আত্মহত্যার এই প্রবণতা কেন?

শুভ ধর ছিলেন অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান। বাবা রঞ্জিত ধর বড় ছেলেটির নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম রেখেছিলেন ‘শুভ জুয়েলার্স’। এইচএসসি পাস করার পর সেই ব্যবসার হাল ধরেছিলেন শুভ ধর নিজেই। জমজমাট ব্যবসা। ফলে ২৫-২৬ বছরের যুবকটির অন্তত অর্থনৈতিক কোনো সমস্যা ছিল না। তাহলে কেন তিনি বেছে নিলেন আত্মহননের পথ? নিশ্চিত-নিরাপদ জীবনে কী এমন হতাশা গ্রাস করেছিল তাঁকে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য গিয়েছিলাম বাঁশখালীর উত্তর জলদী এলাকায় রঞ্জিত ধরের বাড়িতে। বণিকপাড়ায় বড় জায়গাজুড়ে সুন্দর দোতলা পাকা বাড়ি। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ থমথমে, শোকাবহ। গত ১৯ জুলাই এই বাড়িতেই সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছেন শুভ। কথা হয় শুভর বাবা, মা ও কাকার সঙ্গে। তাঁরা আত্মহত্যার কারণ বলতে পারলেন না। হতে পারে, বলতে চাইলেন না। তবে এলাকায় তাঁর বন্ধুস্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে সুনির্দিষ্ট কিছু জানা না গেলেও আঁচ করা
গেল কারণটি প্রেমসংক্রান্ত। কিছুদিন থেকে ফেসবুকে তাঁর লেখা ও নানা রকম মন্তব্যে মানসিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু মৃত্যুর আগে নিজেই মুছে দিয়ে গেছেন দুঃখ-হতাশার কথাগুলো।
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে আছে এ রকম অসংখ্য ঘটনা। নানাজনের ক্ষেত্রে কারণ নানাবিধ, কিন্তু পরিণতি একটিই, আত্মহত্যা বা এর চেষ্টা। বাঁশখালী আত্মহত্যাপ্রবণ অঞ্চল—এ কথা শুনে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। এ কারণে ‘বিষখালী’ অভিধাটিও জুটেছে তার কপালে। আগে সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত এসব সংবাদ ছাপা হতো। কিন্তু ইদানীং তেমন চোখে পড়ে না। তাহলে কি উন্মত্ততার এই হুজুগ কমেছে? সরেজমিনে দেখা গেল, না কমেনি। বাঁশখালীর মানুষের আত্মহত্যার প্রবণতা গুরুত্ব হারিয়েছে সংবাদমাধ্যমের কাছে। কিন্তু এখনো প্রতিদিনই গড়ে অন্তত একটি আত্মহত্যা বা এর চেষ্টা ঘটেই চলেছে এ এলাকায়।
রঞ্জিত ধরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে রেজিস্টার ঘেঁটে দেখা গেল, জুন মাসে বিষপানের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি, জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগেই এর সংখ্যা ২০–এরও বেশি। তবে এখানে সাধারণত নিয়ে আসা হয় বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এমন রোগীকে। গলায় দড়ি দিয়ে, গায়ে আগুন লাগিয়ে বা অন্য উপায়ে যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁরা এই তালিকায় নেই। ফলে আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টার সংখ্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেজিস্টারে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে যে বেশি, তা বোঝাই যায়। হাসপাতালের কর্মীদের মতে, এখানে যাঁরা আসেন তাঁদের অধিকাংশই অরগানো ফসফরাস কম্পাউন্ড (ওপিসি) নামের একধরনের কীটনাশক পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। ওই দিনই (৩০ জুলাই) হাসপাতালের ওয়ার্ডে পাওয়া গেল সাজ্জাদ ইসলাম (১৮) নামের এক তরুণকে। পূর্ব চাম্বল হায়দারীপাড়া থেকে সাজ্জাদকে আগের রাতে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন তাঁর বাবা এবাদত ইসলাম।

