৭০ অনুচ্ছেদের অবাক ব্যাখ্যা

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের প্রধান বিষয় অবশ্যই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নয়; কিন্তু সংশোধনী বাতিলের রায়ে এই অনুচ্ছেদের ৩২ বার উল্লেখ এবং বাতিলের ভিত্তিভূমি হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদের পুনঃ পুনঃ আলোচনা আমাদের এই অনুচ্ছেদের গুরুত্ব এবং তার দীর্ঘ ছায়া স্মরণ করিয়ে দেয়। রায়ের পরে যে আলোচনা চলছে, তাতে যাঁরা বক্তব্য দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য আমাদের বিশেষ বিবেচনা দাবি করে। তাঁদের অবস্থান ও বক্তব্য দুই-ই এর কারণ। তাঁরা দুজনই এই ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে কথা বলেছেন। তদুপরি এই অনুচ্ছেদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা একটি রিট পিটিশনের শুনানি হাইকোর্টে চলছে।

বিচারপতি খায়রুল হক ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিষয়ে যা বলেছেন, তা তিন দশক ধরে সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা সপ্রমাণ হাজির করেছেন, তার ঠিক বিপরীতে। তাঁদের এই বিপরীত অবস্থানের অধিকার অস্বীকার করা আমার লক্ষ্য নয়। শুধু এটা মনে করিয়ে দেওয়া যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপলাভ করার পথে এই ধারার বিপদ নিয়ে বিচারপতি হক ২০০৬ সালে তাঁর দেওয়া রায়ে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, ২০১৭ সালে আইন কমিশনের প্রধান হিসেবে তিনি সেই অবস্থানে নেই। বিচারপতি হক ২০০৬ সালে এক মামলার রায়ে মন্তব্য করেছিলেন যে ৭০ অনুচ্ছেদের বিধিনিষেধ একজন এমপিকে দলীয় বন্দীতে পরিণত করেছে (শাখাওয়াত লিটন, ‘সংসদের বাইরে এমপিরা স্বাধীন!’ ডেইলি স্টার বাংলা সংস্করণ, ২৫ মে ২০১৭)। কিন্তু ২০১৭ সালে এসে খায়রুল হক এই ৭০ অনুচ্ছেদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বুধবার তড়িঘড়ি করে আইন কমিশনের নামে যে সংবাদ সম্মেলন করেন, তাতে বলেছেন, ‘বারবার বলা হয়েছে সাংসদেরা স্বাধীন নন। সংবিধানের ৭০ ধারা তাঁদের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। এ কারণেই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকা উচিত নয়, যাঁরা নিজেরাই স্বাধীন নন। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সাংসদেরা স্বাধীন। কারণ, ৭০ ধারায় বলা আছে, কোনো সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দেন তবে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। সংসদে ভোটাভুটিটা কিন্তু কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে হয় না। একবারই দলের পক্ষে-বিপক্ষে হতে পারে, যখন নো-কনফিডেন্স মোশন থাকে। সে ক্ষেত্রে ৭০ ধারার কথা আসে।’ (প্রথম আলো, ১০ আগস্ট ২০১৭)।

একইভাবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়।’ আইনমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, যেহেতু ‘সময়-সময় তাঁদের [সাংসদদের] ফ্রি ভোট দেওয়ারও সুযোগ আছে’ এবং যেহেতু ‘বিচারপতিদের বিষয়ে পার্টি ভোট হবে না ফ্রি ভোট হবে’ তা এখনো নির্ধারিত হয়নি এবং যেহেতু ‘পার্টি লাইনে’ ভোট হবে এমন কোনো ‘ইঙ্গিতও ছিল না’, সেহেতু আদালতের ধারণা সঠিক নয়। ৭০ অনুচ্ছেদের প্রসঙ্গে একই ধরনের কথা খায়রুল হকও এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ডিবেট বা ভোটাভুটিতে ৭০ অনুচ্ছেদের কোনো দলের ওপরে প্রভাব নেই (বিডি নিউজ ২৪, ‘কখনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ঠিক নয়, তা যত মহান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হোন না কেন’, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)।

গত কয়েক দশকে, বিশেষত ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় ব্যবস্থার পরিবর্তনের পর দেশের সংসদের কার্যক্রম এবং গণতন্ত্রের গতিধারা নিয়ে যাঁরাই গবেষণা করেছেন, তাঁরাই এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে ৭০ অনুচ্ছেদ দেশের গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করেছে (এ বিষয়ে উদাহরণ হিসেবে দেখুন, রওনক জাহান, পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অব ডেমোক্রেটাইজেশন, প্রথমা, ২০১৫)।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পূর্বসূরি হচ্ছে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ জারি করা রাষ্ট্রপতির ২৩ নম্বর আদেশ, যাতে বাংলাদেশের গণপরিষদের সদস্যদের সদস্যপদ বাতিলের কথা ছিল। সেখানে দুটি কারণে সদস্যপদ বাতিলের বিধান করা হয়, যদি কোনো সদস্য যে দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন তা থেকে ‘পদত্যাগ করেন’ অথবা বা ‘ওই দল থেকে বহিষ্কৃত’ হন। খসড়া সংবিধানেও একইভাবে তা অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু সংসদে বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে সামান্য বদল করা হয়, সেখানে দল থেকে বহিষ্কার করার কারণে সদস্যপদ বাতিলের বিধান তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু তার বদলে এর চেয়েও কঠিন ধারা অন্তর্ভুক্ত হয়—যদি দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবেই সাংসদ পদ বাতিল হওয়ার বিধান যুক্ত করা হয়।

