ কোটি টাকা হলে হাওরের বাঁধ রক্ষা করা যায়। কিন্তু ৬৯ কোটি টাকা দিয়েও ফসল রক্ষা হয়নি। ২৩ মার্চ সুনামগঞ্জের চন্দ্রসোনারথাল হাওর তলিয়ে যায়। হাওরে যেদিকে বাঁধের কোনো কাজই হয়নি সেদিকে পানি ঢুকে। পরের দিন ধরমপাশায় আরও তিনটি হাওর একইভাবে তলিয়ে যায়।
২৯ মার্চ জেলার জগন্নাথপুরের সবচেয়ে বড় ধানের হাওর নলুয়ার হাওর তলিয়ে যায়। ঠিক একইভাবে ঠিকাদার যেদিকে কোনো কাজ করেনি, সেদিকে ঢলের পানি ঢোকে। পরে এই হাওরের বাঁধগুলো ভেঙে যায়। অর্থাৎ বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা জলে গেছে। পাউবো ৫০-৭০ শতাংশ কাজ হয়েছে বলে যে দাবি করে, সেটিকে আমরা মিথ্যাচার বলছি। ফসলহারা মানুষ এলাকা ছাড়ছে। সব কৃষকের অবস্থা খারাপ। সবাই চালের লাইনে দাঁড়াতে পারছেন না।

মধ্যবিত্ত কৃষকেরা পড়েছেন মহাসংকটে, ঘরে খাবার নেই, কিন্তু তাঁরা চালের লাইনে, সাহায্যের জন্য কারও কাছে হাত পাততে পারছেন না। তাঁদের কথাও ভাবতে হবে। তাঁদের জন্য রেশন কার্ড চালু করতে হবে।

মলয় চক্রবর্তী
মলয় চক্রবর্তী

মলয় চক্রবর্তী
হাওর কোনো গ্রাম নয়, হাওর প্রকৃতির দান। হাওরকে হাওরের মতোই রাখতে হবে। প্রতিবছর উন্নয়ন করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এখন উন্নয়নের নামে নানা প্রকল্প করে হাওরের আরও ক্ষতি করা হচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের।
হাওরে বাঁধ নির্মাণ বলুন, আর যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প বলুন, এসবে একটা বাণিজ্য থাকে। এবার বাঁধ নির্মাণের নামে যা হয়েছে সেটা পুকুরচুরি নয়, সাগরচুরি। হাওরে বাঁধের কোনো কাজই হয়নি। লক্ষণীয়, এবার ফসলডুবির পর মাছ ও হাঁস মরেছে।
যখন সবাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তখন অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল, ইউরেনিয়াম সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। একটা চক্র এটা পরিকল্পিতভাবে করে থাকে। দুর্নীতি আড়াল করতেই এই অপচেষ্টা।

কামরুজ্জামান কামরুল
কামরুজ্জামান কামরুল

কামরুজ্জামান কামরুল
হাওরের ফসল রক্ষা আর হাওরকে হাওরের মতো রাখতে হলে ভবিষ্যৎ করণীয় একটিই, নদী খনন। হাওরের সঙ্গে সংযোগ নদী খনন করলে তিন দিক থেকে উপকার হবে। আমাদের ফসল রক্ষা হবে। বাঁধে বৃক্ষরোপণ করা যাবে। সেই সঙ্গে এলাকার ভূমিহীন লোকজন বাঁধে বসতি গড়তে পারবেন। এই দুর্যোগ সবাই মিলে মোকাবিলা করতে হবে। দলমত নির্বিশেষ এক হয়ে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে কাজে স্বচ্ছতা রাখতে হবে। যদি বলে দেওয়া হয়, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অথবা সেক্রেটারির সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেন, তাহলে প্রকৃত কাজ হবে না। প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের নিয়ে কাজ করতে হবে। হাওরের ফসল রক্ষায় হাওরের মানুষকে যুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনকেও রাখতে হবে।