শয্যাশায়ী সাজ্জাদকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। চোখ-মুখ অনেকটা ফুলে গেছে, ঠোঁটে ঘায়ের মতো হয়েছে। জানতাম সদুত্তর পাব না, তবু জানতে চেয়েছিলাম, ‘কেন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলে?’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পিতার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘এমনিতেই, কোনো কারণ নেই।’ কণ্ঠে গোঁয়ার্তুমি বা অভিমানের সুর
ফুটল যেন।

সাজ্জাদের কৃষক পিতা এবাদত হোসেনও এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন, তবু চেপে ধরার পর বললেন, ‘চাষবাস করি, ছেলেও চাষের কাজে সাহায্য করে। কদিন ধরে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে, বিয়ে করতে চাইছিল। আর্থিক সামর্থ্য নেই, তার ওপর বয়স মাত্র ১৮ বছর...কী করে রাজি হব বলেন? ছেলে রাগারাগি করে বিষ খেয়ে ফেলল।’

বিত্তবান পরিবারের শুভ ধর পরিণত বয়সে প্রেমে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন, দরিদ্র কৃষক পরিবারের সাজ্জাদ মাত্র ১৮ বছর বয়সেই সেই একই চেষ্টা করেছেন।

তবে এ দুটি ঘটনা থেকে এখানকার বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনা প্রেমসংক্রান্ত, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। যেমন হাসপাতাল থেকে ঠিকানা নিয়ে কথা বলেছিলাম কাথারিয়া এলাকার আফসারউদ্দিনের (৩৫) সঙ্গে। তাঁর স্ত্রী শাহিদা বেগম (২১) বিষপান করেছিলেন মাসখানেক আগে। আফসারউদ্দিন বললেন, সামান্য পারিবারিক কলহ থেকে মাথা গরম করে বিষ খেয়ে ফেলেছিল। এখন সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। তাঁর স্ত্রী শাহিদাও তাঁর কথায় সম্মতি জানালেন, তবে সঙ্গে যোগ করলেন, স্বামী মারধর করেছিল। আফসার-শাহিদার দুই বছর বয়সী একটি মেয়ে আছে। মেয়ের মুখ চেয়ে শাহিদা আর কখনো একই ভুল করবেন না বলে জানালেন। তবে আফসারউদ্দিন কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন? জানি না।

স্বামীর নির্যাতনে স্ত্রীরা আত্মহত্যা করছেন—বাস্তবতা শুধু এ রকম নয়। দক্ষিণ জলদী এলাকার মোহাম্মদ জসীমউদ্দিনও (৩০) পারিবারিক কলহের কারণেই আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে গেছেন। এক বছর বয়সী একটি ছেলে ও মাত্র এক মাস বয়সী একটি মেয়ের পিতা কেন স্ত্রীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জের ধরে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চাইবেন, এর যুক্তিসংগত কোনো ব্যাখ্যা আছে?

চাম্বল ইউনিয়নের নাথপাড়ার সঞ্জয় দেবনাথ (৩৫) গলায় দড়ি দিয়ে মরেছেন গত ২৮ জুলাই রাতে। তাঁর আত্মহত্যার কারণ যে অভাব-দারিদ্র্য, সেটা অবশ্য বোঝা যায়। বিয়ে করেছিলেন ১৫ বছর আগে। বিয়ের পর ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। আট বছর প্রবাসে কাটিয়ে এসেও ভাগ্যের পরিবর্তন কিছু হয়নি। স্ত্রী সাথী দেবী (৩২) বেসরকারি সাহায্য সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এসব নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধ-কলহে গলায় দড়ি দিয়ে নিজেকেই শেষ করে দিলেন দুই সন্তানের বাবা সঞ্জয়।

আত্মহত্যার কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, পারিবারিক কলহ, প্রেম-সংক্রান্ত জটিলতা, কীটনাশকের সহজলভ্যতা ইত্যাদির কথা এখানকার অনেকেই বললেন। কিন্তু এ ধরনের সমস্যা তো দেশের সব জেলা-উপজেলাতেই আছে। আলাদা করে বাঁশখালীর মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কেন? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না সহজে। শুনেছি, ঝিনাইদহের শৈলকুপার মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পরিসংখ্যানের দিক থেকে তারপরই বাঁশখালীর অবস্থান।