এ বিষয়ে অনেকেই আপত্তি তোলেন এবং এই বিধানের বিষয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, ‘৭০ অনুচ্ছেদের মধ্যে এমন একটা অগণতান্ত্রিক বিধান রাখা হয়েছে, যা পৃথিবীর আর কোনো সংবিধানে নেই। এই বিধান নিয়ে সেদিন সাধারণ আলোচনার সময়েও বলেছিলাম, এই বিধান পাকিস্তানি ডিক্টেটর আইয়ুব খানের শাসনতন্ত্রেই শুধু আছে। এ ছাড়া আর কোথাও এর নজির নেই।’ একে গণতন্ত্রের ‘টুঁটি টিপে হত্যা’ বলেই তিনি মত দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদে আরও ব্যাখ্যা সংযোজন করা হয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, যদি কোনো সাংসদ, যে দল তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করেছে, সে দলের নির্দেশ অমান্য করে—(ক) সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন, অথবা (খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি ওই দলের বিপক্ষে ভোট দান করেছেন বলে গণ্য হবেন। ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আগের অনুচ্ছেদগুলো ও এর ব্যাখ্যা অক্ষুণ্ন রেখে অনুচ্ছেদটিতে দফা (২) ও (৩) সংযোজন করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘যদি কোনো সময় কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন ওঠে, তাহলে সংসদে সে দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃত্বের দাবিদার কোনো সদস্য কর্তৃক লিখিতভাবে অবহিত হওয়ার ৭ দিনের মধ্যে স্পিকার সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি অনুযায়ী ওই দলের সকল সংসদ সদস্যের সভা আহ্বান করে বিভক্তি ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা উক্ত দলের সংসদীয় নেতৃত্ব নির্ধারণ করবেন এবং সংসদে ভোটদানের ব্যাপারে অনুরূপ নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ যদি কোনো সদস্য অমান্য করেন তাহলে তিনি (১) দফার অধীন উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবে এবং সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে।’

এরপরের সংশোধনীটি হয় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৭৫ ও ১৯৯১ সালে সংযোজিত বিষয়গুলো বাদ দিয়ে এই অনুচ্ছেদকে ১৯৭২ সালের সংবিধানের জায়গায় ফেরানো হয়েছে। ফলে আমরা ১৯৭২ সালের যে পরিস্থিতিতে ছিলাম, সেখানেই প্রত্যাবর্তন করেছি।

সে কারণেই যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে ৭০ অনুচ্ছেদ সাংসদদের কিছু স্বাধীনতা দেয় এবং বিশেষ করে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে তা আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এখানে তিনটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, বাস্তবতা—পঞ্চদশ সংশোধনীর পরে সংসদে কি এমন কোনো উদাহরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে সরকারি দল, এমনকি সরকারি জোটের সাংসদেরা ক্ষমতাসীন দলের উত্থাপিত বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ভোট দিয়েছেন? এমনকি যেসব সদস্য বিতর্কে অংশ নিয়ে বিভিন্ন বিলে সংশোধনীর প্রস্তাব করেছেন কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি, তাঁরাও কি ওই সব বিলে সম্মতিসূচক ভোট দেননি? এই একই প্রশ্ন আমরা তুলতে পারি এমনকি জোট সদস্যদের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয়ত, সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদের মধ্যকার সম্পর্ক—সংবিধানের কোনো অনুচ্ছেদ কি আমরা কেবল ওই অনুচ্ছেদ দিয়েই বিবেচনা করব নাকি তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয় অনুচ্ছেদগুলোও বিবেচনায় রাখব? যে সংসদের সংসদ নেতা, দলের সংসদীয় দলের প্রধান, দলের নেতা ও সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি এবং যাঁর হাতে সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ ঘটেছে, তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের সম্ভাবনা কতটুকু? তৃতীয়ত, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি—যে দেশের প্রধান প্রধান দলের ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অনুপস্থিত, সেখানে কেবল একটি সাংবিধানিক অনুচ্ছেদ কোনো সাংসদকে তাঁর দলের বিরুদ্ধে
ভোট দেওয়ার সাহস জোগাবে, এমন মনে করার পেছনে যুক্তি পাওয়া অসম্ভব।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল ক্ষোভ প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু এই রায়ে দেশের রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব পর্যবেক্ষণ আছে, সেগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে দেশের এবং সাংবিধানিক রাজনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু অর্জনের সম্ভাবনা নেই। আইনমন্ত্রী বলেছেন যে সরকার বিচার বিভাগের সঙ্গে ‘পাওয়ার কনটেস্টে অবতীর্ণ হয় নাই’। এই বক্তব্য ইতিবাচক। এখন দেখার বিষয় তাঁর এই বক্তব্য তাঁর দলের ও সরকারের সদস্যদের আচরণে কতটা প্রকাশিত হয়।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।