মুক্তাদীর আহমদ
মুক্তাদীর আহমদ

মুক্তাদীর আহমদ
হাওরের সংকট শুরুই হয়েছে দুর্নীতির কারণে। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড গতানুগতিকভাবে বাঁধের কাজ করে। এই কাজ হয় ঠিকাদার ও পিআইসির মাধ্যমে। নীতিমালা অনুযায়ী পিআইসিতে সাংসদেরা তিনজন প্রতিনিধি দেন। উপজেলা চেয়ারম্যান দেন একজন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কমিটি গঠন করতে গিয়েই দুর্নীতি হয়। কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির নামে বিলের চেক হয়। কাজ শুরুর আগেই কে এই চেক নিজের হস্তগত করবে, এ নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই প্রতিযোগিতা হলো পকেট ভরার প্রতিযোগিতা। যাঁরা হাওরের জন্য নিবেদিতপ্রাণ, তাঁরা কমিটিতে স্থান পান না। যাঁরা কমিটিতে থাকেন, তাঁরা সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী। ঠিকাদারেরা কোথাও কোনো কাজ করেনি। কিন্তু দুঃখজনক হলো, পানিসম্পদমন্ত্রী বলেছেন, বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢুকেছে। আমি এর প্রতিবাদ করছি। সুনামগঞ্জের কোথাও বাঁধ উপচে হাওরে পানি ঢোকেনি। আমি নলুয়ার হাওরপারের মানুষ। একেক হাওরের একেক চরিত্র। একটি হাওর দিয়ে সব হাওর বিবেচনায় রাখা ঠিক না। নলুয়ার হাওরের বাঁধ ভেঙে হাওর তলিয়েছে। মন্ত্রী যেটা বলছেন, সেটা সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা। মন্ত্রী বলেছেন, কৃষকেরা বাঁধ কেটে দেন। এটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা। কৃষকেরা বাঁধ কেটে নিজেদের ফসল নষ্ট করবেন না। এখন একজনের দোষ অন্যজনের কাঁধে চাপানোর একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ত্রাণ নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। এসব বন্ধ করতে হবে।

অমর চাঁদ দাশ
অমর চাঁদ দাশ

অমর চাঁদ দাশ 
একটা বাঁধে মানবঢাল তৈরি করে আমরা ফসল রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে যাচ্ছে, আমরা সারি বেঁধে নেমে সবাই মিলে পানি আটকানোর চেষ্টা করেছি। প্রথমে বাঁশ পুঁতে পরে সেই বাঁশ ধরে মানুষজন দাঁড়িয়ে পানি আটকায় এবং সেখানে মাটির বস্তা ফেলে। ফসল রক্ষায় স্থানীয় কৃষকেরা অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ওই বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় অরুণ চন্দ্র দাশ নামের এক লোক তাঁর একটি স্টিলের নৌকা বাঁধে পুঁতে দেন। মানুষ সব ধরনের চেষ্টাই করেছে। আমার বয়স ৭২। একসময় পাহাড়ের পাদদেশে অনেক বন ছিল। গাছপালা ছিল। যেগুলো ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলি আটকে দিত। যে কারণে হাওরে, নদীতে পলি পড়ত না, নদী ভরাট হতো না। এখন সেই বন, গাছপালা নেই। পাহাড়েও নির্বিচারে বন উজাড় করা হয়েছে। এতে ঢলের সঙ্গে নেমে আসা পলিতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে আমাদের নদী ও হাওর। পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে। এখন নদী খননের বিকল্প নেই। নদীতে পানির ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।

মনেছা বেগম
মনেছা বেগম

মনেছা বেগম
চৈত্র মাসের ১১ তারিখ হাওরে পানি আসে। আমি তখন বাঁধে একটি নৌকা নিয়ে আছি। রাত তখন আড়াইটা। হঠাৎ দেখি ঠিকাদার যে বাঁধ করে ফেলে রেখে গেছে সেটির এক পাশ দিয়ে পানি ঢুকতেছে। আমি পাউবো কর্মকর্তাকে ফোন দিই। তিনি বললেন, লেবার লাগিয়ে আপাতত বাঁধটা আটকান। সঙ্গে সঙ্গে আমি পরনের কাপড় দিয়ে মাটি এনে কিছু মাটি ফেলে পানি আটকাই। পরে নৌকা নিয়ে যাই পাশের বদরপুর গ্রামে। গ্রাম থেকে লোক নিয়ে এসে রাতেই কাজ করে পানি আটকাই। পরের দিন ১২০টি বালুর বস্তা এনে মাটি দিয়ে এই বাঁধ রক্ষা করা হয়। আমি টানা ২৪ দিন বাঁধে ছিলাম। সাত দিন এক কাপড়ে থেকেছি। এই কাপড় পরনে ভিজছে আবার পরনে শুকাইছে। ঠিকাদারের বাঁধে আমি ১ লাখ ৬৪ হাজার টাকার কাজ করেছি। আমার নিজের একটা কাজ ছিল পাঁচ লাখ টাকার। প্রথমবার ৯৮ হাজার, পরে ৮০ হাজার, এরপরে ৩৫ হাজার টাকা দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। যখন অবস্থা খারাপ তখন টাকা না পেয়ে ঘরে একটা গাভি ছিল, সেটা বিক্রি করছি। সেই টাকা দিয়া বাঁধে কাজ করিয়েছি। আমাদের ভোট দিয়ে মানুষ মেম্বার বানাইছে। তাদের বিপদের সময় আমি না কাজ করলে আমাকে আবার কেন ভোট দেবে? এ জন্য আমি সবাইকে নিয়ে কষ্ট করছি।

আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী
আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী

আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী
হাওরের এই দুর্যোগকে অনেকেই বলছেন মানবসৃষ্ট। আমি এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই, আমরা কি কখনো মার্চের শেষ দিকে এত বৃষ্টি দেখেছি। এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। সেটারও প্রভাব আছে। এখন হাওরকে নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে। হাওরের মানুষকে অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। হাওরে ফসল গেছে, মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মাছ, হাঁসও মরেছে। এ অবস্থায় আমরা আশার আলোও দেখছি। হাওরে মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রেরণামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি জোরদার হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দুর্গম হাওর এলাকায় যাচ্ছেন। হাওরের এই পরিস্থিতিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। হাওরের বিপন্ন অবস্থা রাষ্ট্র স্বীকার করে নিয়েছে। মানুষের এই হাহাকারের বিষয়টি মাথায় রেখেই ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে হবে। আপনারা শুধু ফসলের কথা বললেন। কিন্তু হাওরের যে বিশাল সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, সবকিছু মাথায় রেখেই সরকার কাজ করছে। কৃষি মন্ত্রণালয় আমন ও আউশ নিয়ে কাজ করছে। আমরা চাচ্ছি এখন আমন ও আউশ যাতে কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা দিতে ব্যাংকগুলো বসে আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের এসব উদ্যোগের কথা কৃষকদের জানানো হচ্ছে না। যে কারণে তাঁরা নিজেদের বেশি অসহায় ভাবছেন। হাওরের মানুষকে সব তথ্য জানাতে হবে। তাদের সচেতন করতে হবে।

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ
পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ
দুটি কারণে সুনামগঞ্জে ফসলহানি ঘটেছে। একটি হচ্ছে চৈত্র মাসে অতিবৃষ্টি আর আরেকটি হলো কিছু মানুষের অতিলোভ। লোভী কিছু মানুষ লাখ লাখ মানুষের মুখের  খাবার কেড়ে নিয়েছে। এদের মনে মানুষের জন্য, হাওরের কৃষদের জন্য কোনো দয়ামায়া নেই। হাওরে ফসলরক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবার ফসল রক্ষা প্রকল্পে সরকারের অর্থ বরাদ্দ ছিল ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঠিকাদারির মাধ্যমে ৪৮ কোটি টাকা, পিআইসির (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে ২০ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কথা ছিল। কাজ সময়মতো হয়নি, টাকাও লুটপাট হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ফসল রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ওপর মানুষের আর কোনো আস্থা নেই। তাই তাদের দিয়ে আর বাঁধের কাজ করানো যাবে না। আমি ৫ এপ্রিল প্রকাশ্যে সমাবেশ করে প্রথম সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা ও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছি। সুনামগঞ্জে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এক বৈঠকে বলে বসলেন, কোনো এলাকার অর্ধেক মানুষ মারা গেলে সেই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যেতে পারে। সুনামগঞ্জে একটা ছাগলও মরেনি। মানুষের হাহাকারের বিপরীতে তাঁর বক্তব্য মানুষকে কাঁদিয়েছে, কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ওই সভায় সচিবের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছি। প্রতিটি হাওরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে, নিজস্ব চরিত্র আছে। একেকটি হাওর একেক রকম। তাই ঢাকায় বসে পরিকল্পনা করলে হবে না। পরিকল্পনা করতে হবে মাঠে এসে, হাওরপারের মানুষকে নিয়ে। না হলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।

অনুলিখন: উজ্জ্বল মেহেদী ও খলিল রহমান

যাঁরা অংশ নিলেন

পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ    : সাংসদ, সুনামগঞ্জ-৪ আসন

আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী   : সাংসদ, সংরক্ষিত নারী আসন

হুমায়ুন মনজুর চৌধুরী             : জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, সুনামগঞ্জ

বজলুল মজিদ চৌধুরী              :   আহ্বায়ক, ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’

পরিমল কান্তি দে                    : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ

সালেহ আহমদ                      : সাধারণ সম্পাদক, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাঠাগার, সুনামগঞ্জ

আলী হায়দার                        : সাধারণ সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সুনামগঞ্জ

শামীমা শাহরিয়ার                  : সভাপতি, জেলা নারী উন্নয়ন ফোরাম, সুনামগঞ্জ

পঙ্কজ কান্তি দে                      : সম্পাদক, দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর

মলয় চক্রবর্তী                        : সাধারণ সম্পাদক, ‘সুনামগঞ্জ পরিবেশ আন্দোলন

কামরুজ্জামান কামরুল            : চেয়ারম্যান, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ

মুক্তাদীর আহমদ                    : সাবেক ভাইস             চেয়ারম্যান, জগন্নাথপুর উপজেলা, সুনামগঞ্জ

অমর চাঁদ দাশ                       : কৃষক

মনেছা বেগম                         : ইউপি সদস্য

সূচনা বক্তব্য                   : সোহরাব হাসান, যুগ্ম সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালক                       : লাজ্জাত এনাব                মহছি, উপসম্পাদক, প্রথম আলো

সমন্বয়ক                       : উজ্জ্বল মেহেদী ও খলিল রহমান