একটি নির্দিষ্ট এলাকায় আলাদা করে এর হার বেশি কেন?—এ রকম প্রশ্নের উত্তরে মনোচিকিত্সক মোহিত কামাল বললেন, ‘ওই এলাকার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য জানি না, তবে অন্যান্য রোগের মতো এর মধ্যেও জেনেটিক কারণ থাকতে পারে। পরিবারের পূর্বসূরির মধ্যে এ প্রবণতা থাকলে তার প্রভাব পড়তে পারে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও।’

এ বক্তব্যের সমর্থনও পাওয়া গেল। বাঁশখালীতে আত্মহত্যার প্রবণতা প্রতিরোধের জন্য ২০০৫-০৬ সালে কিছুদিন কাজ করেছিল ‘ইপসা’ নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ইপসার কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শহীদুল ইসলাম জানালেন একটি চমকপ্রদ তথ্য।
ওই সময় আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে বাঁশখালী এলাকায় সভা-সমিতি করেছেন তাঁরা। তাঁদের সব সভায় নিয়মিত সচেতনতামূলক বক্তব্য দিতেন আবু ছিদ্দিক নামের পৌরসভার একজন কাউন্সিলর। বাঁশখালী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকও তিনি। তাঁর নানিসহ পরিবারের আরও কয়েকজনের অপমৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি বারবার তরুণদের এ পথে না যাওয়ার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু কয়েক মাস পর ২০০৬ সালেই আবু ছিদ্দিক নিজেও বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথ। এ যেন পারিবারিক পরম্পরারই একটি উদাহরণ।

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর কবির চৌধুরী তাঁর ব্যক্তিগত মত তুলে ধরে বললেন, কোনো এলাকায় বড় ধরনের প্রাকৃতিক বা অন্য কোনো বিপর্যয়ের পর আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। যেমন সপ্তদশ শতাব্দীতে উত্তর ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর পর সেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল। জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের পর সেখানকার বেঁচে যাওয়া মানুষ যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তার রেশ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উত্তরসূরিরা। বিশ্বের সর্বাধিক আত্মহত্যার ঘটনা যে এখনো জাপানেই ঘটে, তা-ও সেই ধারাবাহিকতার ফল বলে তাঁর ধারণা।

১৯৯১ সালে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিল বাঁশখালীর মানুষ। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল সমুদ্র উপকূলবর্তী বাঁশখালীতে। সরকারি হিসেবে যা-ই থাকুক, স্থানীয় লোকজনের ধারণা, অর্ধলাখ মানুষের জীবনহানি ঘটেছিল সেই দুর্যোগে। ঘরবাড়ি-সম্পদহানি তো ছিলই। ভাই-বোন-মা-বাবা-সন্তান হারানো মানুষগুলোর অবচেতনে সেই ভয়াবহ শোক-বেদনার স্মৃতি তাঁদের জীবনবিমুখ করে তুলেছে কি না, এ নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

প্রতিকার কী? এ নিয়েও কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত পাওয়া গেল না। মোহিত কামাল বলেন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। মসজিদ-মন্দিরে যুক্তি-ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাতে হবে কোনো ধর্মই আত্মহত্যাকে অনুমোদন করে না। আলমগীর কবির চৌধুরী বললেন, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নিয়মিত সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে।

বাঁশখালী থেকে এক অদ্ভুত বিভ্রান্তি নিয়ে ফিরে এসেছি। যাঁরা স্বেচ্ছায় নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছেন, তাঁদের সুবুদ্ধি দেওয়ার সহজ কোনো ফর্মুলা নেই। চিকিৎসক-মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সচেতন অংশকে সম্পৃক্ত করে কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা নিয়মিত কাজ করে গেলে এই অভিশাপ থেকে হয়তো মুক্তি পাবে বাঁশখালী বা শৈলকুপার মানুষ।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।