মন্ত্রী যা বললেন, আমরা যা জানলাম

শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ফাইল ছবি
শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ফাইল ছবি

কঠিন সত্যকে ভালোবাসাও বড্ড কঠিন। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালত একটি দিকনির্দেশনামূলক রায় দিয়েছেন। রায়টি সরকারের পছন্দ হয়নি। উচ্চ আদালতের রায়ের বিরোধিতা, প্রধান বিচারপতির অপসারণ চেয়ে আন্দোলন ইত্যাদিতে আদালত অবমাননা হয় কি না, তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই ভেবে দেখবেন। কিন্তু এ নিয়ে বাগ্‌যুদ্ধের সীমা বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকা উচিত। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু এই রায় প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। জ্বলতে জ্বলতে একপর্যায়ে তিনি বলে ফেলেছেন, ‘এ দেশ স্বাধীন না হলেও আওয়ামী লীগ এই দেশে মাথা তুলে থাকত। আমরা পার্লামেন্টের সদস্য থাকতাম।’ 

শনিবার সকালে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঝালকাঠি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের আয়োজনে ঋণের চেক ও সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। সেখানে তিনি আরও যা বলেন, তা কহতব্য নয়। আমরা কেবল নজর টানছি ‘মাথা’ প্রসঙ্গে তাঁর উক্তির ওপর।
শিল্পমন্ত্রী যে পরিস্থিতির কথা বলেছেন, তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। পরাধীন দেশে স্বাধীনতার পক্ষের দল আওয়ামী লীগ কীভাবে মাথা উঁচু করে থাকত? পাকিস্তান আমলে যখন নির্বাচিত সরকার বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে উচ্ছেদ হতো, সেনাশাসকদের সেই পার্লামেন্টে কার মাথা উঁচু থাকত আসলে? ইয়াহিয়ার পার্লামেন্টে থাকার চেয়ে স্বাধীনতার লড়াই করে যাঁরা মাথা উঁচু রেখেছিলেন, এ বক্তব্য তাঁদের হেয় করে না কি?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো দুর্ঘটনার ফসল নয়। দীর্ঘদিনের সুচিন্তিত আন্দোলন-সংগ্রামের অর্জন এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগও এমনটাই বলে থাকে। স্বাধীন না হওয়ার কোনো অপশন বা সুযোগ আমাদের ছিল না। বাঙালিদের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এতই প্রবল হয়েছিল, সেখান থেকে তাদের পরাধীন মানসিকতায় ফেরত পাঠানো ছিল প্রায় অসম্ভব। অসম্ভব শোষণ, নির্যাতন, গণহত্যার পর পাকিস্তানে থাকাও ছিল অসম্ভব। তাহলে মন্ত্রী মহোদয় ‘স্বাধীন না হওয়ার’ পরিস্থিতি কীভাবে কল্পনা করে নিলেন? এমন কথা বলার সময় তাঁর ইতিহাসজ্ঞান ‘না না না’ করে না উঠলেও তাঁর স্বাধীনতার চেতনা মনের ভেতর আর্তনাদ করে ওঠেনি কি?
১৯৫৪ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ কেন কোনো বাঙালি স্বাধিকারকামী পাকিস্তানি আইন পরিষদে মাথা উঁচু করে থাকতে পারেননি। নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারের আয়ু ছিল মাত্র দুই মাস। বাংলাদেশ-পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বড় সময়টায় কোনো পার্লামেন্টই ছিল না। সত্তর সালে নির্বাচিত সংবিধান সভা এক দিনের জন্যও বসতে পারেনি। কিন্তু কেউ কেউ তবু মাথা উঁচু করে ছিলেন, যেমন খাজা নাজিমউদ্দিনের মতো পরাধীনতামনস্ক রাজনীতিকেরা। অবশ্য একাত্তরের অবরুদ্ধ বাংলাদেশেও কিছু ব্যক্তি ঢাকার রাজভবনে মাথা উঁচু করেই দেশদ্রোহ করে গেছেন। জনাব আমির হোসেন আমু তো তাঁদের কেউ নন। তাহলে কোন কাল্পনিক পরিস্থিতির কথা শিল্পমন্ত্রী আমাদের শোনালেন?
শিল্পমন্ত্রী কি বোঝাতে চেয়েছেন যে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় সংশোধনী পাসকারী সংসদ সদস্যদের মাথা যেভাবে হেঁট হয়েছে, পাকিস্তান আমল হলে সেটা হতো না? কোন পাকিস্তানের কথা তিনি বলছেন, যার কারাগারে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৭৫ দিন বন্দী ছিলেন। ১৯৪৯ সালেই যখন বঙ্গবন্ধু বুঝে গিয়েছিলেন, ‘ওদের সঙ্গে থাকা যাবে না’, সেখানে ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দলের একজন নেতা, তাঁরই দলের নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারের একজন মন্ত্রী পাকিস্তানিদের সঙ্গে ভালো থাকার কথা বলতে পারেন কীভাবে? এই কল্পনা তিনি কোথায় পেলেন? পাকিস্তানের হাতে নির্যাতিত-নিহত-ধর্ষিত লাখো বাঙালি নর-নারীর স্মৃতি তাঁর এই উক্তিতে কীভাবে বেদনায় কুঁকড়ে যেতে পারে, তা কি তিনি বুঝতে পারেন?
এ সিদ্ধান্তে আমরা আসতেই পারি যে শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পূর্ণই কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু কল্পনা আকাশকুসুম নয়। মানুষ তা-ই কল্পনা করে, যা কোনো না কোনোভাবে সম্ভবপর। পাখির ডানা না থাকলে কেউ আকাশে ওড়ার কল্পনা করত না। কেউ না কেউ জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানে মাথা উঁচু করে ছিল বলেই মন্ত্রী মহোদয়ের মনে এমন কল্পনা এসেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে তিনি আসলে ভুলই বলেছেন, যাকে বলে স্লিপ অব টাং। মনোবিজ্ঞানে ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ বলে একটা বিষয় আছে। আচমকা বলে ফেলা কথার মধ্যে মনের কোণায় লুকিয়ে থাকা সত্য বেরিয়ে এলে তাকে বলে ফ্রয়েডিয়ান স্লিপ। শিল্পমন্ত্রীর সম্ভবত সেটাই হয়েছে।