বাস্তবায়ন করতে হবে দেশীয় সম্পদে

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজি) হলো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যসমূহের সমন্বয়। সেগুলো হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত। এসডিজিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়নের জন্য সব ধরনের দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব, ন্যায়সংগত মানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, টেকসই শিল্পায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করা এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক লক্ষ্য স্থির ও পূরণ করা প্রয়োজন।

এসডিজি মূলত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের বা এমডিজির পরবর্তী ধাপ, যাকে এমডিজির উত্তরাধিকার বলা যায়। যদিও ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ মোটামুটিভাবে দারিদ্র্য নিরসন করতে সক্ষম হয়েছে এবং তাদের জনগণের জন্য জীবনযাপনের একটি নির্দিষ্ট মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই দেশগুলোতেও অসম উন্নয়ন ও গুরুতর বৈষম্য রয়েছে। অন্যদিকে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশের সংখ্যাগুরু জনগণ এখনো উন্নত জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এমডিজি ও এসডিজি উভয়ের উৎস একই। সেটা হলো, দেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বব্যাপী এ ধরনের গুরুতর অসম উন্নয়ন ও বৈষম্য পর্যায়ক্রমিক ও দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত সংকটের জন্ম দেয়। অতএব, এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় নির্দিষ্ট কর্মসূচি প্রয়োজন।

যদিও এমডিজি ও এসডিজি উল্লিখিত সংকট মোকাবিলার উদ্দেশ্যে প্রণীত, তাহলে এসডিজির ধরনে কী পরিবর্তন এসেছে? এখানে তিনটি প্রধান পরিবর্তনকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। প্রথম পরিবর্তন হলো, যেখানে এমডিজি প্রধানত সামাজিক উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিল, সেখানে এসডিজিতে একটি বিস্তৃত বিষয়সূচি আছে, যা সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নের অন্য দুটি স্তম্ভকেও অবলম্বন করে—অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত। দ্বিতীয় প্রধান পরিবর্তন হচ্ছে, যেখানে এমডিজিতে প্রধানত টার্গেট ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলো; এসডিজি, উন্নয়নের মধ্যে পার্থক্য সত্ত্বেও, সব দেশের জন্য প্রযোজ্য। তৃতীয় প্রধান পরিবর্তন হলো, যেখানে এমডিজির একটি ‘উত্তর-দক্ষিণ’ মডেলের বৈশিষ্ট্য ছিল, যা ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে একটি ‘দাতা-গ্রহীতা’ সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল; এর বিপরীতে এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের চাবিকাঠি হিসেবে দেশীয় সম্পদ সংগ্রহের ওপর জোর দেয়। এটা স্পষ্ট যে এমডিজির প্রক্রিয়া, ফলাফল ও অগ্রগতির ব্যাপারে বৈশ্বিক ‘অসন্তুষ্টির’ ফলে এসডিজির অধীনে এমন ব্যাপক লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশগুলোকে তাড়িত করা হয়েছে।

এমডিজি বাস্তবায়নে অগ্রগতির ক্ষেত্রে বেশ কিছুসংখ্যক দেশ পিছিয়ে আছে। এমডিজি ট্র্যাক গ্লোবাল ইনডেক্স (www.mdgtrack.org <http://www.mdgtrack.org>) দ্বারা প্রকাশিত বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৪০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৬টি দেশ এমডিজি ৭০ শতাংশ থেকে ৭৭ শতাংশের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে, মাত্র ১৮টি দেশ এমডিজি বাস্তবায়ন করতে পেরেছে ৬০ শতাংশ থেকে ৬৯ শতাংশের মধ্যে, ৩০টি দেশ এমডিজি ৫০ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে এবং বাকি ৮৬টি দেশের এমডিজি বাস্তবায়নের হার ৫০ শতাংশের কম।

এখানে উল্লেখ্য, যেখানে এমডিজির ৮টি লক্ষ্যের সঙ্গে ১৮টি টার্গেট ছিল, এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের সঙ্গে ১৬৯টি টার্গেট রয়েছে। অতএব, এমডিজির দুর্বল অগ্রগতি ও এসডিজির অতি বিস্তৃত পরিধির কারণে প্রশ্ন উঠেছে, আগামী ১৪ বছরের মধ্যে (২০৩০ সাল নাগাদ) অধিকাংশ দেশ এসডিজির অধীনে ‘উচ্চাভিলাষী’ লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে কি না।

এসডিজির অন্যতম একটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ও প্রস্তাবিত সূচকগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই অপরিমাপযোগ্য। এসডিজি অর্জনের অগ্রগতি নিরীক্ষণের সময় এটা সমস্যা সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া এমন সূচক রয়েছে যেগুলো ২০৩০ সালের জন্য কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারে না। আবার কিছু সূচকের জন্য তথ্য পাওয়া যায় না এবং বেশ কিছু সূচকের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বলে মনে হয়।

এসডিজি বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ। আগে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, দেশীয় উৎস থেকে সম্পদ আহরণ এসডিজি অর্জনের মুখ্য বিষয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও অবকাঠামোর অধিকারী অধিকাংশ দেশ এসডিজির জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ দেশীয় উৎস থেকে কীভাবে আহরণ করবে? এটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এসব দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও শাসনপদ্ধতি-সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ছাড়া নিছক সম্পদ আহরণের মাধ্যমে এসডিজি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা যাবে না।

এসডিজির জন্য পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিস্থিতি অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ। এর যেকোনো সাফল্যের সঙ্গে দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন ও বাণিজ্য একীভূতকরণের সম্পর্ক রয়েছে। তবে সম্প্রতি ব্রিটেনের ব্রেক্সিট ও যুক্তরাষ্ট্রের সংরক্ষণবাদী সরকার এই বিশ্বায়ন ও বাণিজ্য একীভূতকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যে দৃঢ় সংশয় সৃষ্টি করেছে, যা এসডিজি অর্জনের জন্য ‘বিশ্বব্যাপী অংশীদারির’ ভবিষ্যতের ওপর কালো ছায়া ফেলেছে। আগামী দিনগুলোতে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধেরও ঝুঁকি রয়েছে, যা অবশ্যই এই ‘বিশ্বব্যাপী অংশীদারি’র সম্ভাবনা হ্রাস করবে।

উল্লিখিত চ্যালেঞ্জগুলো সত্ত্বেও এসডিজিতে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনে কিছু অর্থবহ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি আছে। এসডিজি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য তাই শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। দেশে ও বিশ্বব্যাপী এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য সহায়ক রাজনৈতিক পুঁজি তৈরি করা প্রয়োজন, যা আগামী দেড় দশকে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে।

ড. সেলিম রায়হান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক।